বর্তমানে কাঁটাতার দিয়ে যে ভাগ করা দেশ ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান হয়ে উঠার অনেক আগে হিমালয় থেকে নেমে আসা নদী নিয়ে এসেছিল পলি। নদীর তীরজুড়ে উর্বর পলিমাটিতে গড়ে উঠেছে বাংলার ভূখণ্ড। এখন যে পূর্ব বাংলার বদ্বীপ, তার ভাষা, সাহিত্য, লোকগান, ভাব, কৃষি, অর্থনীতি পুরোটাই গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরে। ধীর লয়ে পলিমাটির ভূখণ্ডজুড়ে নদীগুলো এই ভূমির বুক জুড়ে তানপুরা বাজিয়ে গেছে, সেই তানপুরার তানে বাধা পড়েছে সাহসী মানুষ, এক ঘর দুই ঘর করে বসতি গেড়েছে মানুষ।
বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ব্রিটিশ শাসন আসার আগেও এর প্রভাব দেখা গেছে, গ্রামগুলো মধ্য এবং উত্তর ভারতের অন্য এলাকা থেকে আলাদা। যেসব এলাকায় পানি দুর্লভ সেখানে পানির উৎসকে কেন্দ্র করে গ্রাম গড়ে উঠেছে। কিন্তু পূর্ব বাংলার গ্রাম এদিক থেকে আলাদা এই গ্রামগুলো নদীর তীরজুড়ে সমান্তরালে গড়ে উঠেছে, নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে দেখা যায় এই গ্রামগুলো সমান্তরাল ছিল, এর পেছনে নদীর তীরজুড়ে উর্বর পলিসমৃদ্ধ ভূমি অনেকাংশে দায়ী।
আবার কখনো সেই নদী রাগে ফুলে উঠেছে, গর্ভে টেনে নিয়েছে জনপদের পর জনপদ। সমান্তরাল গ্রামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি, তবে আবার সেই বন্যার পর নদীর রেখে যাওয়া পলিমাটিতে নতুন করে দ্বিগুণ ফসলে হেসে উঠেছে কৃষকের মুখ। ভারতের ইতিহাসে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, বরাক, তিস্তা অববাহিকার ঐকতানে এই বাংলা আর পঞ্চনদের অববাহিকা ‘পাঞ্জাব’ পরিচিত ছিল ভারতের দুই শস্যভাণ্ডার হিসেবে। সমৃদ্ধশালী এই বাংলা ছিল কাঁচামালের রাজধানী হিসেবে, এর ঘাটে ঘাটে ভিড়েছে বণিকের নৌকা। রক্তচোষা ব্রিটিশ শাসনে এই বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থা সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাংলার সম্ভাবনা অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে। ইংরেজ আমলের শেষে ভাগ্যের ফেরে দেশভাগের রক্তাক্ত কাঁটাতার কেটেছে এই দুইটি অঞ্চলকে সবচেয়ে বেশি। তবে সেই রেশ তো শেষ হয়ে যায়নি।
বাংলা এবং পাঞ্জাব দুই ভাগ হয়েছে, শত সহস্র বছর ধরে অভিন্ন ধমনী দিয়ে বয়ে চলা নদীর অববাহিকাগুলো বাধাপ্রাপ্ত করেছে এই তিনটি দেশ। সময় যত গড়িয়েছে এই আন্তঃসীমানা নদীগুলো জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক সমস্যার। যার মূলে আছে পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দেন দরবার, উজানে থাকা দেশ পানির অববাহিকায় বাধা দিয়ে করছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, নদী থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে করছে সেচ প্রকল্প। ভাটির দেশ গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি পাচ্ছে না, আবার বর্ষাকালের জলবিদ্যুৎ এবং সেচ প্রকল্পের পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা সমস্যা।
তিস্তার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?
এই নদী মূলত প্রবাহিত হচ্ছে ভারত এবং বাংলাদেশের সীমানার মাঝ দিয়ে। ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে। দীর্ঘ পরিক্রমায় এই নদী হিমালয় থেকে পাড়ি দিয়েছে ৪১৪ কিলোমিটার। এর মাঝে প্রথম খরস্রোতা উদ্দাম তিস্তার প্রথম দেড়শো কিলোমিটার ভারতের সিকিম রাজ্যে, পরের ১২৩ কিলোমিটার পশ্চিম বাংলায় গড়িয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছে শেষের প্রায় ১৪০ কিলোমিটার। আন্তঃসীমানা নদীগুলোতে যে দেশ উৎস এবং প্রধান অববাহিকা ধারার ভৌগলিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাদের বলা হয় উজানের দেশ, আর যে দেশগুলোতে উৎস শেষ হয় তারা ভাটির দেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব ও দুই দেশের পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বুক চিরে যাওয়া প্রধান ২৩০টি নদীর মাঝে ৫৭টি নদীতে আন্তর্জাতিক সীমানা জড়িত, বিশেষ করে হিমালয় থেকে উৎপত্তি পাওয়া নদী বাংলাদেশের পানির প্রধান উৎস। প্রধান অববাহিকায় পানির হিসেব করলে বাংলাদেশ তার পানির নব্বই শতাংশের জন্যই উজানের দেশের উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে এই নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে তৈরি হয়েছে নানামূখী রাজনৈতিক জটিলতা। দুই দেশেই এই নদীর খাতের চারপাশে ব্যাপক আকারে কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছে শত বছর ধরে। তিস্তার খাতে ভাটিতে বাংলাদেশ এবং ভারতের সাথে দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরে এই নদী নিয়ে সমঝোতায় আসা যায়নি। ফলে বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের কৃষিকাজ, অর্থনৈতিক কাঠামো হয়ে আছে স্থবির। বংশানুক্রমে দীর্ঘদিন ধরে নদীর উপর নির্ভর করে আসা মানুষেরা হয়ে পড়ছেন সহায় সম্বলহীন। এই এলাকায় শুকনো মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো বলছে, উত্তরবঙ্গের তিস্তা খাত থেকে কর্মহীন মানুষ এলাকা ছেড়ে ঢাকাসহ বড় শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে আভ্যন্তরীণ শরণার্থীর চাপ বাড়ছে।
তিস্তার পথচলা শুরু
সাত হাজার মিটার উঁচুতে হিমালয়ের কোলে তিস্তার জন্ম। সিকিমে এই নদীর প্রথম পথচলা। হিমালয়ের কোল থেকে তিস্তার সাথে নেমে এসেছে মূলত আরেকটি ধারা, একটি তিস্তা আরেকটি রঙ্গিত। এই দুই নদীকে সিকিমের অধিবাসী লেপচা আর ভুটিয়ারা মনে করে পবিত্র ধারা হিসেবে। এই নদীকে তারা ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধা করে। প্রচলিত লোককথায় তিস্তা এবং রঙ্গিতের প্রতিযোগিতা নিয়ে চালু আছে চমকপ্রদ কাহিনী। যেমন এর একটি হলো হিমালয় থেকে নামার পথে তিস্তা আর রঙ্গিতের মাঝে এক প্রতিযোগিতা হয়। তিস্তা নতুন রাস্তা চিনে নিতে সাহায্য নেয় সাপের, রঙ্গিত নেয় পাখির। সাপ নিরলসভাবে পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে যায় তুলনামূলক সোজা এবং ক্ষিপ্র গতিতে সাথে তিস্তাকে নিয়ে। পাখি কোথাও পোকা খেয়ে একটু অবসর নেয়, আবার চলে কোথাও পাহাড়ের খাঁজ ধরে, কোথাও মাঠের পাশ দিয়ে। রঙ্গিতের তাই দেরি হয়, শেষে পৌঁছে দেখে তিস্তা তার আগেই পৌঁছে গেছে, রঙ্গিত দেরীতে পৌঁছে ব্যথিত হয়ে খণ্ডপ্রলয়ও করেছে। তিস্তা আর রঙ্গিতকে লেপচা এবং ভুটিয়া উপাখ্যানে দেখা হয়েছে যথাক্রমে প্রেমিকা এবং প্রেমিক হিসেবে। এই প্রেমিক প্রেমিকা এসে মিলেছে দার্জিলিংয়ের কাছে, যাকে ‘লাভার্স মিট পয়েন্ট’ বলা হয়ে থাকে।
তিস্তার নাম নিয়েও আছে বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং প্রচলিতটি হলো সংস্কৃত ‘ত্রিস্রোতা’ নামটি বিকৃত হয়ে তিস্তা হিসেবে রূপ নিয়েছে। প্রশ্ন জাগে এইখানে কোন তিনটি স্রোতধারার কথা বলা হচ্ছে, গবেষকরা বলছেন এই করতোয়া, আত্রাই এবং পুনর্ভবার তিনটি ধারাকে নির্দেশ করা হচ্ছে। এর মাঝে পুনর্ভবা মিলিত হয়েছে মহানন্দার সাথে। আত্রাই এসে মিলেছে চলনবিলে, তিস্তা নদীর গতিপথে এসেছে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন।
ভারতীয় প্রচলিত লোকগাথায়ও তিস্তাকে একটু আলাদাভাবে দেখা হয়। ভারতীয় নদীর মাঝে গঙ্গাকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করা হয়ে থাকে, তবে তিস্তাকে দেখা হয়ে একটু ভয়ের সাথে। পশ্চিমবাংলার শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি এবং বৃহত্তর কুচবিহারে ‘তিস্তাবুড়ি’র মুর্তিকে ঝুড়িতে নিয়ে সারা গ্রামে পরিভ্রমণ করানো হয়। এবং বৈশাখের শেষে তিস্তায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় তিস্তাবুড়িকে। এই এলাকার মানুষ বিশ্বাস করে তিস্তাকে অসন্তুষ্ট করা হলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। ১৯৬৮ সালে তিস্তার প্রলয়ংকরী বন্যায় জলপাইগুড়ি জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেই স্মৃতি এখনো অনেকের মনে দগদগে ক্ষতের মতো জেগে আছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ এবং তিস্তার পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে গজলডোবাতে ভারত ‘তিস্তা বাধ প্রকল্প’ নির্মাণ করে। ৮৫০০ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকা নিয়ে গজলডোবার সেই বাধ দিয়ে তিস্তার খাত থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে পশ্চিম বাংলার ছয়টি জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে নদীর স্বাভাবিক খাতের ভাটিতে থাকা বাংলাদেশ শুকনা মৌসুম অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত এই নদীতে পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি না থাকায় ভারত কী পরিমাণ পানি বাংলাদেশকে ছাড় দেবে তা সম্পূর্ণই তাদের ইচ্ছাধীন হয়ে আছে। আবার এর ফলে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে প্রলম্বিত বন্যা দেখা যাচ্ছে।
১৯৭৫ সালে এই বাঁধের ফলে সবচেয়ে বড় বিপত্তির মুখে পড়ে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মানুষ। একে তো শুকনো মৌসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে না, বর্ষায়ও বুঝতে পারা যাচ্ছে না কী পরিমাণ পানি আসবে। তাই এই বাঁধ নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে ১৯৮৩ সাল থেকেই। বাংলাদেশে তিস্তার পানির সরবরাহকে নিয়মতান্ত্রিক করতে লালমনিরহাটের ডালিয়াতে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ নির্মিত এই বাঁধ এবং সেচ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল শুকনো মৌসুমে চাষিদের সেচকাজে সুবিধা দেওয়া। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু পানি তো আটকে যাচ্ছে ভারতের গজলডোবাতেই।
তাই ১৯৮৩ থেকে দুইপক্ষের আলোচনায় বার বার তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ভারত পাবে ৩৯ শতাংশ, বাংলাদেশের জন্য ৩৬ শতাংশ আর বাকি ২৫ শতাংশের হিসাব অনির্ধারিত রাখা হয়। এই আলোচনাও ঘুরেছে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে।
পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে তিস্তার পানি
ভারতের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো একইসাথে কয়েকটি রাজ্যের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, সেই রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা আছে। সেই চাহিদাকে ঘিরে আছে রাজনীতি। নদীর পানির চুক্তিতে তাই জড়িত রাজ্য সম্মতি না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার সেই বিষয়ে প্রতিবেশীর সাথে চুক্তি করতে অসমর্থ। দীর্ঘদিন ভারত-বাংলাদেশের কূটনীতিক কাঁটাতারে তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকার পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং ভারত সম্মত হয় ১৫ বছরের জন্য একটি পানিবণ্টন চুক্তি করতে। যেখানে শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকে জুন মাসের এই শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ভারত পাবে এই নদীর পানির ৪২.৫ শতাংশ আর বাংলাদেশ পাবে ৩৭.৫ শতাংশ পানি। এই চুক্তিতে একটি যৌথ নদী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র করে এই নদীর পানির তথ্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়। ফলে বর্ষা মৌসুমে বন্যা এড়াতে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে এমনটাই ছিল প্রত্যাশা।
তবে পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় থাকা ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ এই চুক্তির বিরোধিতা করে, এবং তাতে সম্মতি দেয়নি। আর অংশীদার রাজ্যের সহায়তা ছাড়া এই চুক্তি সম্পাদন সম্ভব নয়, শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকা আসার কথা থাকলেও, মমতা ব্যানার্জী তা বাতিল করে দেন। তিস্তা চুক্তি আবারো বন্দি হয়ে যায় কাগজে কলমে।
ভারতের আন্তঃরাজ্য পানির বণ্টন
এর মাঝে ভারতের আন্তঃরাজ্য পানির বণ্টন নিয়েও সমস্যা প্রকট হয়েছে। ভারতের সিকিম এবং পশ্চিম বাংলার দুই রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহ এই নদীর উজানে সিকিম। সিকিমে এই নদী ভীষণ খরস্রোতা, তাই নদীর এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা যাবে জলবিদ্যুৎ। সিকিমে তাই কমপক্ষে ছাব্বিশটি প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে, যেগুলো পুরোপুরি শুরু করা গেলে পঞ্চাশ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে সিকিম।
দীর্ঘদিন ধরেই সিকিম শুধুমাত্র তার কৃষিজ কাঁচামাল, বনশিল্প এবং পর্যটনের উপর নির্ভর করে ছিল, এবার জলবিদ্যুৎ তার রপ্তানির অন্যতম খাত হয়ে উঠতে পারে, কর্মসংস্থানের প্রশ্নেও এই প্রকল্পগুলো আশা জাগাচ্ছে সিকিমের অধিবাসীদের। সিকিম যদি অতিমাত্রায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে হাত দেয় তাহলে সেখানে পশ্চিমবাংলার পানির ভাগে কম পড়বে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এতে।
একইসাথে এই জলবিদ্যুৎ নির্মাণে বিশালাকারের পানির সঞ্চয়ক্ষেত্র বানাতে হবে, এতে সিকিমের প্রাণ পরিবেশ ক্ষতি হওয়ার প্রশ্নে অনেকেই সরব। এছাড়াও সিকিমের কিছু জায়গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ভূমিকম্পের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বা সিসমিক এলাকা হিসেবে। বিশালাকার পানির সঞ্চয়ক্ষেত্র এই সিসমিক এলাকাকে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে আছে নানা শঙ্কা। এছাড়াও ২০১৬ সালের উচ্চ বৃষ্টিপাতের ভূমিধসে সিকিমের উত্তরাঞ্চলে তিস্তার একটি গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়ে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম জলাধার। এই জলাধারে সঞ্চিত পানির পরিমাণ যত বাড়ছে তা নিয়েও শঙ্কা আছে। যদি তা ভেঙে পড়ে সিকিমের উত্তরাঞ্চল এবং পশ্চিমবাংলার উত্তরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সিকিমের পশ্চিমাঞ্চলে ‘রাথোং চু’ নামের তিস্তার একটি শাখা অববাহিকায় বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্পে স্থানীয় লেপচা সম্প্রদায় ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাদের মতে এই নদীর ধারা এবং ভূমি বৌদ্ধ গুরু ‘পদ্মসম্ভব’ এর আশীর্বাদে ধন্য। এই নদী এবং ভূমির, এতে থাকা প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, কলুষিত করে এমন উন্নয়ন করা উচিত নয়। এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিবাদে নয়শত দিনের অনশন ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করে।
বাংলাদেশের পানির কী হবে?
তবে বাধার মুখেও অনেক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে, এবং একই সাথে পশ্চিমবাংলা এবং সিকিমের মাঝে পানি নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। একই সাথে সিকিমের বাঁধ নির্মাণের ফলে পশ্চিমবাংলায় পানির পরিমাণ কমছে এবং তৈরি হয়েছে শঙ্কা। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে তাই তিস্তার পানিতে ছাড় না দেওয়ার রাজনীতি মমতা ব্যানার্জীর পক্ষেই যায়। বাংলাদেশের জন্য রাজনীতির টেবিলে তাই যুক্ত হয়েছে নতুন সমস্যা। ২০১১ তে তিস্তা চুক্তি নিয়ে অগ্রগতি থেমে যাওয়ার পরে ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্র সরকারের সাথে সমঝোতায় ১৯৪৭ সাল থেকে ঝুলে থাকা ছিটমহল সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেয় দুই দেশ, পাশাপাশি স্থল সীমান্ত এবং নৌসীমান্ত নিয়ে আলোচনায় অগ্রগতি দেখা যায়। কিন্তু তিস্তার আবারো কোনো অগ্রগতি হয়নি পশ্চিমবাংলার বিরোধে।
বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোর ব্যাপারে তৈরি হওয়া সমস্যার যথাযথ সমাধানে ১৯৭২ সালে ‘জয়েন্ট রিভার কমিশন’ গঠিত হয়। ভারত গঙ্গার উজানে কলকাতা বন্দরকে শুকনা মৌসুমে সচল রাখতে তৈরি করে ফারাক্কা বাঁধ। সেই বাঁধ গলার কাঁটা হয়ে বিধেছিল বাংলাদেশের গলায়। বাংলাদেশ ভারতের যৌথ নদী কমিশনের উদ্যোগে সেই ব্যাপারে কিছু সমাধান হয়েছে। তিস্তা ছাড়াও ফেনী নদীর পানির বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বিতর্ক। এছাড়াও বরাক নদীর উজানে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে শঙ্কিত বাংলাদেশ। এছাড়াও উজানে ভারতের ‘আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের কপালে, এই প্রকল্পে ভারতের মাঝ দিয়ে চলমান নদী থেকে পানি ভারতের খরা অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে। এমনটা হলে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশের হাতে আছে নদী ব্যবস্থাপনা, ঋণ এবং কারিগরী সহায়তা দিবে চীন
কূটনীতিকদের দৃষ্টিতে অতি সম্প্রতি সেই ফাটলের কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশ ভারতকে পাশ কাটিয়ে চীনের মিত্র হয়ে উঠছে গভীরভাবে। ভারত-চীন সীমান্ত কোন্দলে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান এবং বাংলাদেশে চীনের ব্যাপক উপস্থিতি ভারতকে নতুন চিন্তার খোঁড়াক দিয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ অংশে তিস্তাকে জাগিয়ে তুলতে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং নদী ব্যবস্থাপনায় কারিগরী সহায়তার ঘোষণা দেয়। এই প্রকল্পের ব্যাপারে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বেশ সজাগ হয়ে উঠে দ্রুতই। এই প্রকল্পে তিস্তাকে খনন করে বর্ষা মৌসুমে আসা অতিরিক্ত পানিকে ধরে রাখা, সেই পানিকে দীর্ঘমেয়াদি সেচ প্রকল্পের আওতায় আনার চিন্তা করা হচ্ছে, সঠিক নদী ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বর্ষার সময়ে গজলডোবা থেকে ছেড়ে দেওয়া পানি প্রলম্বিত বন্যা তৈরি করতে পারবে না।
চীনের এমন ঘোষণার পরেই কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়েই ভারতীয় বিশেষ দূত হিসেবে আগস্টে বাংলাদেশে আসেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা নিয়ে আলোচনা শ্রীংলার কার্যসূচীতে ছিল না, তাই এরপরেও খুব একটা এগিয়ে যায়নি আলোচনা। দুইদেশের সরকারি মাধ্যম থেকেই বলা হয়েছে, ভারতীয় দূত এসেছিলেন বাংলাদেশে চলমান ভারতীয় প্রোজেক্টগুলো নিয়ে কথা বলতে।
ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারতের সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে চীনের এই বিশাল আকারের প্রোজেক্ট ভারতের নদীর জলবণ্টনের হিস্যা আদায়ে সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে ভারতের সীমান্তের কাছে এই মেগাপ্রোজেক্ট ভারতকে কূটনীতিক চাপে ফেলবে নিশ্চিতভাবে। বিশেষ করে চীন নদী শাসন, ব্যবস্থাপনা এবং বাঁধ নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রগ্রামী দেশ, নিজেদের দেশে তারা তৈরি করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে চীনা প্রযুক্তি যদি গতিশীলতা তৈরি করে তবে ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ, আসামে পানি ও নদী ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি ভারত কৌশলগত প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে পানিবণ্টন চুক্তিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এটিও প্রতিষ্ঠিত হবে দক্ষিণ এশিয়ায়। তাই তিস্তা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ-চীনের কূটনৈতিক যুদ্ধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আগামী দিনে দেখার ব্যাপার। তবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মানুষের চাওয়া বর্ষাকালে প্রলম্বিত বন্যা এবং শুকনা মৌসুমে হাহাকারের অবসান ঘটুক।