অর্থনীতি দুই ধরনের প্রভাবক দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা অন্য যেকোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে বাজার, বাজারের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় আবার মুনাফাকে কেন্দ্র করে। আবার, উত্তর কোরিয়া, কিউবার ক্ষেত্রে অর্থনীতি চালায় সরকার, যেখানে মুখ্য ভূমিকা রাখে সমাজে নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা, এবং সেই চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত উৎপাদন করা। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি পুরোপুরি বাজারের মাধ্যমেও পরিচালিত হয় না, আবার সরকারেরও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকে না।
ওয়েন জিয়াবাউয়ের মতে, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক কাঠামো, যেখানে বাজার তার ভূমিকা রাখে সরকারের সম্পদ বরাদ্দ প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে, সরকারের ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি বাস্তবায়নের লক্ষ্য আর নজরদারির মধ্যে থেকে। চীনে কমিউনিস্ট শাসনের মধ্যেই বেশ কয়েকবার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে চীনের অর্থনৈতিক কাঠামো। চীনের নাগরিকদের অর্থনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর রাজনীতিবিদদের বিদ্যমান স্টেটাস কো টিকিয়ে রাখার জন্য চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক দর্শন হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি।
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি
বাজার অর্থনীতি সাধারণত একটি দেশে গণতন্ত্রায়নের পথ সুগম করে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শ্রেণী তৈরি হয়। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে চীনের অর্থনৈতিক প্রিন্সিপাল হলেও সেখানে গণতন্ত্রায়নের সুবাতাস বয়ে যায়নি। তবে, সেখানে নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে, বিলিয়নিয়াররা সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চীন।
মাও সে তুংয়ের অধীনে তিন দশক চীনের অর্থনীতি ছিল সরকার পরিকল্পিত। কেন্দ্র থেকে নির্ধারিত অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করত স্থানীয় প্রশাসন। কেন্দ্রের লক্ষ্য সামনে রেখেই উৎপাদনে যেতেন চীনের কৃষকেরা। মাও সে তুংয়ের যুগ সমাপ্ত হলে চীনের অর্থনৈতিক কাঠামোতে সংস্কার আসা শুরু হয়। ১৯৭৮-৮৪ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর তিন-চতুর্থাংশ ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত, এক-চতুর্থাংশ ছিল বাজারের ভূমিকা। ১৯৮৫-৮৭ সাল পর্যন্ত চীনের অর্থনৈতিক কাঠামোতে বাজারকে মুখ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, সরকারের পরিকল্পনা চলে আসে গৌণ ভূমিকাতে।
এই পর্যায়ে এসে চীনে চলে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সংস্কারবিরোধীরা আবার কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে নিয়ে আসেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মুখ্য ভূমিকায়। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে চীনে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির চর্চা। ১৯৯২-৯৭ সাল পর্যন্ত সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির চর্চা চলে, ১৯৯৮ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলছে সম্পদের পাবলিক মালিকানায় সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি।
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি বিভিন্ন দিক থেকেই পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র থেকে ভিন্ন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় ভিন্ন আঙ্গিকে।
জমির মালিকানা
পুঁজিবাদে সম্পদের মালিকানা থাকে ব্যক্তির কাছে, একটি পণ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ ও বিপণনের সাথে আনুসাঙ্গিক সকল মালিকানা থাকে ব্যক্তির কাছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে সম্পদের মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্র কৃষকদের কাছে জমি বিতরণ করে, বিপণন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, নির্ধারণ করে দেয় কী উৎপাদন করতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে জমির মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের কাছেই। তবে, একজন কৃষকের উৎপাদন ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র জমি কৃষকের কাছে লিজ দেয়। লিজ দেওয়ার সময় বিবেচনায় নেওয়া হয় জমির উর্বরতা আর কৃষকের গ্রাম থেকে কৃষিজমির দূরত্বও। জমির দীর্ঘমেয়াদে লিজ পেলে কৃষকেরা সাধারণত জমির উর্বরতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেন, কৃষিপণ্য উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
কোম্পানির মালিকানা
অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈধভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার একটি মুখ্য উপায় হচ্ছে কোম্পানি গঠন করা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে কোম্পানি থাকে ব্যক্তির একক মালিকানায়, কোম্পানি থাকতে পারে যৌথ মালিকানায় কিংবা কোনো সংগঠনের মালিকানায়।
চীনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তিমালিকানার কোম্পানি আছে, পাবলিক মালিকানার কোম্পানি আছে, আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি। আবার, ব্যক্তি ও সরকারি মালিকানার মিশ্র কোম্পানিও রয়েছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে।
চীনে ১৯৮৪ সালে কোম্পানি আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয় বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো। এই আইনে বড় কোম্পানিগুলোকে সরকারি মালিকানায় রেখে ছোট কোম্পানিগুলোকে যেতে দেওয়া হয় ব্যক্তিমালিকানায়। যেহেতু কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের ব্যাপারে কোনো তথ্য চীনা সরকার প্রকাশ করে না, তাই ধারণা করা হয়- চীনের প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর মধ্যেও রয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানা।
চীনে প্রতিটি কোম্পানির অভ্যন্তরে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির সেল, আছে ট্রেড ইউনিয়নের শাখাও। কোম্পানির অভ্যন্তরে থাকা ট্রেড ইউনিয়নের শাখাগুলো শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে না, বরং কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংযুক্ত থেকে শ্রমিক আন্দোলন দমন আর প্রতিরোধের কাজ করে।
কোম্পানিগুলোর বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
চীনের কোম্পানিগুলো থাকে সরকারের ব্যবস্থাপনার মধ্যে। কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরেও থাকে চীনা সরকারের নিয়ন্ত্রণ। কোম্পানির যেকোনো ধরনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা আগে এনআরডিসিকে জানাতে হয়, জানাতে হয় কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা করলেও। যেকোনো ধরনের অধিভুক্তি কিংবা বিক্রির ক্ষেত্রে নিতে হয় এনআরডিসির অনুমোদন। এনআরডিসিই সাধারণত নিয়োগ দেয় কোম্পানিগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের।
কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে কেবল ৫-১০ শতাংশ শেয়ারই বাজারে ছাড়া হয়। কোনো কোম্পানির ২০ শতাংশের অধিক মালিকানা নিতে পারেন না বিদেশীরা। বাজারে ছাড়া শেয়ার আবার অনেক সময়ই কিনে নেয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেক সময় স্থানীয় কমিউনিটিও যুক্ত হয় কোম্পানির মালিকানায়। স্থানীয় প্রশাসনও যুক্ত হতে পারে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।
পুঁজিবাদী কাঠামোতে একটি কোম্পানি এসব ক্ষেত্রে স্বাধীন। কোম্পানি স্বাধীনভাবে কৌশলগত পরিকল্পনা নির্ধারণ করে, নিজেদের বাণিজ্য লক্ষ্যের সাথে মিল রেখেই নিয়োগ দেয় ব্যবস্থাপকদের। আইন মেনে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই বললেই চলে।
বাজার ব্যবস্থাপনা
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে সাধারণত দাম নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা আর যোগানের উপর ভিত্তি করে, উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মুখ্য লক্ষ্য থাকে মুনাফার্জন করা। রাষ্ট্র বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রায় অনুপস্থিত থাকে, অনুপস্থিত থাকে বাজার প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও। বাজার স্বাধীনভাবেই সাধারণত পণ্যের দাম নির্ধারণ করে, তুলনামূলকভাবে উৎপাদন খরচ আর পণ্যের বিক্রির দামের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে।
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে সরকার দাম নির্ধারণের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে, হস্তক্ষেপ করে আইনি বাধ্যবাধকতা আর ইনফরমাল সাজেশনের মাধ্যমে। সরকারের আইনি কাঠামো বাজারের যেকোনো ক্রীড়ানককে সুবিধা দিতে পারে, আবার বাজারের যেকোনো ক্রীড়ানককে বাজার থেকে বের করে দিতে পারে। কোম্পানিগুলোকে যেহেতু সকল ধরনের বাণিজ্য পরিকল্পনা সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে শেয়ার করতে হয়, সেহেতু মুনাফার্জন অনেকাংশেই নির্ভর করে সরকারি সংস্থাগুলোর ইচ্ছার উপর।
সরকারি সংস্থাগুলো চাইলে পণ্যের দাম বাড়াতে বা কমাতে পারে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত মুনাফার্জনের সুযোগ করে দিতে পারে, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিতে পারে রাষ্ট্রের সুনজরে থাকা কোম্পানিগুলোকেও। এই প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি ডলার ইতোমধ্যেই অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে অর্জন করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং ক্ষমতার বলয়ের সুনজরে থাকা কোম্পানিগুলো।
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি কি মিথ?
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি নিয়ে চীন বিপুল অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করেছে, চীনের আধুনিকায়ন হচ্ছে দ্রুতগতিতে। চীন আসলে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছে চীনা বৈশিষ্ট্যের আলোকে, রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী নেতৃত্ব, যারা অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির পতন থেকে নিয়মিত শিক্ষা নিচ্ছেন।
সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে একদিকে যেমন বাজারকে প্রভাবক হিসেবে রাখা হয়, অন্যদিকে থাকে সরকারের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কোম্পানির ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করলেও রাষ্ট্র কোম্পানিগুলোকে রাখে প্রতিনিয়ত বাধ্যবাধকতার মধ্যে। কোম্পানিগুলো পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেই। পণ্যের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াতেও হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্র। উৎপাদন, পণ্যের প্রবাহ, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিতরণ ব্যবস্থা থেকে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র। ফলে, অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকের চোখেই সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি একটি মিথ।