পৃথিবীর সবচেয়ে রক্ষণশীল দেশগুলোর একটি সৌদি আরব। আরব উপদ্বীপে অবস্থিত এই দেশটির রাষ্ট্রকাঠামোর অনেককিছুই পরিচালিত হয় প্রথার দ্বারা। রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনগুলোও হয় প্রথাগুলোকে সামনে রেখেই। ২০১৫ সালে বাদশাহ আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় শীর্ষপদের পরিবর্তনগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবারই এড়িয়ে যাওয়া হয় প্রথাগুলোকে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে ভাঙা হয় দীর্ঘকাল ধরে পালিত হয়ে আসা প্রথাগুলো।
বাদশাহ সালমান ইবন আবদুল আজিজের প্রথা ভাঙা শুরু হয় ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে। একই সময়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন সামরিক বাহিনীতে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা মোহাম্মদ বিন সালমানকে। কয়েকমাসের মধ্যেই ক্রাউন প্রিন্স মুকরিন ইবনে আবদুল আজিজকে সরিয়ে ক্রাউন প্রিন্স করেন নায়েফকে, ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন মোহাম্মদ বিন সালমানকে। সময়ের সাথে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান মোহাম্মদ বিন নায়েফ, ২০১৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হন মোহাম্মদ বিন সালমান।
অর্থাৎ, বাদশাহ সালমানের সময়কালেই সৌদি আরবের শাসনক্ষমতা প্রথমবারের মতো চলে যেতে শুরু করে সৌদি রাজপরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের কাছে। এই প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিকভাবে দেখলেও, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের নিয়োগ কিংবা ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়াকে স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ নেই।
প্রথাগতভাবে, একজন সৌদি প্রিন্সকে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এসব পদ অর্জন করে নিতে হতো। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের জন্য থাকতে হতো সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্কিত কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ক্রাউন প্রিন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে সাধারণত দেখা যেতো ষাটোর্ধ্ব কিংবা সত্তোরার্ধ কোনো প্রিন্সকে। সেই জায়গায়, বাদশাহ সালমানের সময়ে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দেখা যাচ্ছে সদ্য ত্রিশ পেরোনো মোহাম্মদ বিন সালমানকে, আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই পেয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদটাও। বাদশাহ সালমানের প্রথা ভাঙার এই ধারা সৌদি আরবের শাসনকাঠামোর অন্যান্য ক্ষেত্রেও চলেছে।
বয়স পঁচাশি পেরিয়ে যাওয়ায় বাদশাহ সালমানকে প্রায় সবকিছুতেই নির্ভর করতে হচ্ছে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের উপর। এই সুযোগে মোহাম্মদ বিন সালমানও নিজের ক্ষমতা চর্চার পরিধি বৃদ্ধি করেছেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন নিজের ইচ্ছামতো, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করছেন সৌদির পররাষ্ট্রনীতিও। কিন্তু, এই কাজে কতটা সফল মোহাম্মদ বিন সালমান? বাদশাহ সালমানের প্রথা ভাঙার রাজনীতিতে কতটুকু উপকৃত হয়েছে সৌদি আরব?
ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মোহাম্মদ বিন সালমানের কাজকর্ম সমালোচনাই কুড়িয়েছে বেশি, বিভিন্ন সময়ে অস্থিতিশীল করে তুলেছে সৌদি আরবের রাজনীতিকে।
গোষ্ঠী প্রধানদের সাথে মোহাম্মদ বিন সালমানের সংঘাত
সৌদি আরবের বিস্তৃণ মরুভূমিতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরবরা, জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে এখনো টিকিয়ে রেখেছে সুদূর অতীতে গড়ে উঠা গোষ্ঠীতন্ত্র। একইরকম গোষ্ঠীতন্ত্র রয়েছে আমাদের নিকটবর্তী দেশ আফগানিস্তানেও। আফগানিস্তানের রাজনীতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে এই গোষ্ঠীগুলোর নেতৃবৃন্দ, সৌদি আরবের রাজনীতিতেও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে গোষ্ঠীর শেখেরা। সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ডের সিংহভাগ সদস্য আসে এই গোষ্ঠীগুলো থেকে, নিশ্চিত করে রাজপরিবারের নিরাপত্তা।
বাদশাহ আব্দুল্লাহর লিগ্যাসিকে মুছে দেওয়ার তাড়না থেকে আর রাজনীতিতে গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবকে সীমিত করতে শুরু থেকেই বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নেতৃত্বের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান মোহাম্মদ বিন সালমান। পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে দেয় মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে কয়েকজন গোষ্ঠী শেখকে গ্রেপ্তারের ঘটনা, উত্তপ্ত হয়ে উঠে রাজনীতি।
সৌদি আরবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যুতায়ার, আল-বুনান, ঘান্ধ, আনাজ্জাহ, বানি আউফ, বানি ইল্লালের মতো গোষ্ঠীগুলো। এরমধ্যে ম্যুতায়ার গোষ্ঠী ছড়িয়ে আছে কুয়েত আর কাতারেও, সৌদি আরবের বাইরে সাম্মারদের উপস্থিতি রয়েছে সিরিয়া আর ইরাকেও। ফলে, গোষ্ঠীগুলো চাইলে যেমন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে পারে, তেমনই প্রভাব রাখতে পারে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতেও। মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে গোষ্ঠীর শেখদের গ্রেপ্তারের ঘটনা তাই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করতে হয় খোদ বাদশাহ সালমান। মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে এরপর আর সরাসরি রাজনৈতিক সংঘাত হয়নি প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর, কিন্তু সম্পর্কের উন্নয়নের তেমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে শীতল সম্পর্ক
ইসলাম ধর্মের পূণ্যভূমি মক্কা আর মদিনা অবস্থিত সৌদি আরবে। এখানেই জন্ম হয় হযরত মুহাম্মদ (স.) এর, ইসলাম ধর্মের প্রচার আর প্রসারও শুরু হয় এই জায়গাগুলো থেকেই। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন সৌদি আরবের সংবিধান, কুরআন আর হাদিস মোতাবেক চলে সৌদি আরবের বিচারব্যবস্থা। সৌদি আরবের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সৌদির জনগণও ধারণ করেন রক্ষণশীলতাকে। সউদ রাজপরিবারের উত্থানের সাথেও জড়িয়ে আছে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই সউদ পরিবারকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আল-ওয়াহাব পরিবার, প্রভাবশালী এই পরিবার পরিচিত আল-শেখ নামেও। উলামাদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারস অনুমোদন করে সৌদি রাজপরিবারের উত্তরাধিকার, বাদশাহ তার কাজের নৈতিক বৈধতার জন্য দায়বদ্ধ থাকেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি।
মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই ধর্মীয় রক্ষণশীল অংশটিকে রাজনীতির কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এর পাশাপাশি, যুবরাজ বিন সালমানের সংস্কারমূলক কাজকর্ম দূরত্ব তৈরি করছে ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল অংশটির সাথে, ইতিবাচকভাবে নেয়নি মুভি থিয়েটার, উন্মুক্ত কনসার্ট আয়োজনের অনুমতি প্রদানের বিষয়টিও। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিন সালমানের ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠতার খবরগুলো, গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রভাবশালী কয়েকজন উলামা। ফলে, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সাথে সৌদির রক্ষণশীল অংশটির কাছেও অপ্রিয় হয়ে উঠছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
দুর্নীতি বিরোধী অভিযান ও হোটেল রিৎস-কার্লটন
ছোটবেলা থেকেই বেয়াড়া প্রিন্স হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান, কাজকর্মেও ছিলেন বেপরোয়া। অর্থের প্রতি তার মজ্জাগত লোভ প্রকাশ পেয়েছিল কৈশোরেই, স্বপ্ন দেখতেন সৌদি আরবের শীর্ষ ধনী আল-ওয়ালেদ বিন তালালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথেই সৌদি আরবের তেল রাজস্বের অসীম অর্থ উপভোগের সুযোগ পান মোহাম্মদ বিন সালমান, মেতে উঠেন ইয়ট, দূর্লভ পেইন্টিং আর প্রাসাদ কেনার নেশায়।
নভেম্বরে সৌদি আরবের রাজপরিবারের প্রভাবশালী অংশের বিরুদ্ধে কথিত দূর্নীতি অভিযান শুরু করেন মোহাম্মদ বিন সালমান, প্রায় দুই শতাধিক প্রিন্স, সাবেক মন্ত্রী আর ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে এনে রাখেন বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল রিৎস-কার্লটনে। অর্থের বিনিময়ে পরবর্তীতে ছেড়ে দেওয়া হতে থাকে এই বন্দীদের, রাজস্বে যোগ হয় কয়েকশো বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকদের ধারণা, সীমাহীন খরচের সংস্থান করতে আর রাজপরিবারের নিজের বিরোধী অংশটিকে স্তব্ধ করে দিতেই হয় এই কথিত দুর্নীতি বিরোধী অভিযান।
মোহাম্মদ বিন সালমানের সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, স্তব্ধ করতে সক্ষম হননি নিজের বিরোধী অংশটিকে। বরং, এই অভিযানের মাধ্যমে নতুন নতুন শত্রু তৈরি করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান, অনিশ্চিত করেছেন তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার
ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ কিছু সংস্কারপন্থী পদক্ষেপ নিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। চার দশক পর মুভি থিয়েটারগুলো সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, গানের কনসার্ট আয়োজনের আইনি অনুমতি দিয়েছেন, নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার সুযোগ। এরমধ্যে, মোহাম্মদ বিন সালমানের সবচেয়ে আলোচিত সংস্কারগুলোর একটি হলো নারীদের গাড়ী ড্রাইভিং করার অনুমতি দেওয়া। ২০১৮ সালে, ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার বছরখানেকের মধ্যে এই সংস্কার আনেন বিন সালমান।
নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়ার দাবিতে মানবাধিকার কর্মীদের একটি অংশ কয়েক দশক ধরেই কাজ করছেন। নারীদের গাড়ী চালানোর আইনি অনুমতি দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে এ রকম ডজনখানেক মানবাধিকার কর্মীকে আটক করা হয় মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি যথাসময়েই এসেছে, কিন্তু এই অধিকারকর্মীদের অধিকাংশই এখনো জেলে বন্দি।
গত শতাব্দী থেকেই রাজপরিবার আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে মোটামুটি সব ইস্যুতে সমালোচনা করতে পারতেন অধিকারকর্মীরা। সৌদি আরবে এই দুটি বিষয় ছিল সমালোচকদের জন্য রেড-লাইন। শাসকদল আর অধিকার কর্মীদের এক অলিখিত সামাজিক চুক্তিও বলা যায় এই সমঝোতাকে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের সময়ে এই সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়েছে। সৌদি আরবে এখন যেকোনো ধরনের সমালোচনাকে কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছে, নির্বিচারে বন্দী করা হচ্ছে অধিকার কর্মীদের। রাজপরিবার আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড়িয়ে রেড-লাইন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে নারী অধিকার কর্মীদের, রাজনৈতিক সংস্কারপন্থীদের, সংখ্যালঘুদের করা হচ্ছে বৈষম্য, দেশের বাইরেও চলছে মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে নির্বিচার আক্রমণ।
এর প্রভাব পড়েছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সংখ্যাতেও। বাদশাহ আব্দুল্লাহর শাসনামলের সর্বশেষ বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো ৯০ জনের। বাদশাহ সালমানের প্রথম বছরেই এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ১৫৮ জন মানুষের। পরের কয়েক বছরেও এই সংখ্যা কমেনি, বরং, ধারাবিক বৃদ্ধিতে ২০১৯ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ১৮৪ জন মানুষের। যুবরাজ বিন সালমানের নির্দেশে বেশ কয়েকজন প্রিন্স আর অধিকারকর্মী গুম হয়েছনে, সেগুলো এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অভিযোগ আছে, মোহাম্মদ বিন সালমান বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে, যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আটকে দিতে। সংখ্যালঘুদের দমনেও প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে বিন সালমানের সময়কালে। ২০১৯ সালে এপ্রিলে একসাথে ৩৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় সৌদি আরবে। এদের মধ্যে ৩২ জনই সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের, যাদের মধ্যে আবার তিনজনের বয়স ১৮ এর বুচে। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আবদুল কারিম আর-হাওয়াজের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
২০২০ সালে সৌদি আরবে আবারো একসাথে ৮ জনের প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এদের সবাই তাদের কৈশোরে, ১৪-১৭ বছর বয়সকালে, আরব বসন্তের প্রভাব পড়া অন্যান্য দেশের মতো মিছিল করতে বের হয়েছিলেন। অর্ধযুগ পরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়, রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কাজকর্মের জন্য দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তৎপরতায় সে যাত্রায় বেঁচে যান সদ্য কৈশোর পেরোন সেই যুবকেরা।
আরামকো তেলকূপে হুতিদের হামলা
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পরেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো আছে যুবরাজ বিন সালমানের অধীনেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল আরামকোর তেলকূপে হুতিদের চালানো মিসাইল হামলা এবং তেল উৎপাদনে ধ্বস নামা।
মোহাম্মদ বিন সালমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে লাফিয়ে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয়, হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ অস্ত্র ক্রেতা দেশ। সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি, এসেছে নতুন এটাক হেলিকাপ্টার আর ফাইটার জেট। এতকিছুর পরও আরামকো তেলক্ষেত্রে হুতিদের হামলার পর প্রশ্নের মুখে পড়ে মোহাম্মদ বিন সালমানের দক্ষতা, প্রশ্নের মুখে পড়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারটি।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোহাম্মদ বিন সালমানের ভবিষ্যৎ
অর্ধুযুগের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে রাজনৈতিক অপরিপক্কতার ছাপ মোহাম্মদ বিন সালমান তার প্রতিটি কাজে রেখে যাচ্ছেন, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তৈরি করছেন নিজের শত্রু। একদিকে বিন সালমান নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিচ্ছেন, আরেকদিকে গ্রেপ্তার করছেন গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করা অধিকারকর্মীদের। সংখ্যালঘু শিয়াদের নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন, লড়াই করছেন সেক্যুলারদের সঙ্গে, একই সময়ে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে। কঠোর হাতে দমন করছেন রাজনৈতিক সংস্কারপন্থীদের, আবার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন বিরাজমান রাজনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর সঙ্গে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের এই স্ববিরোধিতা আর খেয়ালিপনা নিশ্চিতভাবেই অস্থিতিশীল রাখবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে। বাদশাল সালমানের মৃত্যুর পর যুবরাজ বিন সালমানেরই বাদশাহ হওয়ার কথা। কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমান কি বাদশাহ হওয়ার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখাতে পেরেছেন? রক্ষণশীল সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে স্থিতিশীলতা দেওয়ার সক্ষমতা কি আছে এই ক্রাউন প্রিন্সের?