যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল রিপাবলিকান পার্টি। এটা হয়তো আমাদের অজানা নয় যে, বর্তমান রিপাবলিকান পার্টি সাংস্কৃতিকভাবে রক্ষণশীল, অধিকাংশ নীতিতেই গোঁড়া ও কট্টরপন্থী। রিপাবলিকানদের মূল ভোটার বেজ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা। আরও ভালোভাবে বললে রক্ষণশীল ও বয়স্ক শ্বেতাঙ্গরা। তাদের নির্বাচনী দুর্গ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল, যা ঐতিহাসিকভাবে রক্ষণশীল। বর্তমান রিপাবলিকান পার্টির রাজনৈতিক ভাবতত্ত্ব এতটাই গোঁড়া ও উগ্র যে, নোম চমস্কি তাদেরকে ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিষ্ঠান ও মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
রিপাবলিকান পার্টি কিন্তু সবসময় এরকম ছিল না। এই রাজনৈতিক দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আব্রাহাম লিংকন, যাকে ধরা হয় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কদের একজন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত দেড়শো বছরে আগাগোড়া বদলে গিয়েছে এই রাজনৈতিক দলটি। আব্রাহাম লিংকনের পার্টি থেকে পরিণত হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পার্টিতে। রিপাবলিকানদের এই রাজনৈতিক মেরু-পরিবর্তন নিয়েই আমাদের এবারের আলোচনা।
হুইগ পার্টির পতন: রিপাবলিকান পার্টি গঠন
১৮৪২-৪৪ সালে মেক্সিকো-আমেরিকা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমেরিকা তাদের দক্ষিণ-পশ্চিমে মেক্সিকোর বেশ কিছু প্রদেশ দখল করে নেয়। আর পুরো যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলেই তখন নগরায়ন চলছিল। সহজ ভাষায় বললে, ইউরোপ থেকে পাড়ি দিয়ে পূর্বাঞ্চলে সভ্যতা গড়া শ্বেত আমেরিকানরা তখন পশ্চিমে ধাবমান হওয়া শুরু করেছিল। আর তখনই রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা বড় দ্বন্দ্ব দেখা দেয় দাস ব্যবস্থা নিয়ে। নতুন প্রদেশগুলোয় আগের মতো দাস ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে কি না তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে রাজনীতিবিদরা।
সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বড় রাজনৈতিক দল ছিল; ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও হুইগ পার্টি। তখনকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দুর্গ ছিল দক্ষিণাঞ্চল। উত্তরের দল ছিল হুইগরা। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা পরিচালিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নতুন প্রদেশগুলোতেও দাস ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু হুইগ পার্টি এর ঘোর বিরোধিতা করে। বিরোধিতার মূল কারণ ছিল, উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিবিদরা ভয় পাচ্ছিলো নতুন প্রদেশগুলোতেও দাস প্রথা অব্যাহত থাকলে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকরা কোনো কাজ পাবে না। কিন্তু হুইগদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৮৫৪ সালে কানসাস-নেব্রাস্কা নীতি পাশ করে ডেমোক্র্যাটরা। ফলশ্রুতিতে ভেঙে পড়ে হুইগরা। পুরো রাজনৈতিক দলটিই বিলুপ্ত হয়ে যায় কয়েক মাসের মধ্যে। তখন প্রগতিশীল হুইগরা, যারা যারা দাস প্রথার বিস্তার চায় না, তারা মিলে ১৮৫৪ সালে একটি নতুন রাজনৈতিক দল খোলেন, নাম দেন ‘রিপাবলিকান পার্টি’।
লিংকন, গৃহযুদ্ধ ও দাসপ্রথা বিলোপ
১৮৬০ সালে রিপাবলিকান পার্টির টিকেট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন। যদিও নির্বাচনের আগে লিংকন বলে এসেছিলেন, তিনি যেসকল প্রদেশে দাসপ্রথা বিরাজ করছে, সেখান থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করার কোনো চেষ্টা করবেন না, কিন্তু নির্বাচনের পর তার সাথে সাথে সুর বদলে যায় রিপাবলিকানদের।
রিপাবলিকানরা দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে দেবে- এই আশঙ্কায় তাই তটস্থ হয়ে পড়ে ডেমোক্র্যাটরা। দক্ষিণের ১১টি প্রদেশ নিয়ে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে উত্তরের বিরুদ্ধে। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই যুদ্ধে জয়লাভ করে সরকার সমর্থিত উত্তরাঞ্চলীয় ইউনিয়ন, যার ফলে সারা দেশ থেকেই দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে।
গৃহযুদ্ধের পর রিপাবলিকানরা কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার দেয়ার জন্য কাজ শুরু করে। ১৮৬৬ সালে তারা একটি মানবাধিকার আইন পাশ করে, যার মাধ্যমে আইনীভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়। সংবিধানে সংশোধনী এনে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার দেয়া হয়।
কিন্তু এরই মধ্যে বদলাতে শুরু করে রিপাবলিকান পার্টি। গৃহযুদ্ধের সময় সরকার উত্তরাঞ্চলে প্রচুর বিনিয়োগ করে। ফলে উত্তরের অনেক ব্যবসায়ীই ফুলে ফেঁপে ওঠেন। এই ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাই একসময় রিপাবলিকান পার্টির কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে শুরু করেন। রাজনৈতিক জ্ঞানশূন্য এই রিপাবলিকানরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করতে শুরু করেন। তাই জনপ্রিয়তা বজায় রাখার স্বার্থেই তারা কালোদের অধিকারের কথা মুখে আনা বন্ধ করে দেন।
অন্যদিকে দাসপ্রথা বিলুপ্তির ক্ষোভ তখনো দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিরাজমান। কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার দেয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি ডেমোক্র্যাটরা। তারা এর শোধ হিসেবে দমন-পীড়ন চালাতে থাকে কালোদের উপর।
এদিকে আইনি অধিকার দিয়েই লিংকন পরবর্তী যুগের রিপাবলিকানরা ভাবা শুরু করে, কালোদের জন্য তারা অনেক করেছে, এখন অন্যদিকে নজর দেয়া উচিত। দক্ষিণে চলা দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করে যায় তারা।
বিংশ শতাব্দীর সূচনা: দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন
বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টি পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের পার্টিতে পরিণত হয়েছে। যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে দেশের উন্নতি হচ্ছে, তাই সেসব ব্যবসায়ীরা রাজনীতির মাঠেও তাদের ব্যবসার চাকা সচল রাখতে পারছে। কিন্তু ১৯২৯ সালে বিশ্বজুড়ে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে, যা ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত। ধরা হয়ে থাকে, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বিশ্বে এটিই সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
ব্যবসায়ী-কেন্দ্রিক রিপাবলিকানরা এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ব্যাপক বিপাকে পড়ে। দেশের জনগণের কথা চিন্তা না করে নিজেদের দেউলিয়া হওয়া নিয়েই তখন তাদের হাপিত্যেশ চলতে থাকে। রিপাবলিকানদের হাপিত্যেশের মাঝেই ক্ষমতায় আসেন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য রুজভেল্ট সরকারের আকার ও কর্তৃত্ব বাড়াতে শুরু করে। কিন্তু রিপাবলিকানরা এর বিরোধিতা করে। তারা বিশ্বাস করতো এবং এখনো করে, সরকারের আকার ও কর্তৃত্ব সীমিত হওয়া উচিত।
পঞ্চাশ-ষাটের দশক: নাগরিক অধিকার আন্দোলন
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বর্ণবৈষম্য আবার মার্কিন রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের বৈষম্য। যদিও গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আইন করে কালোদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে এই আইন মানা হতো না। অধিকাংশ প্রদেশেই ছিল না কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার। তখন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ম্যালকম এক্স, রোজা পার্কসের মতো বিপ্লবীদের হাত ধরে শুরু হয় নাগরিক অধিকার আন্দোলন। সমান অধিকার ও বিভেদ দূর করার দাবিতে এক হয় কৃষ্ণাঙ্গরা। অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানও তাদের সমর্থন দেয়।
এই নাগরিক অধিকার আন্দোলন আসলে রাজনৈতিক দলভিত্তিক আন্দোলন ছিল না। বরং এটি ছিল অঞ্চলভিত্তিক আন্দোলন। উত্তরের ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণের (প্রায়) সব শ্বেতাঙ্গই এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। ১৯৬৪ সালে পার্লামেন্টে ‘সিভিল রাইট অ্যাক্ট’ এর ভোটাভুটির পরিসংখ্যান ঘাটালেও আমরা দেখতে পাবো, দুই পার্টিরই উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধিরা এই বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, এবং দুই পার্টিরই দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিনিধিরা এই বিলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু এই ঐতিহাসিক বিলে স্বাক্ষর করেছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন। আর কৃষ্ণাঙ্গদের হতবাক করে দিয়ে এই বিলের বিরোধিতা করেছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ব্যারি গোল্ডওয়াটার। এতে করে পুরো আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ, যারা লিংকনের সময় থেকেই রিপাবলিকানদের সমর্থন দিয়ে আসছিল, ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে রাজনৈতিক সমর্থন দেয়া শুরু করে। আর দক্ষিণের গোঁড়া শ্বেতাঙ্গরা, যারা এতদিন ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন দিয়ে আসছিল, রিপাবলিকান পার্টির ছায়াতলে চলে আসে।
পরের এক দশকে রিপাবলিকানরা পুরোপুরি দক্ষিণাঞ্চলীয় পার্টি হয়ে ওঠে। অর্থাৎ আগের ডেমোক্র্যাট পার্টির জায়গাটাই দখল করে তারা। আমরা আজকে যে রিপাবলিকান পার্টিকে চিনি, তার জন্ম এই সময়েই। ১৯৮১ সালে রিপাবলিকানরা রোনাল্ড রিগানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। রিগানের নির্বাচনী মূলনীতিগুলো ছিল ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি, আয়কর হ্রাস ও পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা। রক্ষণশীলরা রিগানকে দেখে একজন আদর্শ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। কিন্তু ইতিহাস বলবে, ধনী-গরীবের মধ্যে তফাৎ তৈরিতে তার চেয়ে বেশি অবদান আর কোনো প্রেসিডেন্টের নেই।
বর্তমান সময়: অভিবাসন সমস্যা ও ট্রাম্প
গত শতাব্দীর শেষভাগ ও এই শতাব্দীর শুরুতে এসে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড়সড় জনতাত্ত্বিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সেটি হচ্ছে অভিবাসন সমস্যা। কম-বেশি বিশ্বের সব দেশের অভিবাসীই আছে আমেরিকায়। তবে গত দুই-তিন দশকে হিসপ্যানিক বা ল্যাটিনো অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
অন্য সব নীতির মতো অভিবাসন সমস্যা সমাধানের বেলাতেও ডেমোক্র্যাটরা উদারনৈতিক। তারা সবসময়ই অভিবাসন নীতি সংস্কার চেয়ে এসেছে। তারা চায় আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় ১ কোটি অভিবাসী বৈধ নাগরিকত্ব পাক। কিন্তু রিপাবলিকানরা বরাবরের মতোই এই ব্যাপারেও রক্ষণশীল। তারা আঁটসাঁট অভিবাসন নীতির পক্ষে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের অবৈধ নাগরিক হিসেবে দেখে।
একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার মতো রাষ্ট্রে অভিবাসী বিরোধী নীতি গ্রহণ করাটা অনেক বেশিই রক্ষণশীলতার পরিচয় দেয়। তাই শুধু এই অভিবাসন নীতির জন্যই ভুগতে হয়েছে রিপাবলিকানদের। ২০১২ প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি ল্যাটিনো অভিবাসীদের কাছ থেকে কড়া জবাব পেয়েছেন। ৭১ শতাংশ ল্যাটিনো ভোটার সেবার বারাক ওবামাকে ভোট দিয়েছিল।
২০১২ নির্বাচনে হারার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে রিপাবলিকানরা তাদের রক্ষণশীল অভিবাসন নীতিকে চিহ্নিত করে। পার্টির অভিবাসন নীতি সংস্কারের কথা ভাবতে শুরু করে রিপাবলিকানরা। কেননা, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমেরিকায় অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কমতে শুরু করেছে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা। বর্তমান পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই এখন অশ্বেতাঙ্গ। যাদের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপ্যানিক, এশিয়ান ও আরও বিভিন্ন বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষ। এবং অনুমিতভাবেই এই সংখ্যা বাড়ছে। সুতরাং, অশ্বেতাঙ্গদের সমর্থন ছাড়া এই যুগে নির্বাচন জেতা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তা দেখে রিপাবলিকান পার্টি ভয় পেতে শুরু করে, অভিবাসী বিরোধী অবস্থান বজায় রাখলে তারা হয়তো আর কখনো প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনই জিততে পারবে না। এই ভয় থেকেই ২০১৩ সালে রিপাবলিকানদের একটি প্রভাবশালী অংশ ডেমোক্র্যাটদের সাথে মিলে একটি নতুন ‘অভিবাসন নীতি সংস্কার আইন’ প্রণয়নের জন্য কাজ করা শুরু করে। উদীয়মান রিপাবলিকান মার্কো রুবিও থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান নেতা জন ম্যাকেইন, অভিবাসন নীতি সংস্কারের পক্ষে কাজ করেছে রিপাবলিকানদের একটি বড় অংশ।
কিন্তু রিপাবলিকানদের প্রধান সমর্থক গোষ্ঠী, গোঁড়া শ্বেতাঙ্গরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। অভিবাসন নীতির পক্ষে কথা বলা সব রিপাবলিকানদের তারা বিশ্বাসঘাতকের চোখে দেখতে শুরু করলো।
রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বের উপর যখন পার্টির ভোটারদের গাঢ় অনাস্থা জন্ম নিচ্ছে, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আসলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই উগ্র ডানপন্থী ধনকুবেরের কোনো রাজনৈতিক জ্ঞান না থাকলেও কয়েক মাসের মধ্যেই রিপাবলিকান ভোটারদের মন জয় করে নিলেন। কেননা, ট্রাম্পের মূল এজেন্ডাই ছিল অভিবাসনবিরোধী। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরি, মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়াই ছিল তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ডা। ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদের ডাকে সাড়া দিলো আমেরিকার উগ্র শ্বেতাঙ্গরা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ট্রাম্প।
ভবিষ্যৎ যাত্রা
যদিও ট্রাম্প এই যাত্রায় রিপাবলিকানদের জন্য সাফল্য নিয়ে এসেছেন, কিন্তু তার অধীনে ব্যাপক অস্বস্তিতে আছে আমেরিকা, অস্বস্তিতে আছে পুরো বিশ্ব । রিপাবলিকান পার্টি দীর্ঘকাল ধরেই ডানপন্থী। কিন্তু বর্তমান রিপাবলিকান পার্টি যেন ডানের সর্বোচ্চ সীমাও অতিক্রম করে ফেলেছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না, সকল বর্ণ ও লিঙ্গের মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করে না।
এমনও হয়েছে, একজন রিপাবলিকান সিনেটর হাতভর্তি তুষার নিয়ে সিনেটে ঢুকে ঘোষণা করেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা একটি গুজব। ট্রাম্প নিজে অনেকবার এ কথা বলেছেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা একটি চীনা প্রোপাগান্ডা। এছাড়া ট্রাম্পযুগে আমরা দেখেছি, ট্রান্সজেন্ডারদের সামরিক বাহিনীতে চাকরির জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সাতটি মুসলিম রাষ্ট্রের জনগণকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। উচ্চ শ্রেণীকে সুবিধা দেয়ার জন্য ট্যাক্স কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এরকম অবস্থান, নীতি ও আদিম চিন্তাধারা খুবই অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। রিপাবলিকান পার্টি তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসলে অচিরেই মার্কিন জনগণ তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, যার কিছুটা ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি সম্প্রতি শেষ হওয়া মধ্যবর্তী নির্বাচন থেকে। নিম্ন-কক্ষের নির্বাচনে রেকর্ড ব্যবধানে জয়লাভ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ডেমোক্র্যাটরা। এর জবাব কীভাবে দেবে রিপাবলিকানরা এটাই এখন দেখার বিষয়। এই পর্যায়ে এসে আবারও ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আব্রাহাম লিংকনের পার্টির। তারা কি উগ্র ডানপন্থী নীতিতেই স্থির থাকবে? নাকি কিছু ক্ষেত্রে প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করবে? যদি উগ্রপন্থাতেই স্থির থাকে, তাহলে বলতেই হয়, তাদের সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।