ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ পরিষ্কার হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়েই, নীতিগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে গড়ে তোলেন প্রাতিষ্ঠানিক আর অনানুষ্ঠানিক কিছু কাঠামো। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসা জো বাইডেন তার পূর্বসূরির অনেক নীতিই বদলে দিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, ইরানের সাথে ছয় জাতির চুক্তির মতো কিছু ক্ষেত্রে নিয়েছেন সম্পূর্ণ বিপরীত পদক্ষেপ। কিন্তু, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে ট্রাম্পের নীতির তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, চীনের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি অনুসরণ করছেন ট্রাম্পকে।
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজি
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের স্ট্রাটিজিক ফ্রেমওয়ার্ক বেরিয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই, যেটির নাম ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজি। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থকে ব্যাখ্যা করেছে। ইএ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রুখতে আঞ্চলিক মিত্রদের সাথে কীভাবে কাজ করবে, সেই রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজির মাধ্যমে এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে, নির্ভরযোগ্য মিত্র গড়ে তোলার মাধ্যমে এই অঞ্চলের বাণিজ্যে নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণের, চীন আর উত্তর কোরিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর হুমকি থেকে নিজের মিত্রদের রক্ষা করতে।
পাশাপাশি, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে উত্তর কোরিয়ার উপর সর্বোচ্চ চাপ তৈরি করতে, যাতে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হামলার মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র না হয়, উত্তর কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র যাতে নন-স্টেট এক্টরদের হাতে ছড়িয়ে না যায়।
সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে মিত্রদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ‘মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ গড়ে তুলতে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সক্ষম হবে, দেশগুলোর ফ্রিডম অব নেভিগেশন থাকবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্ট্যান্ডার্ড পলিসি থাকবে, সামরিক বাহিনীর কার্যক্রমে থাকবে জবাবদিহিতা। পাশাপাশি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সন্ত্রাসী হুমকিগুলো নির্মূলে সক্ষম হবে, সক্ষম হবে চীনের প্রভাব এড়িয়ে যাওয়ায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নিরাপত্তা আর ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে এই দেশগুলোর সরকার আর সিভিল সোসাইটিও। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে, আসিয়ানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শের ভিত্তিতে সমঝোতা বাড়াতে।
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজিতে ভারত
এ স্ট্রাটিজিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আখ্যায়িত করেছে ‘প্রধান প্রতিরক্ষা সহযোগী’ হিসেবে, তুলে ধরা হয়েছে ভারতের সাথে সম্পর্কের কৌশলগত সুবিধাগুলো সম্পর্কে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, দক্ষিণ এশিয়াতে নিরাপত্তা সহযোগী ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র হয়ে উঠুক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও ভারতের প্রভাব বিস্তারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা হচ্ছে, জরুরি প্রয়োজনের সময় ভারতীয় সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের সাথে সমন্বয় করতে পারবে, সমন্বয় করতে পারবে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে।
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজি নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় হোয়াইট হাউজের এক সিনিয়র কর্মকর্তা ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে বলছিলেন, “ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়াতে, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জগুলো কাজে লাগানোর জন্য, আমাদের মিত্রদের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে সমন্বয়। যোগাযোগ এবং সমন্বয় হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিয়ে, পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার কর্তৃত্ববাদী ও অনুদার চরিত্র নিয়ে, পরবর্তী মহামারি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়ে কিংবা বর্তমান মহামারি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়, সেটি নিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় ভারতের ভূমিকা খুবই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
সামরিক সমঝোতা বৃদ্ধি
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল, এখানকার ৩৮টি দেশে বসবাস করে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে, চীন আর ভারতেই রয়েছে সিংহভাগ মানুষ। দুইদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২.৭ বিলিয়ন, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।
জনসংখ্যার দিক থেকে ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে, জনসংখ্যার মতো ভারতের রয়েছে বিশাল এক সামরিক বাহিনী। ভারতের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় মিলিয়ন, রিজার্ভ বাহিনী আছে আরো ১.১ মিলিয়ন। দুই মিলিয়ন সক্রিয় সদস্যের চীনা সামরিক বাহিনীর প্রভার রুখতে, আঞ্চলিক মিত্রদের রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াবে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজিতে ভারতের সাথে বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাণিজ্য, ভারত পাবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশিল্পের সর্বশেষ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের সুযোগ।
ভারতের সাথে চীনের দীর্ঘ সীমান্ত আছে, সংঘাতপ্রবণ সীমান্ত আছে পাকিস্তানের সাথেও। বর্তমান সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে কাজ করছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সাথে লাইন অব কন্ট্রোলে নিয়মিত সংঘাতের পাশাপাশি ২০২০ সালে গালওয়ান ভ্যালিতে চীনের সাথে সংঘর্ষে ভারতকে হারাতে হয়েছে ২০ জন সৈন্য। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জায়গা থেকে একই ধরনের সংকটে আছে, আছে একই ধরনের প্রতিপক্ষের মুখে। এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার ধারণায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে আরো কাছে আনবে।
কূটনৈতিক সমঝোতা
ভারতীয় মহাসাগরে ভারত আর যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের দর্শন অনুসরণ করে, মিল আছে প্রশান্ত মহাসাগরকেন্দ্রিক ভাবনার ব্যাপারেও। যুক্তরাষ্ট্র যে ‘মুক্ত ও উদার ইন্দো-প্যাসিফিক’ নির্মাণ করতে চাইছে, তার অন্যতম উপকারভোগী হবে ভারত, বাঁধাহীন বাণিজ্যের নিশ্চয়তা পেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের কাছে চীনের একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে ভারত। পাশাপাশি, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মতো অবকাঠামোগত খাতে ঋণের ব্যাপারে জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে সীমান্ত সংক্রান্ত সংঘাতের সমাধান সংলাপের মাধ্যমে হওয়ার ধারণায়। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একই ধরনের দর্শন দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতা বাড়াবে, আঞ্চলিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে একই ধরনের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।
ট্রাম্পের সময়েই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু হয়, হয় ‘টু প্লাস টু’ শিরোনামে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলন। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের মধ্যে বৈঠক হয়েছে, এগিয়েছে কূটনৈতিক সমঝোতা।
সাইবার ও মহাকাশ নিরাপত্তা
সময়ের সাথে যুদ্ধের প্রকৃতি বদলায়, একসময় যুদ্ধের প্রধান অনুষঙ্গ যেখানে ছিলো ঢাল-তলোয়ার, বর্তমান সময়ে সেই জায়গা দখল করেছে রাইফেল, বন্দুক আর কামানের মতো অস্ত্র। গত শতাব্দীতে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আকাশ, তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধবিমান। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যুদ্ধক্ষেত্রে আরেকটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, যুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের পাশাপাশি নতুন যুদ্ধফ্রন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মহাকাশ। এর পাশাপাশি নিয়মিতই এক দেশ সাইবার হামলা চালাছে অন্যদেশে, বদলে দিচ্ছে রাজনৈতিক সমীকরণ।
প্রতিনিয়তই সাইবার নিরাপত্তার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, একইভাবে সাইবার অপরাধ ঘটছে ভারতেও। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাইবার অপরাধ দমনে দুই দেশ একসাথে কাজ করবে, একসাথে কাজ করবে মহাকাশ নিরাপত্তাতেও।
সন্ত্রাসবাদ দমন
দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি, এখানেই ঘটে সন্ত্রাসবাদের বেশিরভাগ ঘটনা। ওয়ার্ল্ড টেরোরিজম ইনডেক্সে ১ নাম্বার অবস্থানে আছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান আছে ৭ম অবস্থানে। ভারতেও নিয়মিতই ঘটে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা, ওয়ার্ল্ড টেরোরিজম ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান ৮ম। গত কয়েক বছর ধরেই এই দেশগুলো ওয়ার্ল্ড টেরোরিজম ইনডেক্সে কাছাকাছি অবস্থানে ঘোরাফেরা করছে। একইভাবে, সন্ত্রাসবাদ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও চ্যালেঞ্জ, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দুই দশকে ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজিতে সন্ত্রাসবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সহযোগিতার কোন রূপরেখা নেই। তবে, দুই দেশ নিজেদের মধ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করবে, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান থাকবে। ভারতে যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো রয়েছে, তারা আরো সংকুচিত অবস্থানে চলে যাবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
চীনকে মোকাবেলা
অবধারিতভাবেই, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজির মূল লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে মোকাবেলা করা, চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা, বৈশ্বিকভাবে চিনের কর্তৃত্ববাদী মডেলের বিস্তার আটকানো। এরমধ্যেও, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজিতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ব্যাপারে ধোঁয়াশাপূর্ণ কিছু অবস্থান নিয়েছে। যেমন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটিজিতে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, “পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার কাঠামোকে বদলে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য না, আমাদের লক্ষ্য কৌশলগত পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে আমাদের নিজেদের, আমাদের মিত্র ও সহযোগীদের স্বার্থকে রক্ষা করা।” আবার, “চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র সেসব জায়গায় সহযোগিতা করবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা হবে, প্রেসিডেন্টের ভিশন অনুযায়ী একটি গঠনমূলক, ফলাফলনির্ভর সম্পর্ক গড়ে তুলবে।”
তবে, চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বেশ সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনকে মোকাবেলায় প্রধান প্রতিরক্ষা সহযোগী হিসেবে ভারতের উপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতকে গড়ে তুলতে চাইছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক নেতা হিসেবে।