জামাল খাশোগজি একসময় সৌদি রাজপরিবারের অনুগত ছিলেন। একেবারে প্রথমদিকে তিনি ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের অভিযান সমর্থন করেছিলেন। সৌদি আরব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি অন্য সমালোচকদের মতো অযৌক্তিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সমালোচনা করেননি। তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকেও সমর্থন করেছিলেন। এমনকি তিনি বিন সালমানের ভিশন ২০/৩০ প্রকল্পের অধীনে গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কার, তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতিকে বহুমুখী করার নীতিকেও সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও জনগণের অধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য তিনি সৌদি সরকারের যতটুকু সমালোচনা করেছিলেন, সেটাই তার কাল হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরেই তার উপর হুমকি ছিল, টুইটারে তাকে একের পর এক হুমকি দিয়ে আসছিল সৌদি প্রশাসনের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা। নিজের জীবনের নিরাপত্তার অভাবও বোধ করছিলেন তিনি। এবং গত ২ অক্টোবর, তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কন্সুলেটে প্রবেশ করার পরই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। তার কন্সুলেটে প্রবেশ করার ভিডিও আছে, কিন্তু বের হওয়ার কোনো ভিডিও নেই। তুরস্ক অভিযোগ করেছে এবং যৌক্তিকভাবেই মনে হচ্ছে, সম্ভবত সৌদি আরবের কন্সুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে জামাল খাশোগজিকে। সৌদি আরব যেকোনো ধরনের সমালোচনাই সহ্য করে না, তার প্রমাণ গত এক বছর ধরে বিভিন্নভাবেই পাওয়া গেছে, কিন্তু এবারের ঘটনাটি অতীতের যেকোনো ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে।
কে এই জামাল খাশোগজি?
জামাল খাশোগজির জন্ম ১৯৫৮ সালে সৌদি আরবের মদিনায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা শেষ করে তিনি আশির দশকে দেশে ফিরে যান এবং সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। দীর্ঘ কয়েক দশকের সাংবাদিকতার জীবনে তিনি আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কভার করেন। তিনি একাধিকবার ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেন।
১৯৯৯ সালে জামাল খাশোগজি সৌদি আরবের ইংরেজি পত্রিকা আরব নিউজে উপসম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে তিনি আল-ওয়াতান পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু সৌদি সরকারের প্রতি অনুগত ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করায় বহিষ্কৃত হন। তবে তার সাথে সৌদি রাজপরিবারের সুসম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আল-ওয়াতান থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি প্রথমে লন্ডনে এবং পরবর্তীতে ওয়াশিংটনে যান এবং সেখানকার সৌদি রাষ্ট্রদূত ও সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের মিডিয়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন।
“Saudi Arabia wasn’t always this repressive. Now it’s unbearable.” The first opinion piece published by #JamalKhasoggi on the Wapo, over one year ago. The Saudi dissident journalist has gone missing after entering the Saudi consulate in Istanbul. https://t.co/9Py2sF5Hg4
— Michele Barbero (@MicheleBarbero) October 4, 2018
২০০৭ সালে জামাল খাশোগজি সৌদি আরবে ফিরে এসে আবারও আল-ওয়াতানের দায়িত্ব নেন, কিন্তু বিতর্কে জড়িয়ে তিন বছর পর আবারও সেখান থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালে কাতারের আল-জাজিরার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সৌদি আরব বাহরাইন ভিত্তিক আল-আরব নিউজ চ্যানেল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং জামাল খাশোগজিকে এর দায়িত্ব দেয়। কিন্তু ২০১৫ সালে চালু হওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই বাহরাইনের এক বিরোধী দলীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর অভিযোগে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জামাল খাশোগজি মূলত আরব বসন্তের পর থেকেই রাজনৈতিক সংস্কার, জনগণের অধিকার, গণতন্ত্রায়নের কথা বলতেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থে তিনি কখনোই সরকার বিরোধী ছিলেন না। এমনকি নিখোঁজ হওয়ার মাত্র তিন দিন আগেও বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেকে সরকার বিরোধী বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার মতে, তিনি এখনও সৌদি রাজপরিবারকে সমর্থন করেন, কিন্তু তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড জনগণের এবং রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী হওয়ায় তিনি সেগুলোর সমালোচনা করেন। কিন্তু এই সমালোচনাটুকুও সহ্য করার মানসিকতা সৌদি সরকারের নেই।
সরকারের বিরাগভাজন হয়ে ওঠা
২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর জামাল খাশোগজি সৌদি আরবের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের অতি সুসম্পর্কের সমালোচনা করলে সরকারের নির্দেশে আল-হায়াত পত্রিকা তার কলাম প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে তার ১৮ লক্ষ ফলোয়ার বিশিষ্ট টুইটার অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করে টুইট করতেও চাপ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর সৌদি আরবের পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যায়। ভিন্নমত পোষণকারী অনেকেই গ্রেপ্তারের আশঙ্কা করতে থাকেন। এ সময়ই জামাল খাশোগজি সৌদি আরব ছেড়ে আমেরিকায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।
আমেরিকায় যাওয়ার পর থেকেই জামাল খাশোগজি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতে শুরু করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলেও সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেন। তিনি ইয়েমেনের উপর সৌদি আগ্রাসনের সমালোচনা শুরু করেন। বিন সালমানকে তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তুলনা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার সাথে তুরস্কের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত মঙ্গলবার তিনি তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কন্সুলেটে গিয়েছিলেন মূলত তুরস্কের এক নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে তার পূর্বের স্ত্রীর সাথের ডিভোর্স পেপার সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার পরেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি।
দূতাবাস থেকে নিখোঁজ হওয়া
Oh my God: “The official described a quick and complex operation in which Mr. Khashoggi was killed within two hours of his arrival at the consulate by a team of Saudi agents, who dismembered his body with a bone saw” https://t.co/ilHkNzlxrG
— Tom Gara (@tomgara) October 9, 2018
তুরস্কের কন্সুলেটে জামাল খাশোগজি আগেও গিয়েছিলেন। তখন তাকে অক্টোবরের ২ তারিখে পুনরায় যাওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল। তিনি হয়তো তিনি বুঝতে পারছিলেন, কন্সুলেটের ভেতরেও তিনি নিরাপদ না। তাই সেখানে প্রবেশের আগে তার বাগদত্তার হাতে তার মোবাইল ফোনটা দিয়ে বলেছিলেন, যদি তিনি না ফেরেন তাহলে তিনি যেন তার বন্ধু এবং তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির উপদেষ্টা ইয়সিন আকতের সাথে যোগাযোগ করেন। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও জামাল ফিরে না আসায় তিনি ইয়াসিন আকতেকে ফোন করেন।
মূলত এর পর থেকেই জামাল খাশোগজি সম্পূর্ণ নিখোঁজ। ৬ অক্টোবর বার্তাসংস্থা রয়টার্স সর্বপ্রথম নাম প্রকাশ না করে তুরস্কের কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে দাবি করে, তাদের বিশ্বাস জামাল খাশোগজিকে কন্সুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে এবং এরপর তার মৃতদেহ সেখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ দাবি অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, জামাল খাশোগজি কন্সুলেটে প্রবেশ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আসলে কী ঘটেছে জামাল খাশোগজির ভাগ্যে?
“Security camera footage was removed from the Saudi consulate in Istanbul and Turkish staff were abruptly told to take a holiday on the day the dissident journalist Jamal Khashoggi disappeared while inside the building, it has emerged.” https://t.co/JJv6PjSILb
— Kristian Ulrichsen (@Dr_Ulrichsen) October 9, 2018
জামাল খাশোগজি এখনও নিখোঁজ। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে তার নিখোঁজের পেছনে কোন কারণটি সত্য, নিশ্চিত করে হয়তো তা বলা সম্ভব না। কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সৌদি আরবের বক্তব্য অনুযায়ী জামাল যদি কয়েক মিনিটের মধ্যেই কন্সুলেট থেকে বেরিয়ে যেতেন, তাহলে সৌদি আরব সিসিটিভি থেকে ধারণকৃত ছবি প্রকাশ করে তার প্রমাণ দিতে পারত। কিন্তু বাস্তবে জামাল খাশোগজির কন্সুলেটে প্রবেশ করার ছবি থাকলেও বের হওয়ার কোনো ছবি দেখা যায়নি। উল্টো সৌদি আরব অজুহাত দেখাচ্ছে, তাদের সিসিটিভি সে সময় অকেজো ছিল। এছাড়াও সেদিন কন্সুলেটে কর্মরত তুরস্কের নাগরিকরাও অনুপস্থিত ছিল। অভিযোগ উঠছে, তাদেরকে অগ্রীম ছুটি দেওয়া হয়েছিল।
জামাল খাশোগজি নিখোঁজ হওয়ার কিছুক্ষণ পর ছয়টি কালো রংয়ের জীপ দূতাবাস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও সেদিন দুটি প্রাইভেট প্লেনে করে ১৫ জন সৌদি কর্মকর্তা তুরস্কে এসেছিল এবং কয়েক ঘন্টা পর একই দিনে তারা তুরস্ক ছেড়ে গিয়েছিল। তুরস্কের কর্তৃপক্ষের ধারণা, জামালের মৃতদেহ হয়তো ঐ জীপগুলোতে করে এবং পরবর্তীতে প্লেনে করে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। তবে তুরস্কের ডেইলি সাবাহ পত্রিকা এটাও ইঙ্গিত করেছে যে, জামাল খাশোগজিকে হয়তো হত্যা না করে জীবিত অপহরণ করেই প্লেনে করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
According to @washingtonpost
“Before Khashoggi’s disappearance, U.S. intelligence intercepted communications of Saudi officials discussing a plan to capture him, according to a person familiar with the information.” https://t.co/vBsYrCZAFg— Hussein Ibish (@Ibishblog) October 10, 2018
জামাল খাশোগজিকে আসলেই হত্যা করা হয়েছে কি না, কিংবা সেই হত্যাকান্ডের পেছনে সৌদি আরবই জড়িত কি না, এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ এখনও তুরস্ক দিতে পারেনি। তুরস্কের নেতৃবৃন্দও এখনও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কায় সরাসরি সৌদি আরবকে অভিযোগ করা থেকে বিরত আছে। ক্ষমতাসীন একে পার্টির উপদেষ্টা ইয়াসিন আকতে এমনকি এই ঘটনার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা থাকার ব্যাপারেও ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু তারপরেও তুরস্কের পুলিশ এবং অন্যান্য সূত্রের বরাতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী ধারণা করা যায়, হত্যা কিংবা অপহরণ যেটাই ঘটে থাকুক, তার পেছনে সৌদি কর্তৃপক্ষই দায়ী।
সৌদি আরব ভিন্নমত যে একেবারেই সহ্য করে না, তার প্রমাণ গত এক বছরে অনেকগুলো গ্রেপ্তারের ঘটনার মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে দূতাবাস থেকে বিখ্যাত সাংবাদিককে অপহরণ বা হত্যা করার মাধ্যমে সৌদি আরব নিজের রেকর্ড নিজেই অতিক্রম করেছে। সৌদি আরবের পক্ষের গণমাধ্যমগুলোতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে যেরকম সংস্কারপন্থী হিসেবে দাবি করা হয়, এর মধ্য দিয়ে সেই রূপকথার গল্প তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে কূতনীতিবিদদের এবং কূটনৈতিক মিশনগুলোর দায়মুক্তি থাকায় হয়তো শেষপর্যন্ত এ ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের কোনো শাস্তিই হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন থাকায় আন্তর্জাতিকভাবেই সৌদি আরবকে হয়তো কোনো চাপের সম্মুখীন হতে হবে না। কিন্তু ঘটনাটি নিঃসন্দেহে মানবতার ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।
ফিচার ইমেজ- C R Sasikumar