আলজেরিয়ানরা বিপ্লবী জাতি। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ করে তারা তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। সেই যুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করেছিল দেশটির নারী ও শিশুরাও, আরব দেশগুলোর জন্য যা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু ২০১১ সালে যখন মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে আরব বসন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন আলজেরিয়ার পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত।
বেশ কিছু প্রতিবাদ-সমাবেশ, মিছিল এবং সহিংসতা অবশ্য হয়েছিল, কিন্তু বড় ধরনের আন্দোলনে রূপ নেওয়ার আগেই তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৮ বছর পর সেই আলজেরিয়ানরাই নতুন করে রাস্তায় নেমে এসেছে। অনেকে একে বলছেন আলজেরিয়ার বিলম্বিত বসন্ত। কেন আলজেরিয়ানদের এবারের এই আন্দোলন? কী তাদের দাবি-দাওয়া? আর কী ঘটতে পারে ভবিষ্যতে?
২০১১ সালে আলজেরিয়ায় আরব বসন্ত জনপ্রিয়তা না পাওয়ার জোরালো কারণ ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক দশকের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শেষে তারা সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। গৃহযুদ্ধের অবসানের পর প্রেসিডেন্ট আব্দুল আজিজ বুতাফ্লিকা দেশটিকে সবেমাত্র স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তেলের দাম বেশি (ব্যারেল প্রতি প্রায় ১১০-১৪০ ডলার) থাকায় তিনি প্রচুর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও হাত দিতে পেরেছিলেন।
আব্দুল আজিজ বুতাফ্লিকা প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে, এরপর আবার ২০০৪ সালে। ২০০৮ সালে তিনি সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ দুইবার ক্ষমতায় থাকার যে বিধান ছিল, তা বাতিল করে দেন এবং ২০০৯ সালে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন। তবে তারপরেও ২০১১ সালে তিনি তার শাসনামলের মাত্র ১১ বছর পার করছিলেন, যা ছিল অন্যান্য আরব দেশের তুলনায় অনেক কম। ফলে আলজেরিয়ানরা তখন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেয়ে দেশের স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিক উন্নতি বজায় রাখার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল।
তারপরেও অল্প-স্বল্প আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে চলা জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ২০১২ সালের মে মাসে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার সে সময়ে চলা তৃতীয় মেয়াদের শাসন শেষ হওয়ার পরেই তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার প্রজন্মের সময় পার হয়ে গেছে।”
কিন্তু বাস্তবে সেটা ছিল জনগণকে শান্ত করার কৌশল মাত্র। তার সে প্রতিশ্রুতির পর ২০১৪ সালে তিনি আবারও নির্বাচিত হয়েছেন, এবং আগামী এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আবারও প্রতিদ্বন্দিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর তার এ ঘোষণার পরই মাঠে নেমে এসেছে আলজেরিয়ানরা।
এরমধ্যে অবশ্য অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেছে। ২০১২ সালের সেই ভাষণটিই ছিল জনসমক্ষে বুতাফ্লিকার সর্বশেষ ভাষণ। ২০১৩ সালে স্ট্রোক করার পর তিনি পুরোপুরি হুইলচেয়ারে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। গত ছয় বছরে তিনি প্রকাশ্যে আসেনইনি বললে চলে। এ সময়ের মধ্যে তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে কোনো ভাষণ দেননি, কোনো অনুষ্ঠানেও যোগ দেননি। অনুষ্ঠানগুলোতে তাকে সম্মান দেখিয়ে ফ্রেমে বাঁধানো তার একটি ছবি রেখে কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়েছে।
স্ট্রোক করার পর থেকে বুতাফ্লিকার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সের হাসপাতালে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে। দেশটা আসলে তিনিই পরিচালনা করছেন কিনা, তা নিয়েও জনমনে সন্দেহ আছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তার আসলে দেশ পরিচালনা করার মতো সামর্থ্য নেই। তাকে পুতুল হিসেবে সামনে রেখে দেশ পরিচালনা করছে মূলত সামরিক অফিসাররা এবং তার ঘনিষ্ঠ ধনী, প্রভাবশালী বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।
হুইলচেয়ারে বসা অবস্থায় বুতাফ্লিকা ২০১৪ সালের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এবং জয়লাভ করেছেন। সে নির্বাচনের জন্য অবশ্য তিনি কোনো প্রচারণাও করেননি। কিন্তু সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র তার পক্ষে থাকায় নির্বাচনে দাঁড়ালেই তার জয় নিশ্চিত। এই সময়ের মধ্যে আলজেরিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় (ব্যারেল প্রতি ৪৫ থেকে ৬০ ডলার) আলজেরিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২০১৩ সালের ১৯৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে মাত্র ৯৬ বিলিয়ন ডলারে এসে নেমেছে।
বর্তমানে আলজেরিয়ার বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৯.২ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ। দেশটির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে, সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো হ্রাস পেয়েছে, সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নীতি। দেশটির ৩০ বছর বয়সের কম কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষই বেকার। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে যখন ৮২ বছর বয়সী অথর্ব প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে যে, তিনি পঞ্চমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দাঁড়াবেন, তখন আলজেরিয়ার জনগণ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে।
আলজেরিয়ার এবারের আন্দোলন দুই দশকের মধ্যে আলজেরিয়ার এবং আরব বসন্তের পর থেকে সমগ্র আরবের মধ্যে বৃহত্তম আন্দোলন। আইনজীবি, সাংবাদিক, ছাত্রছাত্রীসহ সমাজের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এতে যোগ দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের শ্লোগান এবং ব্যানার প্রধানত বুতাফ্লিকার পঞ্চমবারের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে, তবে ধীরে ধীরে তা সমগ্র শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধেই বিস্তৃত হচ্ছে।
আন্দোলন মূলত রাজধানী আলজিয়ার্স কেন্দ্রিক হলেও গত তিন সপ্তাহে অন্যান্য শহরেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমাসীন দলের বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতা পদত্যাগ করে আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। রাজপথে নেমে আন্দোলনকারীদের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন ক্ষমতাসীন এফএলএনের এক সময়ের বিপ্লবী গেরিলা নেত্রী জামিলা বুহের্দও।
আলজেরিয়ার এবারের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি এখনো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আছে। পুলিশ যদিও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে এবং অন্তত ১৯৫ জনকে আটক করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে ফুল দিয়ে, “পুলিশ-জনতা ভাই ভাই” শ্লোগান দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করেছে। কিন্তু আলজেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আন্দোলন চলতে থাকলে তা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। কারণ সিরিয়ার আন্দোলনও পুলিশকে ফুল দেওয়ার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল।
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রেসিডেন্ট বুতাফ্লিকা চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার মধ্যে পদত্যাগের বা নির্বাচনে না দাঁড়ানোর কোনো মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এবারের নির্বাচনে তিনি দাঁড়াবেন, কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর ক্ষমতা ছেড়ে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করবেন এবং সেই নির্বাচনে তিনি আর প্রতিদ্বন্দিতা করবেন না। কিন্তু অতীতে প্রতিশ্রুতি দিয়েও ভঙ্গ করার পর আলজেরিয়ানরা তার কথায় আর আস্থা রাখতে পারছে না।
আলজেরিয়ার পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাবে, তা নির্ভর করবে মূলত প্রেসিডেন্ট এবং তাকে সমর্থন করা সেনাবাহিনীর উপর। প্রেসিডেন্ট যদি জনগণের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন, তাহলে সংসদের উচ্চকক্ষ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে এবং পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করবে।
প্রেসিডেন্ট যদি পদত্যাগ করতে নাও চান, তাহলেও মিসরের মতো সেনাবাহিনী তার উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে পদত্যাগ করা ছাড়া তার অন্য কোনো উপায় থাকবে না। সেনাবাহিনী ইচ্ছে করলে তার অযোগ্যতার অযুহাত দেখিয়ে, বা দেশের স্বার্থ দেখিয়ে সরাসরি নিজেরাও দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু যদি সেনাবাহিনী তা না করে এবং জোরপূর্বক জনগণের আন্দোলনকে দমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা জনগণের উপরেই নির্ভর করবে- তারা কি অথর্ব প্রেসিডেন্ট এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের আধিপত্য মেনে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে? নাকি লিবিয়া-সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা আছে জেনেও আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকবে?
আপডেট: দেশে ফেরার পর ১১ই মার্চ সোমবার প্রেসিডেন্ট আব্দুল আজিজ বুতাফ্লিকা জনগণের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৮ই এপ্রিল সংঘটিত হতে যাওয়া নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। তার পরিবর্তে ন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজন করা হবে এবং তার ভিত্তিতে ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ সাংবিধানিক সংশোধনী এনে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।