আমাদের সমাজের একটা বিশাল অংশ রাজনীতি নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ। সঙ্গত কারণে অনেকের ফেসবুক প্রোফাইলে সংযুক্ত হয় ‘আই হেট পলিটিক্স’ লেবেল। এ কথা বলার অন্তর্নিহিত কারণ উপলব্ধি করতে গেলে দেখা পাওয়া যায়, গণপ্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও জনগণের কাছে করা অঙ্গীকারগুলো বারবার ভঙ্গ করা। আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের জায়গায় অনাকাঙ্ক্ষিত পক্ষ দখল করে ফেলাও এর একটি অন্যতম কারণ। এসব কারণে দেশের একটি অংশ, স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ্যেই তাদের রাজনৈতিক অনীহার ঘোষণা দেয়, যাকে রাজনীতি বিজ্ঞানে ‘পলিটিকাল অ্যাপ্যাথি’ বলে। কিন্তু একে স্বাভাবিক হিসেবে না দেখে এর কারণসমূহের দিকে দৃষ্টি দেয়াই শ্রেয়।
১৯৭০ দশকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এক গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার পথ নির্মাণ করেছে, ১৯৯১ সালে স্যামুয়েল হান্টিংটন যাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ’ হিসেবে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটার পর গণতন্ত্রের জয়জয়কার এত বেশি উচ্চকিত হয়ে ওঠে যে, বিংশ শতাব্দী হয়ে ওঠে অনেকের কাছে গণতন্ত্রের শতক। প্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোয় এ ধরনের গণতন্ত্রের হাওয়া লাগে আরও অনেক পরে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। তবে তার আগেই গণতন্ত্রের জয়জয়কার ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা এতে এত বেশি আহ্লাদিত হন যে, সমাজতন্ত্র পতনের মাধ্যমে ইতিহাসের ‘অবসান’ ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে ‘দ্য এন্ড অভ হিস্টোরি’ নামে আস্ত একটি বই-ই লিখে ফেলেন।
আরব বসন্তের ফলে প্রাচ্যের মুসলমান অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটালেও গণতন্ত্রায়নের কোনো স্ফুলিঙ্গ সেখানে এখনো জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। আরব বিশ্বসহ বিশ্বের বিভিন্ন নেতারাও ক্ষমতায় টিকে থাকতে গণতন্ত্রকে অকার্যকর শাসনব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরতে প্রয়াস চালান। ডেমোক্র্যাসি আর হেট্রেড অভ ডেমোক্র্যাসি মিলিয়ে বিভিন্ন দেশে যে ধরনের গণতন্ত্রের প্রচলন ঘটেছে, তাকে বিভিন্নজন ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্নভাবে। আধা গণতন্ত্র (Semi democracy), প্রায় গণতন্ত্র (Virtual Democracy), নির্বাচনী গণতন্ত্র (Electoral Democracy), ছদ্ম গণতন্ত্র (Pseudo-democracy), ফরিদ জাকারিয়ার অনুদার গণতন্ত্র (Illiberal Democracy), আধা কর্তৃত্ববাদ (Semi-authoritarianism), ইউভাল নোয়া হারারির কোমল কর্তৃত্ববাদ (Soft authoritarianism) কিংবা নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ (Electoral authoritarianism); এরকম বিভিন্ন প্রত্যয় ব্যবহার করা হচ্ছে অন্তর্নিহিত দিককে বুঝবার জন্য। ল্যারি ডায়মন্ড আবার আরো এগিয়ে বলছেন, এ ধরনের শাসনকালকে বরং সংকর শাসনব্যবস্থা (Hybrid Regime) হিসেবে দেখাই ভালো।
এভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও প্রকৃত গণতন্ত্রের পার্থক্য আলোচনায় আবর্তিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্রের দুই ধরনের পরস্পর-সম্পর্কিত সমালোচনা রয়েছে।
১) প্রথমটির শুরু প্লেটোর সময় থেকে এবং যাকে চিহ্নিত করা যায় ক্লাসিক্যাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে। গণতন্ত্রের ক্লাসিক্যাল চ্যালেঞ্জটি নির্মিত হয় গণতন্ত্রের পরিধি সীমিত করে অভিজাত আইনপ্রণেতা, বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, ইন্টারেস্ট গ্রুপ, এমনকি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের উষ্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা থেকে।
২) দ্বিতীয়টি পরিসরটি সৃষ্টি হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। নির্বাহী ও আইনী কার্যক্রমের মধ্যকার বিভাজনের অবসান ঘটিয়ে অর্থাৎ আইন ও বিচার বিভাগে শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এবং নাগরিক সমাজের ওপর জনপ্রিয় বা পপুলার নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে।
তবে দার্শনিক জ্যাক রঁসিয়ে তার ‘হেট্রেড অভ ডেমোক্রেসি’তে আলোচনা করেছেন গণতন্ত্রের সমালোচনার এ দুটি ধরনের বাইরে দাঁড়িয়ে। তার মতে আমরা গণতন্ত্রের কথা যতই বলি না কেন, শাসকশ্রেণী গণতন্ত্রকে ক্রমশ ঘৃণ্য করে তোলে, যাতে জনগণ গণতন্ত্রিক শান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেননা, গণতন্ত্রকে সমালোচিত করে তোলার মধ্যে দিয়েই ক্রমাগত নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা যায়। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণী গণতন্ত্র নিয়ে নাগরিকদের মনে এমন একটি মানসিকতা প্রবেশ করায় যে, ভালো কোনো কাজ পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনামলে সম্ভব হয় না, নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা না থাকলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। কেননা গণতন্ত্র থাকার মানেই হলো, রাজপথে প্রতিবাদ করার সুযোগ রাখা এবং এ ধরনের সুযোগের অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের স্বার্থে গৃহীত পরিকল্পনা নষ্ট করার সুবিধা দেওয়া।
তিনি গণতন্ত্রকে দেখেন এমন এক অবস্থা হিসেবে, যেখানে স্বাধীনতা, সমতা আর আইন রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে না, প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্ব হয় না বরং বাস্তব জীবন ও অভিজ্ঞতার নিবিড় গড়নের মধ্যে গড়ে ওঠে।
গণতন্ত্রকে যারা হাতেগোনা কিছু সূচকের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার জন্য সরকার ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন এবং তত্ত্বের খাতিরে নানা তত্ত্ব সৃষ্টি করে চলেছেন, রঁসিয়ের ‘হেট্রেড অভ ডেমোক্র্যাসি’ তাদের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তার মতে, গণতন্ত্র হলো অ্যাক্ট; ব্যবস্থা কিংবা কাঠামো নয়।
গণতন্ত্র হলো- না কোনো ধরনের সংবিধান, না কোনো কাঠামোর সমাজ; এই বিবেচনাবোধ থেকে রঁসিয়ে রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে সমার্থক করে তুলেছেন। রঁসিয়ে আলোচনা করেছেন সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের সমস্যা নিয়ে। সাম্প্রতিককালের গণতন্ত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সার্বভৌম জনগণ এখানে তাদের ক্ষমতাকে অর্পণ করে জনগণের সংসদীয় প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু জনগণের নির্বাচিত অভিজাত প্রতিনিধি ও আমলাতন্ত্রের শিক্ষিত ক্যাডারদের অভিজাতদের সংশ্লেষণ ঘটে রাষ্ট্রের সংসদে। তাই যেসব দেশকে গণতান্ত্রিক বলা হয়, সেগুলো আসলে প্রায় ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক নয়। রঁসিয়ে বরং সেগুলোকে বলতে চান, আইনী রাষ্ট্রের অভিজাততান্ত্রিক শাসন। কারণ হিসেবে তিনি দেখাচ্ছেন-
প্রথমত, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনি তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে আপনার প্রতিনিধি বানালেন। এখন নির্বাচিত হয়ে সেই প্রতিনিধিরা আপনার অধিকারগুলো পূর্ণ না করলে আপনি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন? কিছুই করতে পারবেন না, বরং জনপ্রতিনিধিরা স্বজনপ্রীতি, পৃষ্ঠপোষকতা, এবং আত্মসাতের মাধ্যমে তৈরি করে জেমস স্কটের সেই মেশিন পলিটিক্স। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটিয়ে তারা নিয়মিত নিজেদের পকেট ভারি করতেই ব্যস্ত থাকে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের ক্ষমতার আরেকটি কেন্দ্র থাকে প্রশাসনিক আমলাদের হাতে। শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের ব্যবহার কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা করে। রাষ্ট্রীয় সাহায্যে এই আমলারা গড়ে তোলে এক ত্রাসের রাজত্ব। এজন্যই সরকারি অফিসে গিয়ে আপনাকে সম্মুখীন হতে হয় লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের। আইনি কাজটি করিয়ে নিতে প্রয়োজন হয় উৎকোচের। তাই আমরা দেখি বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সকল ধরনের গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্য আস্থার সংকট একুশ শতকের রাজনীতির বৈশিষ্ট্যে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, দল-জোটের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। এর ফলে একটি অরাজনৈতিক সমাজের উদ্ভব ঘটছে।
পুঁজিবাদী শাসকদের প্রয়োজন হয় খণ্ডিত, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের অথবা গণতন্ত্রহীনতার অথবা গণতন্ত্রের মুলোর। আমাদের বাংলাদেশ গত ৪৮ বছর ধরে এসবেই আবর্তিত হয়ে চলেছে। সামরিকতন্ত্র থেকে নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে প্রবেশের পর এখন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো গণতন্ত্রের ধারণাটিকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করা, জ্যাক রসিঁয়ের মতো রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে একই চোখে দেখার শক্তি অর্জন করা।