সাম্প্রতিক আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধে ককেশাস অঞ্চলের প্রধান সামরিক শক্তি রাশিয়ার নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তা বা নিরপেক্ষতা অনেককেই বিস্মিত করেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে আজারবাইজানের সঙ্গে আর্তসাখ ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধ চলছে, এবং প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী তীব্র যুদ্ধের পর ১০ অক্টোবর রুশ মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এরপরও উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। এ যুদ্ধে আজারবাইজান আর্তসাখের দক্ষিণাঞ্চলে জাব্রাইলসহ বেশকিছু অঞ্চল দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়েই রুশ সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাকু ও ইয়েরেভান উভয়েই মস্কোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, রুশ–আজারবাইজানি সম্পর্কের তুলনায় রুশ–আর্মেনীয় সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ।
আর্মেনিয়া রুশ–নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক জোট ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন’ এবং সামরিক জোট ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা’র (Collective Security Treaty Organization, ‘CSTO’) সদস্য। রাশিয়া আর্মেনিয়ার কাছে সস্তায় প্রচুর অস্ত্র বিক্রি করে এবং আর্মেনিয়াকে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গুমরিতে একটি বড় রুশ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, এবং ইয়েরেভানের এরেবুনি বিমানবন্দরে একটি রুশ বিমানঘাঁটি রয়েছে। তদুপরি, রুশ সীমান্তরক্ষীরা আর্মেনিয়ার সঙ্গে তুরস্ক ও ইরানের সীমান্ত প্রহরা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, রাশিয়া ও আর্মেনিয়ার মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরেও রাশিয়া কেন আর্মেনিয়াকে আজারবাইজানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন দিচ্ছে না?
বস্তুত সাম্প্রতিক আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে মস্কোর ভূমিকাকে অধিকাংশ বিশ্লেষকই ‘নির্লিপ্ত’, ‘নিষ্ক্রিয়’ বা ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মস্কোর এই ভূমিকা গ্রহণের পশ্চাতে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
প্রথমত, একদিকে আর্মেনিয়া যেমন রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে তেমনি আজারবাইজানও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আজারবাইজান একটি ‘বহুমুখী’, ‘বাস্তববাদী’ এবং ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে। আজারবাইজান একদিকে যেমন মস্কো–নিয়ন্ত্রিত সিএসটিও ও ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নে যোগদান করেনি, অন্যদিকে তেমনি ওয়াশিংটন–নিয়ন্ত্রিত ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান থেকেও বিরত থেকেছে। কিছু কিছু প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্র (ইউক্রেন, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ, জর্জিয়া) যেভাবে রুশবিরোধিতাকে তাদের পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মূল উপাদানে পরিণত করেছে, আজারবাইজান সে পথে যায়নি।
বরং আজারবাইজানি পণ্ডিতরা ২০০ বছরব্যাপী এক রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে রাশিয়া ও আজারবাইজানের সহাবস্থানের ব্যাপারটির ওপর সবসময়ই গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং রাশিয়া সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছেন। তদুপরি, আজারবাইজানের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সিংহভাগই রুশভাষী, এবং আজারবাইজানে এখনো প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার জাতিগত রুশ বসবাস করে, যারা আজারবাইজানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। সর্বোপরি, আজারবাইজানের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। আজারবাইজান রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে এবং রাশিয়া আজারবাইজানের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি অংশীদার। আজারবাইজানের সশস্ত্রবাহিনীর সিংহভাগ অস্ত্রশস্ত্রের উৎস রাশিয়া।
এমতাবস্থায় মস্কোর আজারবাইজানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণ নেই। আজারবাইজানের পরিবর্তে যদি জর্জিয়া বা তুরস্ক আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হত, সেক্ষেত্রে মস্কো নিশ্চিতভাবে আর্মেনিয়ার পক্ষ অবলম্বন করত।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের নেতৃত্বাধীন আর্মেনিয়ার বর্তমান সরকারের প্রতি মস্কো সন্তুষ্ট নয়। পাশিনিয়ান ২০১৮ সালে একটি ‘রঙিন বিপ্লবে’র মাধ্যমে আর্মেনিয়ার তদানীন্তন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। মস্কো প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে বিবেচনা করে, এবং আর্মেনিয়ায় সংঘটিত এই রঙিন বিপ্লবের পেছনে পশ্চিমা বিশ্ব জড়িত ছিল বলে মস্কো ধারণা করে। এছাড়া, পাশিনিয়ানের সরকার আর্মেনীয় গণমাধ্যমের ওপর থেকে বিধিনিষেধ অনেকটাই তুলে দিয়েছে এবং এর ফলে আর্মেনীয় গণমাধ্যমে প্রচুর রুশবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। পাশিনিয়ান পশ্চিমা এনজিওগুলোকে আর্মেনিয়ায় নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন, এবং এগুলোর মধ্যে মার্কিন ব্যবসায়ী জর্জ সোরোসের প্রতিষ্ঠিত এনজিওগুলোও রয়েছে, যেগুলোকে মস্কো পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে।
তদুপরি, আর্মেনিয়ার বর্তমান সরকার দেশটির প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রবার্ট কোচারিয়ানকে কয়েকবার গ্রেপ্তার করেছে, যেটি মস্কো ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। পাশিনিয়ানের সঙ্গে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কও তেমন ভালো নয়। এক কথায়, আর্মেনিয়ার বর্তমান সরকারব্যবস্থা মস্কোর পছন্দনীয় নয়, এবং এই যুদ্ধে আর্মেনিয়াকে একাকী আজারবাইজানের বিরুদ্ধে রেখে মস্কো পাশানিয়ানকে একটি সতর্কবার্তা দিতে চায় যে, তার ‘রঙিন বিপ্লবে’র জন্য তাকে মূল্য দিতে হবে।
অন্যদিকে, আজারবাইজানের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রাশিয়ার শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো, এবং এটি রাশিয়ার অবস্থানকে আংশিকভাবে হলেও প্রভাবিত করেছে।
তৃতীয়ত, বিরোধপূর্ণ নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজারবাইজানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, এবং অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার অবস্থানও অনুরূপ। অন্যদিকে, নাগর্নো–কারাবাখ সম্পর্কে আর্মেনিয়ার নিজের অবস্থানও স্পষ্ট নয়। একদিকে আর্মেনীয়রা অনানুষ্ঠানিকভাবে নাগর্নো–কারাবাখকে নিজেদের ভূমি হিসেবে দাবি করে, অন্যদিকে আর্মেনিয়া কখনো অঞ্চলটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেনি, কিংবা আর্তসাখের স্বাধীনতাকেও স্বীকৃতি প্রদান করেনি। অর্থাৎ, আইনগতভাবে নাগর্নো–কারাবাখ ও সংশ্লিষ্ট আজারবাইজানি অঞ্চল আর্মেনিয়ার অংশ নয়।
রাশিয়া আর্মেনিয়ার বাইরে আর্মেনীয়দের অধিকৃত অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করতে ইচ্ছুক নয়, এবং রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আর্মেনিয়াকে দেওয়া রুশ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আর্মেনিয়ার সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেটি নাগর্নো–কারাবাখের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
চতুর্থত, রাশিয়ায় প্রচুর সংখ্যক জাতিগত আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় বসবাস করে। প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ জাতিগত আজারবাইজানি এবং প্রায় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ জাতিগত আর্মেনীয় রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে। ইতোপূর্বে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সংঘাতের পর মস্কোয় আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল, এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময়েও মস্কোয় উভয় পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছে। এমতাবস্থায় রাশিয়া যদি এই যুদ্ধে সরাসরি আর্মেনিয়া বা আজারবাইজানকে সমর্থন করে, তাহলে রাশিয়ার অভ্যন্তরে জাতিগত দাঙ্গা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মস্কো এই ঝুঁকি নিতে নারাজ।
পঞ্চমত, রাশিয়া বাদে সিএসটিও জোটের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়। সিএসটিও–এর সদস্য বেলারুশ নিজস্ব রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে ব্যস্ত, এবং আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক। কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান উভয়েই আজারবাইজানের মতো তুর্কি–অধ্যুষিত ও মুসলিম–অধ্যুষিত রাষ্ট্র, এবং আজারবাইজানের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক। একই কথা প্রযোজ্য মুসলিম–অধ্যুষিত তাজিকিস্তানের ক্ষেত্রেও। সর্বোপরি, ২০১৮ সালের বিপ্লবের পর আর্মেনিয়ায় ব্যাপক সিএসটিও জোটবিরোধী মনোভাব দেখা দিয়েছে। এসব কারণে আর্মেনিয়া সিএসটিও–এর সদস্য হলেও সিএসটিও নাগর্নো–কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়।
ষষ্ঠত, কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, সাম্প্রতিক আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ মস্কোকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলেছে। মস্কো বেলারুশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট এবং পশ্চিমাপন্থী রুশ বিরোধী দলীয় নেতা আলেক্সেই নাভালনির কথিত হত্যাপ্রচেষ্টা নিয়ে ব্যস্ত ছিল, এবং দক্ষিণ ককেশাসের পরিস্থিতি নিয়ে মনোযোগী ছিল না। ফলে এই যুদ্ধের প্রতি কার্যকরী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে মস্কো সক্ষম হয়নি।
সপ্তমত, কিছু কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, মস্কো ইচ্ছাকৃতভাবে আর্মেনিয়াকে দুর্বল হতে দিচ্ছে। মস্কোর কাছে আর্মেনিয়ার চেয়ে আজারবাইজান ও আজারবাইজানের সমর্থক তুরস্কের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি, এবং মস্কো জানে যে, আর্মেনিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে আর্মেনীয়রা চাইলেও মস্কোর প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে যেতে পারবে না। এছাড়া, রুশ কূটনীতিবিদরা আর্মেনিয়ার ওপর কিছুটা ক্ষিপ্ত, কারণ তারা মনে করেন, আর্মেনিয়া সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিকভাবে নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তাছাড়া, আজারবাইজানকে কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে দিলে একদিকে যেমন আজারবাইজানে রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বজায় থাকবে, অন্যদিকে তেমনি আজারবাইজানের সাফল্য তুর্কি রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে তার ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সুযোগ করে দেবে, যেজন্য তিনি আংশিকভাবে মস্কোর নির্লিপ্ততার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন। ইতোমধ্যেই আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এই যুদ্ধে রুশ নিরপেক্ষতার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘রাশিয়া একটি বড় ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে’।
সর্বোপরি, অনেক বিশ্লেষকই সাম্প্রতিক আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধকে রুশ–তুর্কি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের একটি অংশ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, তুরস্ক আজারবাইজানকে এই যুদ্ধ শুরু করতে প্ররোচনা দিয়েছে। তুরস্কের উদ্দেশ্য হলো– রুশ মিত্র আর্মেনিয়াকে পর্যুদস্ত করে রাশিয়াকে সতর্কবার্তা দেয়া, আজারবাইজানকে রুশ বলয় থেকে পুরোপুরিভাবে বের করে এনে তুর্কি বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করা, দক্ষিণ ককেশাসে তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধি করা, নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়ায় তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সিরিয়া ও লিবিয়ায় রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় আদায় করা। এই উদ্দেশ্য তুরস্ক আজারবাইজানকে পরিপূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছে, যাতে রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষ নিতে বাধ্য হয় এবং আজারবাইজানের শত্রুতে পরিণত হয়।
রুশরা তুর্কিদের উদ্দেশ্য ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে, এবং সেজন্যই এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকেছে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই রুশ ও পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন যে, অল্প কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে যাবে, এবং কার্যত তাই হয়েছে। রাশিয়া তুরস্ককে নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এবং ১০ অক্টোবর তুরস্ককে ছাড়াই আজারবাইজান মস্কোতে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। যদিও আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়ায় তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন, কিন্তু আর্মেনিয়া এতে সম্মত নয়, এবং উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া তুরস্ক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে না। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া দক্ষিণ ককেশাসে তুরস্ককে ‘চেকমেট’ দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান, যদিও এখনই চূড়ান্ত কোনো ফলাফলে পৌঁছানোটা ঠিক হবে না।
আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে মস্কোর কয়েকটি নির্দিষ্ট ‘রেড লাইন’ রয়েছে, যেগুলো অতিক্রান্ত হলে মস্কো নিশ্চিতভাবে এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে।
প্রথমত, যদি আজারবাইজান বা আর্মেনিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত হয়, সেক্ষেত্রে বিজয়ী পক্ষের রাশ টেনে ধরতে মস্কো হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে আজারবাইজান বা আর্মেনিয়া কারো পক্ষেই পূর্ণাঙ্গ বিজয় অর্জন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সিরীয় মার্সেনারিদের প্রেরণ করেছে এবং মস্কো এই ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাকু এই ব্যাপারটি অস্বীকার করেছে। যদি সিরীয় মার্সেনারিদের কার্যকলাপ নাগর্নো–কারাবাখে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে মস্কো এই ব্যাপার নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাবে না। কিন্তু যদি এই মার্সেনারিদের কার্যকলাপ রুশ–আজারবাইজানি সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার অস্থিতিশীল উত্তর ককেশাসে বিস্তার লাভ করে, সেক্ষেত্রে মস্কোর প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র। বাকু এই বিষয়ে সচেতন, এবং আজারবাইজানের ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগোষ্ঠী ‘ইসলামপন্থী’ সিরীয় যোদ্ধাদের আজারবাইজানকে একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেবে, এই সম্ভাবনা খুবই কম।
সর্বোপরি, আজারবাইজানের পক্ষে তুরস্ক যদি সরাসরি এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে, সেক্ষেত্রে মস্কো আর্মেনিয়ার পক্ষে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে। আঙ্কারা এই ব্যাপারে সজাগ, এবং আজারবাইজানের প্রতি মৌখিকভাবে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তুর্কি ড্রোন অপারেটর বা তুর্কি যুদ্ধবিমানের উপস্থিতি তারা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, কার্যত মস্কো বা আঙ্কারা কেউই একে অপরের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে আগ্রহী নয়।
অবশ্য যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে গেলেও মস্কো কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে। নাগর্নো–কারাবাখ বা আর্মেনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত সংযোগ নেই, এবং এই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে হলে রাশিয়াকে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড অতিক্রম করতে হবে, যেটি করতে মস্কো আগ্রহী নয়। তদুপরি, সিরিয়া, লিবিয়া ও আজারবাইজানে তুর্কি–নির্মিত ড্রোন এবং সিরিয়া ও আজারবাইজানে ইসরায়েলি–নির্মিত ড্রোন প্রচুর রুশ–নির্মিত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করেছে। এখন পর্যন্ত মস্কো তুর্কি বা ইসরায়েলি ড্রোনের মোকাবেলা করার জন্য পুরোপুরিভাবে কার্যকর কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পেরেছে কিনা, এই বিষয়টি স্পষ্ট নয়। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তিগুলো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিরিয়া বা আর্মেনিয়ার মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি পারদর্শী, এবং সেক্ষেত্রে তুর্কি বা ইসরায়েলি–নির্মিত ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের জন্য বড় ধরনের কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়।
সামগ্রিকভাবে, রাশিয়া দক্ষিণ ককেশাসকে নিজস্ব ‘প্রভাব বলয়’ হিসেবে বিবেচনা করে, এবং এতদঞ্চলে নিজেদের অনুকূলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আগ্রহী। এজন্যই মস্কো সাম্প্রতিক যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে নির্লিপ্ত ভূমিকা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আজারবাইজানি ‘প্রতিশোধপরায়ণতা’, তুর্কি ‘চাতুর্য’ এবং আর্মেনীয় ‘অনড় অবস্থানে’র প্রেক্ষাপটে মস্কোর উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হবে, সেটি দেখার বিষয়।