শত্রুর সন্ধানে: মোল্লা ওমরের ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আত্মগোপন

৯/১১ এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান দখল করে, তখন তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মোল্লা ওমরকে গ্রেপ্তার করা। আফগানিস্তানের সাবেক ইসলামিক ইমারাতের রাষ্ট্রপ্রধান এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল, তিনি আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

মোল্লা ওমরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমেরিকা সে সময় ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যা ছিল বিন লাদেনের পর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কিন্তু আফগানিস্তানের পতনের পর ওসামা বিন লাদেনের মতোই মোল্লা ওমরও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে তার মৃত্যুর দুই বছর পরেও তার অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে কেউ কিছু জানত না।

২০১৫ সালে তালেবান যখন মোল্লা ওমরের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে, তখন পর্যন্ত আমেরিকার দাবি ছিল, তালেবানের পতনের পরপরই মোল্লা ওমর পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে বসেই তিনি আল-কায়েদার সাথে সমন্বয় করে তালেবানের অপারেশনগুলো পরিচালনা করছিলেন, বিভিন্ন অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিতরণ করছিলেন এবং একাধিকবার ওসামা বিন লাদেনের সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন।

এমনকি ২০১৫ সালে আফগান গোয়েন্দা সংস্থা এনডিএস যখন প্রথম দাবি করে, মোল্লা ওমর করাচির একটি হাসপাতালে মারা গিয়েছেন, তখনও সিআইএ তাদের সাথে সুর মেলায়। সিআইএ দাবি করে, তারা শুরু থেকেই জানত মোল্লা ওমর পাকিস্তানে ছিলেন। সিআইএর পরিচালক ডেভিড পেট্রিওস এরকমও দাবি করেন, তাদের কাছে তথ্য ছিল মোল্লা ওমর বেলুচিস্তান থেকে করাচিতে যাওয়া-আসা করতেন, কিন্তু তারা তার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ব্যাপারে পাকিস্তানকে রাজি করাতে পারেননি।

মোল্লা ওমর; Image Source: Magnum Photos

কিন্তু দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে কাজ করা প্রখ্যাত ডাচ সাংবাদিক বেটে ড্যাম (Bette Dam)-এর মতে, এ সবই মিথ্যা। বেটে ড্যাম ২০০৬ সাল থেকে আফগানিস্তানে সংবাদ কভার করে আসছেন। শেষ পাঁচ ধরে তিনি আফগানিস্তানের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন মোল্লা ওমর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গিয়ে তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। সর্বশেষ তিনি কথা বলেছেন শেষদিন পর্যন্ত মোল্লা ওমরের সাথে থাকা তার বডিগার্ডের সাথেও।

এসব সাক্ষাৎকার ও অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করেই তিনি সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন মোল্লা ওমরের জীবনীমূলক বই, Looking for An Enemy। এই বইয়ে উঠে এসেছে মোল্লা ওমরের শেষ দিনগুলোর পলাতক জীবনের কথা, তার মৃত্যুর কথা এবং তাকে গ্রেপ্তার করতে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতার কথা। তার বর্ণনাগুলো অনেকক্ষেত্রেই মার্কিন কর্মকর্তাদের বর্ণনার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সিআইএ যেখানে দাবি করে মোল্লা ওমর পাকিস্তানে বসে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তালেবানদের আক্রমণগুলোর পরিকল্পনা, অর্থায়ন এবং পরিচালনা করছিলেন, সময়ে সময়ে বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাৎ করছিলেন, সেখানে বেটে ড্যাম দাবি করেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মোল্লা ওমর পুরো সময়টা অবস্থান করছিলেন আফগানিস্তানে; এক মার্কিন ঘাঁটি থেকে মাত্র তিন মাইল দূরের এক আস্তানায়!

বইটির প্রচ্ছদ; Image Source: De Bezige Bij

বেটে ড্যামের বইয়ের সবগুলো দাবি অবশ্য নির্ভুল নাও হতে পারে। অনেক গবেষক তার দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বইটির দাবিগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মোল্লা ওমর যে আফগানিস্তানেই ছিলেন, সেটিসহ বইটির আরো কিছু দাবির সত্যতার পক্ষে টুইট করেছেন তালেবানের অফিশিয়াল মুখপাত্র মোল্লা জাবিহউল্লাহ। তিনি মোল্লা ওমরের আফগানিস্তানের সেই বাসস্থানের দুটি ছবিও টুইট করেছেন।

বেটে ড্যামের বইটি ডাচ (ওলন্দাজ) ভাষায় লেখা। এটি বর্তমানে ইংরেজিতে অনুবাদের অপেক্ষায় আছে। তবে বইটির একটি সারমর্ম সম্প্রতি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। এই সারমর্ম অবলম্বনে মোল্লা ওমরের জীবনের শেষ দিনগুলো নিয়ে আমাদের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব

মোল্লা ওমরের ১৯৭৮ সালের ছবি; Image Source: AFP

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে ২০০১ সালের অক্টোবরের ৭ তারিখে। ঠিক দুই মাস পরে, ডিসেম্বরের ৭ তারিখে পতন ঘটে তালেবানদের সর্বশেষ শক্তিশালী ঘাঁটি কান্দাহারের। আফগানিস্তানে শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদী মার্কিন দখলদারিত্ব। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে জার্মানীর বনে তালেবান বিরোধী আফগান নেতারা একত্রিত হন। বন অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো হয় হামিদ কারজাইকে। কিন্তু পেছনে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সিআইএ।

একই দিনে কান্দাহারের এক ব্যবসায়ীর বাড়ির ভূ-গর্ভস্থ আস্তানায় তালেবানের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে এক গোপন বৈঠকে বসেন মোল্লা ওমর। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় কী হতে পারে, তা নির্ধারণ করাই ছিল এ বৈঠকের উদ্দেশ্য। মোল্লা ওমর মেঝেতে বসেছিলেন। তার কোলের উপর রাখা ছিল একটি রাইফেল। সম্ভাব্য নজরদারি এড়ানোর উদ্দেশ্যে একাধিকবার গাড়ি পরিবর্তন করে তালেবান নেতারা যখন একে একে অধিবেশনস্থলে এসে পৌঁছেন, তখন মোল্লা ওমর তাদেরকে প্রশ্ন করেন, “কী করতে চাও তোমরা?”

সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত তালেবান নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন আফগানিস্তানের জাবুল প্রদেশের উচ্চপদস্থ এক তালেবান কমান্ডার, আব্দুস সালাম রাকিতি। তার বর্ণনানুযায়ী, বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশ তালেবান নেতাই অসম এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু মোল্লা ওমরের সামনে বিষয়টি কীভাবে উপস্থাপন করবেন, কিংবা তাদের মতামত মোল্লা ওমর কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেটি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন।

২০০৯ সালে মোল্লা আব্দুস সালাম রাকিতি; Image Source: Shah Marai/Getty Images

শেষপর্যন্ত তাদের মধ্য থেকে একজন সাহস করে বলে ফেলেন, “আমরা আর এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাই না। আমরা আত্মসমর্পণ করতে চাই।” মোল্লা ওমরের কাছ থেকে আব্দুস সালাম রাকাতি তীব্র প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু মোল্লা ওমর কিছুই বললেন না। শান্ত ভঙ্গিতে তিনি জানালেন, তিনি আর সংগঠনটির নেতৃত্বে থাকতে চান না। বরং তার সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ওবায়দুল্লাহর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে অবসরে চলে যেতে চান।

সেদিনই মোল্লা ওমর একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে লেখা ছিল, মোল্লা ওবায়দুল্লাহই এখন থেকে সংগঠটির নেতৃত্ব দেবেন এবং এর সদস্যদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন। চিঠিতে স্বাক্ষর করে তিনি তালেবান নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে পরপর দুইবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ?” এরপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং সবাইকে বসিয়ে রেখে একাই বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গীরা অবাক হয়ে বসে রইল। সে সময় রমজান মাস ছিল। বিস্মিত তালেবান নেতারা সেদিন ইফতার করতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল।

মোল্লা ওবায়দুল্লাহ; Image Source: Wikimedia Commons

পরদিন মোল্লা ওবায়দুল্লাহ কান্দাহারের শাহ ওয়ালি কোট জেলায় গিয়ে হামিদ করাজাইর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কারজাইয়ের সাথে তার একধরনের সমঝোতা হয়, যা পরবর্তীতে শাহ ওয়ালি কোট অ্যাগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত হয়। ঐ সমঝোতায় তিনি এবং তার অধীনস্থ তালেবান নেতারা অস্ত্র সমর্পণ করে অবসরে যাওয়ার অথবা সরকারে যোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে হামিদ কারজাই গণমাধ্যমের সামনে ঘোষণা দেন, ওসামা বিন লাদেন এবং আল-কায়েদা আফগানিস্তানের শত্রু হলেও তালেবানরা আফগানিস্তানেরই ভূমিপুত্র, ফলে তারা সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত হবে।

কিন্তু হামিদ কারজাই ছিলেন বাস্তবে ক্ষমতাহীন এক পুতুল রাষ্ট্রপ্রধান। মূল ক্ষমতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এবং তাদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিতে মোল্লা ওমর ছিল ওসামা বিন লাদেনের পর বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্ত্রাসী এবং তার সংগঠন তালেবান ছিল আমেরিকার জন্য বিপজ্জনক হুমকি। ফলে তারা তালেবানের সাথে সমঝোতায় যাওয়া কারজাইয়ের সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিল না। তাদের পরিকল্পনা ছিল আল-কায়েদার মতোই তালেবানকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়া।

২০০১ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণের পর হামিদ কারজাই; Image Source: University of Texas Press

সেদিনই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড হামিদ কারজাইকে ফোন করেন এবং গণমাধ্যমে দেওয়া তার বক্তব্য ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। আমেরিকানরা তালেবানদের সাথে কারজাইয়ের সমঝোতার বিভিন্ন প্রচেষ্টা রুখে দেওয়ার ব্যাপারেও সক্রিয় হয়। কান্দাহারের গভর্নর হিসেবে কারজাই তালেবানদের প্রতি নমনীয় এক ব্যক্তিকে বাছাই করেছিলেন। কিন্তু আমেরিকানরা তাকে সরিয়ে প্রচণ্ড তালেবান বিদ্বেষী যুদ্ধবাজ নেতা গুল আগা শেরজাইকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করে।

দায়িত্ব নিয়েই গুল আগা শেরজাই এবং তার মিলিশিয়া বাহিনী সাধারণ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি পাওয়া তালেবানদেরকে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। যুদ্ধ এবং দখলের পরেও তালেবানদের সাথে শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেখানে আফগানিস্তানকে নতুন করে গড়ে তোলার সুন্দর একটি সম্ভাবনা ছিল, ধীরে ধীরে সেই সম্ভাবনা ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে থাকে। তালেবান নেতাদের অনেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে শুরু করে, বাকিরা বাধ্য হয়ে পুনরায় অস্ত্র হাতে তুলে নিতে থাকে।

তবে শেরজাই এবং আমেরিকানদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তালেবানদের নেতা মোল্লা ওমরকে গ্রেপ্তার করা। তাদের সম্মিলিত বাহিনী মোল্লা ওমরের খোঁজে কান্দাহার এবং হেলমান্দ প্রদেশে বিশাল অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু মোল্লা ওমর যেন ততদিনে স্রেফ বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেছেন। সেদিনের ঐ বৈঠকের পর তালেবানের উচ্চপদস্থ নেতারাও আর কখনো তাকে চোখে দেখেননি।

কোথায় গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন মোল্লা ওমর? সেটা আমরা জানব এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব

This article is in Bangla language. It's about the last days of the late Taliban leader Mullah Omar, based on the book "Looking for an enemy' by Dutch journalist Bette Dam.

All the references are hyperlinked inside.

Featured Image: De Bezige Bij

Related Articles

Exit mobile version