যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে জ্বালানি নিরাপত্তার ধারণা, থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক হিজিমন টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। মধ্যপ্রাচ্য তাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রায়োরিটি লিস্টে সবসময় উপরে থেকেছে, মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী। অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বেশি সম্পদ আর জনবল বিনিয়োগ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সেনা পাঠিয়েছে যুদ্ধ কিংবা অন্য প্রয়োজনে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা তাই প্রথম সফর করেন মধ্যপ্রাচ্যেই, মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন। অ্যাপ্রুভাল রেটিং নিয়ে সংকটে থাকা জর্জ ডব্লিউ বুশকে যেমন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করতে সহযোগিতা করেছে ইরাক আর আফগানিস্তান যুদ্ধ, বারাক ওবামার অ্যাপ্রুভাল রেটিং বাড়িয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত করতে সহযোগিতা করেছে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মিশন। ডোনাল্ড ট্রাম্পও একই পথে হেঁটেছিলেন; ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানি আর আইএসের প্রধান বাগদাদিকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে একই রকম সংকটে আছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, মাত্র ২৪ শতাংশ ডেমোক্রেট বাইডেনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান, ৬৪ শতাংশ চান নতুন কাউকে। গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বেকায়দায় আছে ডেমোক্রেটিক পার্টিও। বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির অবস্থাও বেহাল হয়ে আছে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে জীবনধারণের খরচ। তেলের বাজারে যোগান স্বল্পতার কারণে তৈরি হয়েছে অস্থিতিশীলতা, যার প্রভাব পড়েছে পৃথিবীজুড়ে ছোট-বড় সকল অর্থনীতিতে। এমনই এক সংকটময় মুহূর্তে জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফর আয়োজন করেছে হোয়াইট হাউজ, যাতে গন্তব্যস্থল ছিল ইসরায়েল আর সৌদি আরব।
বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের লক্ষ্য
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময় পরেজো বাইডেন প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছেন, চারদিনের সফরে ইসরায়েল থেকে গিয়েছেন সৌদি আরবে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন গিয়েছিলেন মূলত তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
প্রথমত, ইউক্রেন আর রাশিয়ার মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকেই টালমাটাল করে দিয়েছে, যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক জ্বালানীর বাজারে। জীবাশ্ম জ্বালানীর উর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম, বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। এই সংকটকে সামাল দিতে প্রয়োজন তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরের মাধ্যমে চাচ্ছিলেন তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে গালফ স্টেটগুলোকে রাজি করাতে।
দ্বিতীয়ত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় আরবের নেতারা হোয়াইট হাউজে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছেন, ট্রাম্পের পরামর্শকদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এমবিএস আর এমবিজেডের। তবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি বাড়তে থাকে, তৈরি হতে থাকে নেতৃত্বের ভ্যাকুয়াম। এই ভ্যাকুয়াম যাতে চীন বা রাশিয়ার মাধ্যমেও পূর্ণ না হয়, যুক্তরাষ্ট্রই আবার তার অবস্থানে ফিরে আসতে পারে, সেটিও ছিল বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের এজেন্ডাতে।
তৃতীয়ত, গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ইরানের উপস্থিতি, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইরান আবির্ভূত হয়েছে প্রধান হুমকি হিসেবে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। গোয়েন্দাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আর ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ইরানের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত জোট গঠন করাও ছিল বাইডেনের এজেন্ডাতে।
জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সালতামামী
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরে জো বাইডেন ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, ইসরায়েল থেকে সৌদি আরবে এসে সাক্ষাৎ করেছেন বাদশাহ সালমান ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে। রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সফরের সালতামামীর উপর নির্ভর করছে বাইডেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, কারণ ইতোমধ্যেই পার্টি আর প্রশাসন নিয়ে ব্যাপক চাপের মধ্যে আছেন বাইডেন।
ইসরায়েলপন্থী অবস্থান
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো ইসরায়েল দিয়ে সফর শুরু না করার ভুল জো বাইডেন করেননি, করেননি ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্য সফরে অন্তর্ভুক্ত না করার ভুলও। বরং, ইসরায়েল সফরে গিয়ে জো বাইডেন নিজেকে আবারও জায়োনিস্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, ইসরায়েলের অবৈধ স্থাপনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি, প্রশ্ন তোলেননি সম্প্রতি আলোচিত ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা নিয়েও। বরং, ইসরায়েলের নিরাপত্তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার সম্পর্ক তুলে ধরে জো বাইডেন নিশ্চুপ থেকেছেন ফিলিস্তিনিদের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে। সান্ত্বনা হিসেবে ফিলিস্তিনিদের দিয়ে এসেছেন ১০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা, দেননি পূর্ব জেরুজালেমে আমেরিকার কনস্যুলেট পুনরায় খোলার ঘোষণাও।
এর মধ্যে, আব্রাহাম অ্যাকর্ডকে এগিয়ে নেওয়ার বাসনায় জো বাইডেন চেষ্টা করেছেন সৌদি আরব আর ইসরায়েলের দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে। সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলেও সৌদি আরব সকল ধরনের এয়ারলাইন্সের উপর থেকে নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ইসরায়েলের এয়ারলাইন্সগুলোও। সৌদি আরব একে বাণিজ্যিক পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিড একে দেখছেন সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সূচনা হিসেবে।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের আমন্ত্রণে জো বাইডেনের এই মধ্যপ্রাচ্য সফর। তবে, বেনেটের জায়গায় বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন ইয়ার লাপিড, যিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সফরকে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উত্থানের কাজে ব্যবহার করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। সেদিক থেকে, ইসরায়েলের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাভবান হলেও, দৃশ্যমান কোনো লাভ জো বাইডেনের হয়নি।
তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি
বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরকে রাজনৈতিক ঝুঁকি বলা হচ্ছে, কারণ মধ্যপ্রাচ্য সফরে এসে বাইডেনকে দেখা করতে হয়েছে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে হোয়াইট হাউজে অবাধ যাতায়াত থাকা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান গত দেড় বছর ধরে ছিলেন অনেকটা একঘরে হয়ে, বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জামাল খাসোগজি হত্যায় মোহাম্মদ বিন সালমানকে জবাবদিহিতার আনার ব্যাপারে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইয়েমেনে সৌদি আরবের যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরের এজেন্ডাতে এর কোনোটাই উপরের দিকে ছিল না। বরং, তার সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি চুক্তিতে আসা, যেটি চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে সামাল দিতে সহযোগিতা করবে। তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারেননি সৌদি আরবের কাছ থেকে। এই ব্যাপারে সৌদি আরবের দিক থেকে বলা হয়েছে, সৌদি আরব ২০২৭ সাল নাগাদ দৈনিক তেলের উৎপাদন ১৩ লাখ ব্যারেল করতে চায়। বর্তমানে সৌদি দৈনিক ১০.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল প্রতিদিন উৎপাদন করে, যার সাথে আরো ১ মিলিয়ন উৎপাদন করে লিকুইড গ্যাস। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌদি আরবের বর্তমানেই প্রতিদিন ১৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদনের সক্ষমতা আছে।
পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহারের জন্য ৫ বছরের অপেক্ষা? জেদ্দার রাজপ্রাসাদের বাইরে অপেক্ষমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছেন, তার তুলনায় এটি কিছুই না।
ইরানের বিরুদ্ধে কৌশলগত জোট
মধ্যপ্রাচ্যে গত এক দশকে নিজেদের অবস্থান ব্যাপকভাবে জানান দিয়েছে ইরান, ইসরায়েল জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে হুমকি হয়ে ওঠার পাশাপাশি ইরান হুমকি হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থেরও। মধ্যপ্রাচ্যে চীন আর রাশিয়া যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে, তার গেটওয়েও তৈরি করে দিচ্ছে ইরানই, দুই দেশের সাথে ইরানের আছে উষ্ণ সম্পর্ক। ফলে, মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই চার জাতির একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। ‘আই২ইউ২’ নামের এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইরানকে মোকাবেলা আর রুশ-চাইনিজ প্রভাব মোকাবেলায় সৌদি আরবের সাথে একটি কৌশলগত পরিকল্পনা চাচ্ছিল বাইডেন প্রশাসন। আপাতদৃষ্টিতে, সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। ইরান আক্রমণ করলে সৌদি আরবকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এগিয়ে আসবে কিনা, বাইডেন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি সৌদি আরবের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। একই কারণে, ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকেও সৌদি আরবকে বের হয়ে আসার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারেননি।
বাইডেনের রাজনৈতিক ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্য সফর থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে আহামরি কিছু অর্জন করতে পারবেন না, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেই পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিলেন। এরপরও, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিষয়টিকে মাথায় রেখে জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছেন, একঘরে করে রাখা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। ইতোমধ্যেই ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া আর সর্বনিম্ন অ্যাপ্রুভাল রেটিং থাকা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এই রাজনৈতিক ঝুঁকি আপাতত বুমেরাং হয়েছে। ইসরায়েল আর সৌদি আরবের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থ বুঝে নিয়েছেন, বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিছুই আদায় করতে পারেননি।