সম্প্রতি ফাঁস হওয়া প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার গোপন ইরানি ডকুমেন্টের উপর সংবাদ মাধ্যম ইন্টারসেপ্ট পাঁচ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে ইরাকে ইরানের রহস্যময় ভূমিকার অনেক গোপন তথ্য। ইন্টারসেপ্টের এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের এই “ইরান ক্যাবল” সিরিজ। আজ পড়ুন সিরিজের চতুর্থ পর্ব। পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের শুরু থেকেই ইরান নিজেকে ইরাকের শিয়া জনগোষ্ঠীর রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে। আর শিয়াদের ক্ষমতাকে ঊর্ধ্বমুখী রাখার জন্য অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি এসপিওনাজ জগতের কালো কলাকৌশল এবং গোপন সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডের অভিজাত কুদস ফোর্সের কমান্ডার, মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি।
ইরাকে শিয়াদের ক্ষমতা নিশ্চিত করার কাজে সোলায়মানি সফল হয়েছেন। কিন্তু শিয়াদের এই ক্ষমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে ইরাকের স্থিতিশীলতাকে বলি দিয়ে। তার বাহিনীর বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আজীবনের জন্য নিজেদেরকে বঞ্চিত অনুভব করা সুন্নিদের অনেকে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য ঝুঁকে পড়েছে ইসলামিক স্টেটসহ অন্যান্য উগ্রপন্থী গ্রুপগুলোর প্রতি।
২০১৪ সালে ইরাকের জুরফ আল-সাখার এলাকার কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের সুন্নিদের উপর চালানো গণহত্যা হচ্ছে সোলায়মানির নেতৃত্বাধীন কুদস ফোর্সের অধীনস্থ বাহিনীগুলো দ্বারা সংঘটিত সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার প্রকৃষ্ট উদাহরণগুলোর একটি, যে সহিংস ঘটনাগুলো আমেরিকানদেরকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল এবং ইরাকে যেকোনো ধরনের সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
ফাঁস হওয়া গোপন রিপোর্টগুলো থেকে দেখা যায়, ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সও আমেরিকানদের মতোই এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এবং এই রিপোর্টগুলো থেকে এটাও দেখা যায়, ইরাক নীতি নিয়ে ইরানের ভেতর প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির অধীনস্থ অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী সরকারি অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাথে রেভোল্যুশনারি গার্ডদের অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক অংশগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিভাজন বিরাজ করছিল।
কমলা গাছ এবং খেজুর বাগানে পরিপূর্ণ জুরফ আল-সাখার এলাকাটার অবস্থান ফোরাত নদীর উপত্যকায়, ফাল্লুজা শহরের ঠিক পূর্বে। ২০১৪ সালে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট এলাকাটা দখল করে নেয়। এর দখল তাদেরকে শিয়াদের পবিত্র শহর কারবালা এবং নাজাফে আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য ঘাঁটি নির্মাণের সুযোগ করে দেয়।
জুরফ আল-সাখার ইরানের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এটা এমন জায়গায় অবস্থিত ছিল যে, পবিত্র মুহররম মাসে ধর্মপ্রাণ শিয়ারা মাসব্যাপী ইমাম হোসেনের শাহাদাত বরণকে উদযাপন করার জন্য কারবালা গমনের পথে এর উপর দিয়েই যায়।
২০১৪ সালের শেষের দিকে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা যখন জুরফ আল-সাখার থেকে আইএসদেরকে পরাজিত করে বিতাড়িত করে, তখন সেটা ছিল আইএসের বিরুদ্ধে কোনো বাহিনীর প্রথম বড় ধরনের বিজয়। কিন্তু যুদ্ধের পর শহরটা পরিণত হয় ভূতুড়ে শহরে। আইএসদের পরাজয়ের পর এলাকাটা হাজার হাজার শিয়া তীর্থযাত্রীর জন্য আর কোনো হুমকি ছিল না, কিন্তু তারপরেও শহরটার সুন্নি অধিবাসীদেরকে কঠোর মূল্য দিতে হয়। হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়, এবং একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদ, যিনি ছিলেন প্রাদেশিক কাউন্সিলের একমাত্র সুন্নি সদস্য, তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
জুরফ আল-সাখারের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সের একটা রিপোর্টে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, সেটা বাইবেলের প্রতিশোধমূলক বর্ণনাগুলোর সাথেই তুলনীয়। ইরাক থেকে পাঠানো ঐ রিপোর্টে ইরানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা বর্ণনা করেন, “এই অপারেশনগুলোর মাধ্যমে জুরফ আল-সাখারের আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে সন্ত্রাসীদের দালালদেরকে নির্মূল করা হয়েছে। তাদের পরিবারদেরকে বাড়িগুলো থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ বাড়ি সামরিক বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে, বাকিগুলোও ধ্বংস করা হবে। কিছু কিছু স্থানে খেজুর গাছগুলো সমূলে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সেগুলোকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন সন্ত্রাসীরা গাছগুলোর নিচে আশ্রয় নিতে না পারে। মানুষের গবাদি পশুগুলো (গরু এবং ভেড়া) তাদের মালিকদেরকে ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে চরে বেড়াচ্ছে।”
রিপোর্টে বলা হয়, জুরফ আল-সাখারের অপারেশন এবং তেহরানের নির্দেশে ইরানের প্রক্সিদের দ্বারা সংঘটিত এই জাতীয় অন্যান্য রক্তাক্ত পদক্ষেপ ইরানের সুন্নি জনগণকে আরো শত্রুভাবাপন্ন করে তুলছে। সেখানে বলা হয়, “গ্রাম এবং বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া, সুন্নিদের ধন-সম্পত্তি ও গবাদি পশু লুট করার ঘটনাগুলো আইএসবিরোধী যুদ্ধে সাফল্যের মাধুর্য নষ্ট করে সেটাকে তিক্ততায় রূপান্তরিত করছে।”
জুরফ আল-সাখার থেকে পাঠানো একটা রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে শিয়া মিলিশিয়াদের কর্মকাণ্ডের প্রভাব উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়, “প্রতিটা এলাকায় যেখানে (ইরানের দ্বারা পরিচালিত প্রধান শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী) পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্স অভিযান চালাতে গিয়েছে, সেখানকার সুন্নিরা তাদের বাড়িঘর এবং ধন-সম্পত্তি ফেলে পালিয়ে গিয়ে তাঁবুতে অথবা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করাকে বেছে নিয়েছে।”
মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সের বার্তাগুলো থেকে দেখা যায় তারা আশঙ্কা করছিল, ইরাকে ইরানের সকল অর্জন হয়তো ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। কারণ তারা ইরাকিদের মধ্যে শিয়া মিলিশিয়াদের এবং তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা কুদস ফোর্সের প্রতি তীব্র ঘৃণা লক্ষ্য করছিল। তারচেয়েও বড় কথা, মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তারা এসব ঘটনার জন্য সরাসরি কাসেম সোলায়মানিকে দায়ী করছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, সোলায়মানি তার আইএসবিরোধী যুদ্ধকে নিজের প্রচারণায় কাজে লাগাচ্ছিলেন দেশে ফিরে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার প্রস্তুতিমূলক ক্ষেত্র হিসেবে।
একটা রিপোর্টের উপরে লেখা ছিল, সেটা কুদস ফোর্সের কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। সেই রিপোর্টের ভেতরে ব্যক্তিগতভাবে সোলায়মানির সমালোচনা করা হয় এই বলে যে, সোলায়মানি নিজের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধে নিজের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার প্রচার চালাচ্ছেন। রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, এর মাধ্যমে সোলায়মানি তার শত্রুদের কাছে এটা পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন যে, ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াগুলো মূলত ইরানই নিয়ন্ত্রণ করে।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, “ইরাকে ইরানের নীতি আমেরিকানদেরকে আগের চেয়েও বেশি বৈধতা নিয়ে ইরাকে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। এবং সুন্নিদের মধ্যে যেসব ব্যক্তি এবং দল আগে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, তারা এখন চাইছে শুধু আমেরিকা না, ইসরায়েলও ইরাকে প্রবেশ করে ইরানের থাবা থেকে ইরাককে রক্ষা করুক।”
একটা সময় ইরানিরা ইরাকে নিজেদের উপস্থিতি যে বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল, সেটা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তাদের এই প্রচেষ্টা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে আমেরিকার “হার্টস অ্যান্ড মাইন্ডস” জয় করার প্রচেষ্টার মতোই। তারা আশা করছিল এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ভালো কাজগুলোর প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাবে এবং নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
একটা রিপোর্ট অনুযায়ী ইরাকের উত্তরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইরান শিশুরোগ ও নারীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত আসলেই বাস্তবায়িত হয়েছিল কি না, রিপোর্টগুলো থেকে সেটা জানা যায় না।
রিপোর্টগুলো থেকে জানা যায়, ইরান বরাবরের মতোই নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ইরাকের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের চুক্তি হাসিল করে যাচ্ছিল। একটা রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ইরানের উপর ইরাকের নির্ভরতাকে পুঁজি করে অস্ত্র এবং অন্যান্য সাহায্য দেওয়ার বিনিময়ে ইরানের কুদস ফোর্স ইরাকের কুর্দিদের কাছ থেকে তেল এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পের চুক্তি আদায় করে নিয়েছিল। আরেকটা রিপোর্ট অনুযায়ী ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের এক পার্লামেন্ট সদস্যকে ১৬ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়ে ইরান ঐ এলাকার নর্দমার পানি পরিশোধনের একটা চুক্তি বাগিয়ে নিয়েছিল।
এই মুহূর্তে ইরাকে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ইরানকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, ঠিক যেরকম আমেরিকাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের পর। অন্যদিকে ইরাকি কর্মকর্তারা ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন যে, ইরাকে যেকোনো এক পক্ষের একটু উস্কানিই তাদের দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। আর সাধারণ ইরাকিরা অনেক আগেই ইরানি গুপ্তচরদের কর্মকাণ্ডের সাথে বাস্তববাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে মানিয়ে চলতে শিখেছিল, এমনকি ইরানকে শত্রু মনে করা সুন্নি ইরাকিরাও।
এক সময় সাদ্দাম হোসেনের গোয়েন্দাবিভাগে এবং পরবর্তীতে সিআইএর হয়ে কাজ করা এক ইরাকিকে নিজেদের গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করা এক ইরানি কেস অফিসারের রিপোর্টে ইরানিদের এবং শিয়া ইরাকিদের ক্ষমতার সামনে সুন্নিদের এই অসহায়ত্বের চিত্রটা ফুটে ওঠে। ২০১৪ সালের শেষের দিকে পাঠানো ঐ রিপোর্টে ঐ কর্মকর্তা লিখেছিলেন, “সে যে শুধুমাত্র ইরানকে অবিশ্বাস করে, তা-ই না, সে এটাও বিশ্বাস করে না যে ইরাকে ইরানের ভালো কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু তারপরেও সে একজন পেশাদার গুপ্তচর এবং ইরাকে শিয়াদের এবং ইরানের বাস্তবতা সম্পর্কে তার ধারণা আছে। কাজেই নিজেকে রক্ষা করার জন্য সে আমাদের হয়েই কাজ করবে।”
মূল প্রতিবেদক: জেমস রাইজেন, টিম আরাঙ্গো, ফারনাজ ফাসিহি, মুর্তজা হাসান, রোনেন বার্গম্যান
প্রকাশের তারিখ: ১৮ নভেম্বর, ২০১৯
আগামী পর্বে থাকছে ইরানের আইএসবিরোধী যুদ্ধের কথা এবং এই যুদ্ধে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে বন্ধুত্বের কথা।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/