অর্ধশতাব্দী জুড়ে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলে স্নায়ুযুদ্ধ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সমাপ্ত হয় এ স্নায়ুযুদ্ধ। রাশিয়ার বিস্তৃত ভূমি, বেলারুশ আর পূর্ব ইউরোপ দেশগুলো নিয়ে গঠিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউনিয়নের অংশ ছিল মধ্য এশিয়ার দেশগুলোও। এর পতনের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অংশ হিসেবে থাকা ১৫টি রিপাবলিক গঠন করে জাতিরাষ্ট্র। সেখানে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গৃহীত হয় গণতন্ত্র।
নব্বই দশকে এই স্বাধীন হওয়া দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক দশকেও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনগুলো তাদের স্বাতন্ত্র্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল, ব্যর্থতা ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে। সংসদীয় গণতন্ত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় সিভিল সোসাইটিও। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের যাত্রা এই দেশগুলোতে শুরু হলেও, দুর্বল সংবিধানের সুযোগে অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন রাষ্ট্রপ্রধানেরা।
এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আর নিজের অসীম ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ পথে দীর্ঘায়িত করছিলেন রাষ্ট্রপ্রধানেরা। নিয়ন্ত্রণ করছিলেন রাজনীতিতে। রাষ্ট্রপ্রধানের সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র, অংশ হয়েছিল ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা স্বার্থগোষ্ঠীগুলোও। ফলে, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে থাকা এসব দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরও ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে, ব্যর্থ হয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এ শতাব্দীর শুরুর দিকে এসব দেশের পরিবর্তনকামী তরুণেরা বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নামে সরকারের বিরুদ্ধে। কিছু দেশে সফলভাবে পরিবর্তন হয় সরকার। আন্দোলনগুলোকে একসাথে বলা হয় ‘রঙিন বিপ্লব’। আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর ধারাবাহিক আলোচনায় রঙিন বিপ্লবের ঘটনাগুলো আলোচিত হয়েছে দ্বাদশ ঢেউ হিসেবে, টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায়ের ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্স্পেক্টিভ’ নিবন্ধে।
রঙিন বিপ্লব
নভেম্বর, ২০০২। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে প্রায় এক যুগ। নভেম্বর মাসের শুরুতেই জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় সংসদীয় নির্বাচন, প্রশ্নবিদ্ধ সে নির্বাচনে আবারো বিজয়ী হয়ে আসেন তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এডওয়ার্ড শেভার্ডনাদজে। নির্বাচনের পরদিন থেকেই শুরু হয় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, উচ্চারিত হয় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি। রাষ্ট্রপ্রধান এডওয়ার্ড শেভার্ডনাদজে আন্দোলন দমনে মোতায়েন করেন সামরিক বাহিনীকে, হুমকি দেন কঠোরভাবে আন্দোলন দমনের।
হুমকিতে থেমে থাকেনি আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গোলাপ ফুল দেওয়া শুরু করেন। আন্দোলনকারীদের সাথে সামরিক বাহিনীর একাত্মতা, সিভিল সোসাইটির কার্যকর ভূমিকা আর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা আন্দোলনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, নভেম্বরের শেষদিকে পদত্যাগ করেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট।
২০০৩ সালের নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসে জর্জিয়া রাষ্ট্রকাঠামোতে, মোটাদাগে বদলে যায় রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ। দ্রুতই নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় জর্জিয়াতে, বিজয়ী হয়ে আসেন আন্দোলনকারীরাই। নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ বিপ্লবের সবগুলো যোগ্যতা বহন করে, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গোলাপের মাধ্যমে শান্তির বার্তা দেওয়ার অন্যন্য ঘটনায় এই বিপ্লব পরিচিত পায় রোজ বিপ্লব নামে।
পরের বছর রঙিন বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে পূর্ব ইউরোপের আরেক দেশে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ইউক্রেনে। প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে এস্টাবলিশমেন্টের সহযোগিতায় নির্বাচিত হন রুশপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। নির্বাচনের পরপরই ইউক্রেনে বিক্ষোভ শুরু হয়, দাবি ওঠে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে নতুন করে নির্বাচিত দিতে। বিরোধীদের ক্রমাগত আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট, নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। পরে আয়োজিত হয় নতুন নির্বাচন, এতে জয়ী হন অরেঞ্জ বিপ্লবের সমর্থকেরা।
নতুন নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে আসেন ভিক্টর ইউশচেঙ্গো, সরকার গঠন করেই শুরু করেন সংবিধান পরিবর্তনের কাজ। নতুন সংবিধানে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা হয় প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে, স্বাধীন সাংসদদের দুর্নীতি রোধে আনা হয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সুযোগ হয় একটি শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি তৈরির।
এসব পরিবর্তনের পরও অরেঞ্জ বিপ্লব ইউক্রেনের বিভাজিত সমাজকে একত্র করতে পারেনি, বরং গাঢ় হয়েছে পূর্ব আর পশ্চিমে বিভাজন। বিপ্লব বদল আনতে পারেনি ইউক্রেনের সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, ২০১০ সালের নির্বাচনে আবার বিজয়ী হয় অরেঞ্জ বিপ্লব বিরোধীরা। বিপ্লব পরিবর্তন আনতে পারেনি অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাবে, কমেনি রাশিয়ার প্রভাব। তবে, তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়েছে নির্বাচন কমিশন, আয়োজিত হয়েছে নিরপেক্ষ ও ন্যায্য নির্বাচন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য এশিয়ার যেসব দেশকে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়েছিল, কিরগিজস্তান তার মধ্যে অন্যতম। নব্বই দশকের শুরুর দিকেই এখানে স্বাধীন গণমাধ্যম গড়ে ওঠে, অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য। কিরগিজস্তান পরিচিতি পায় ‘গণতন্ত্রের দ্বীপ’ হিসেবে। শুরুর দিকের এই রাজনৈতিক উন্নয়নগুলো ধরে রাখতে পারেনি দেশটি, দ্রুতই ঢুকে যায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে। প্রেসিডেন্ট আস্কার আকায়েজ ক্ষমতায় টিকে থাকতে ক্রমাগত বাকস্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। ব্যর্থ হন কিরগিজস্তানকে কতিপয়তন্ত্র থেকে বের করতে। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে বেকারত্ব, ক্রমাগত কমতে থাকে আকায়েজ সরকারের জনপ্রিয়তা।
২০০৫ সালে কিরগিজস্তানের নাগরিকেরা আকায়েজ সরকারের এই কর্তৃত্ববাদ আর ব্যর্থতার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে, দাবি করে সরকারের পদত্যাগের। রঙিন বিপ্লবের অংশ হওয়া বিপ্লবের নাম হয় টিউলিপ বিপ্লব। এর ফলে পতন ঘটে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আকায়েজ সরকারের, সুগম হয় কার্যকর গণতন্ত্রের পথে কিরগিজস্তানের যাত্রা।
রঙিন বিপ্লবের প্রভাব পড়ে আরেক সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশ বেলারুশেও। ১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশের ক্ষমতায় আলেকজেন্ডার লুকাশেঙ্গো, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে ছিলেন ক্ষমতায়। পাতানো নির্বাচন আয়োজন করে নিজের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার প্রথা অনুসরণ করেন ২০০৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনেও, কারচুপির নির্বাচনে পান ৮৩ শতাংশ ভোট। প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের মতো বেলারুশেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়, মিনস্কের অক্টোবর স্কয়ার চলে যায় বিপ্লবীদের দখলে। বিশাল বিক্ষোভ সত্ত্বেও বেলারুশে এ সময় কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন আসেনি, রাশিয়ার কম মূল্যের তেল আর গ্যাসের উপর নির্ভরশীল এ দেশ বেরিয়ে আসতে পারেনি রুশ প্রভাব বলয় থেকে। নাগরিক সমাজের অকার্যকর ভূমিকা আর সামরিক বাহিনী এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে কাজ করার ফলে, জিন্স বিপ্লব নামে পরিচিত বেলারুশের এই বিপ্লব পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রঙিন বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত। রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লব, জিন্স বিপ্লবের বাইরেও রঙিন বিপ্লবের প্রভাব পড়ে আজারবাইজানে, প্রভাব পড়ে আজারবাইজানের প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়াতেও। প্রভাব পড়ে ক্রোশিয়াতে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল সার্বিয়াতেও।
রঙিন বিপ্লবের অর্জন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্ধশতাব্দী ব্যাপী লড়াই চলেছে দুই মতাদর্শ- গণতন্ত্র আর কমিউনিজমের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার একক গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গণতন্ত্র আসে রাশিয়াতে, আসে সোভিয়েতের অংশ হয়ে থাকা মধ্য এশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে থাকা দেশগুলোতেও। শুরুতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় এসব দেশে। তৈরি হয় রাজনৈতিক দল, নির্বাচন অবকাঠামো, সংবিধানের মতো কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু, আধুনিক গণতন্ত্র পাঠের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, কোনো দেশে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই বিপ্লব পরিপূর্ণ হয় না, পাওয়া যায় না গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ কাজ করার নিশ্চয়তা। বরং, মানুষের চরিত্র যেমন জবাবদিহিতার অভাব থাকলে ক্রমাগত পতনের দিকে যায়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করা গেলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও একইরকম পতন হয় রাজনৈতিকভাবে। এ সুযোগ নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতারা কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন, রাজনৈতিক অবতারবাদের সূচনা হয়, অকার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে টিকে থাকেন স্বৈরশাসকেরা।
অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে হলে ক্রমাগত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, সামাজিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হলে থাকতে হবে কার্যকর সিভিল সোসাইটি। আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের দ্বাদশ ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া রঙিন বিপ্লব রাজনীতিবিজ্ঞানের এই ধ্রুপদী সত্যটিকে ধারণ করে। তুলনামূলকভাবে নতুন গণতন্ত্রের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া এই রঙিন বিপ্লবের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে, শাসনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায়।
প্রথমত, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নাগরিকদের অন্যতম একটি প্রাথমিক রাজনৈতিক অধিকার হলো নিয়মিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ। এ অধিকার নাগরিকেরা ভোগ করতে পারে কার্যকর নির্বাচনী অবকাঠামো থাকলে, কার্যকর নির্বাচন কমিশন থাকলে। জবাবদিহিতা না থাকলে, অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো নির্বাচনী অবকাঠামোও ক্রমাগত পতনের দিকে ধাবিত হয়। রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে নব্বই দশকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনী অবকাঠামোগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জর্জিয়া, ইউক্রেনের মতো দেশগুলোতে মোটাদাগে নিরপেক্ষ ও ন্যায্য নির্বাচন হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মধ্যে এশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে শাসনতন্ত্র হিসেবে গণতন্ত্র গৃহীত হয়। এ সময়টাকে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকাল ধরলে, রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে এসব দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। জর্জিয়া, কিরগিজিস্থানের রঙিন বিপ্লবের প্রভাবযুক্ত দেশগুলোর উদাহরণগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব দেশে কার্যকর সিভিল সোসাইটি ছিল। আর তাই সেখানে বিপ্লবের ইতিবাচক ফলাফল এসেছে দ্রুত, সহজ হয়েছে বিপ্লবের অর্জনগুলো ধরে রাখা। বেলারুশে জিন্স বিপ্লব ব্যর্থ হয় সিভিল সোসাইটির অকার্যকর ভূমিকার জন্যই, এখনো টিকে আছে স্বৈরশাসক।
তৃতীয়ত, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গণমাধ্যমগুলো, নিশ্চিত করতে পারে সরকারের জবাবদিহিতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমের ভূমিকা দেখা যায় রঙিন বিপ্লবের সময়টাতেও। জর্জিয়ার রোজ বিপ্লব সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম, একই ভূমিকা দেখা গেছে ইউক্রেন আর কিরগিজিস্থানেও। কিরগিজিস্থান এর পরও আরো কয়েকটি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছে, বার বার আন্দোলন করতে হয়েছে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে। বিপ্লবগুলোর সফলতার অন্যতম নির্ণায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল গণমাধ্যমের ভূমিকা। ভূমিকা ছিল পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক প্রভাবকগুলোরও।
বিপ্লবের সবগুলো লক্ষ্যই কি অর্জিত হয়েছে?
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার যে লক্ষ্য নিয়ে রঙিন বিপ্লব শুরু হয়েছিল, গত দুই দশকে তার অল্পই বাস্তবায়িত হয়েছে। বরং, রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট বারবার সুযোগ খুঁজেছে এ অর্জনগুলোকে পাশ কাটিয়ে কর্তৃত্ববাদী হতে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে স্বৈরাচারী হতে উৎসাহ জুগিয়েছে এই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট। এ রকম আরো কিছু প্রভাবকের জন্যই রঙিন বিপ্লব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে নাগরিক প্রত্যাশা পূরণে।
প্রথমত, বিপ্লব চলাকালে এক লক্ষ্যে বাঁধা ছিলেন বিপ্লবীরা, ছিল না স্বার্থের সংঘাতও। এক ছাতার নিচে এসেছিলেন সকল সংস্কারপন্থী, এসেছিলেন সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাও। বিপ্লবের প্রাথমিক লক্ষ্য স্বৈরাচারের পতনের পর বদলে যায় রাজনৈতিক সমীকরণ, উপস্থিত হয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ইউক্রেনের মতো বিভিন্ন জায়গায় বিভক্ত হয়ে যান বিপ্লবীরা। এ বিভক্তি বাধাগ্রস্ত করে বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়াকে।
দ্বিতীয়ত, মধ্য এশিয়া আর পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশে রঙিন বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল, সেসব দেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠী রয়েছে, যারা সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদ থেকে সবসময় বড় অংশটা নিজের জন্য নিশ্চিত করতে ইচ্ছুক। এ স্বার্থগোষ্ঠী বিপ্লবের ফলে পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিল না, আগ্রহী ছিল না রাষ্ট্রক্ষমতায় বিপ্লবী মতাদর্শের কাউকে দেখতে। অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীর এ রক্ষণশীলতা বাধাগ্রস্ত করেছে বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরুর প্রায় কাছাকাছি সময়েই মানুষ আমলাতন্ত্র তৈরি করেছিল। বেসামরিক আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিচালনা করেছে, সামরিক আমলাতন্ত্রের দায়িত্ব ছিল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। ক্রমে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে, শাসনকাঠামোতে বেড়েছে তাদের ভূমিকা। পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে রাজার আমলে আমলাতন্ত্র ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পেয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে সুযোগ পেয়েছে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার। রঙিন বিপ্লবের ফলে যে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার কথা ছিল, তাতে সংকুচিত হতো আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা, জবাবদিহিতার আওতায় আসত তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ। আমলাতন্ত্রের বড় একটা অংশই এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাননি, বাধাগ্রস্ত হয়েছে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া।
চতুর্থত, গত এক দশকে বদলে গেছে গণমাধ্যম। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে অনলাইন মিডিয়া হয়ে উঠেছে সংবাদের প্রধান মাধ্যম, সংকুচিত হয়ে এসেছে গণমাধ্যমের আয়ের উৎস। রঙিন বিপ্লবের প্রভাব যেসব দেশে পড়েছিল, সেসব দেশেও দেখা গেছে একই ধারা। গণমাধ্যমগুলোকে এখন যেতে হচ্ছে বড় বড় কর্পোরেশনের অধীনে, সময়ের সাথে রক্ষা করতে হচ্ছে তাদের স্বার্থ। গণমাধ্যমের সামনে আসা এ নতুন সমীকরণ বাধাগ্রস্ত করেছে স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতাকে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীর কারণেও।
রঙিন বিপ্লব কি সমাপ্ত হয়েছে?
আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা জানি যে, রাজনৈতিক গণতন্ত্র দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হলেও, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়। এ শতাব্দীর প্রথম দশকের যেসব ঘটনা আমরা আলোচনা করেছি, তার পরেও এসব দেশে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। ২০০৫ সালে কিরগিজিস্থানে টিউলিপ বিপ্লবের পর দ্বিতীয় কিরগিজ রেভল্যুশন হয়েছে। ২০২০ সালে স্বৈরাচারী হয়ে উঠা প্রেসিডেন্টকে আবারো ক্ষমতাচ্যুত করেছে বিপ্লবীরা। বেলারুশে এখনো চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন, রঙিন বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছে খোদ রাশিয়াতেও। সংস্কারপন্থীরা পদত্যাগ চাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের, চাচ্ছেন শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন। তাই, সমাপ্ত হয়নি রঙিন বসন্ত।
আধুনিক গণতন্ত্রের ধারাবাহিক আলোচনার দ্বাদশ পর্ব ছিল এই শতাব্দীর শুরুতে পূর্ব ইউরোপ আর মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া রঙিন বিপ্লব নিয়ে। বারো পর্বের এই ধারাবাহিক আলোচনা আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একটি জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকের অর্জনের বিষয়। কোনো দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে কর্তৃত্ববাদী উপাদানের বিস্তার ঘটলে বুঝতে হবে, নাগরিকরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অর্জন করতে শেখেনি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো চর্চাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না। গণতন্ত্র একটি ক্রমাগত চর্চার বিষয়, ক্রমাগত শাসকশ্রেণিকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখলেই টিকে থাকে গণতন্ত্র।
তবে দেশে দেশে বর্তমান সময়ে যে হাইব্রিড রেজিমের উত্থান হচ্ছে, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান হচ্ছে, এটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে না। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদ আর জনতুষ্টিবাদের উত্থান হচ্ছে, সেসব দেশের অধিকাংশই তুলনামূলক নতুন গণতন্ত্র। এসব দেশের নাগরিকেরা এখনো মানসিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে রাজতন্ত্রের কাঠামো থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। মূল্যবোধের এ পরিবর্তনের জন্য সময় প্রয়োজন। কয়েক দশক রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে খুব অল্প সময়।
পৃথিবীর সব প্রান্তে গণতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ুক, প্রতিটি মানুষ ধারণ করতে শিখুক উদার গণতন্ত্রের মূল্যবোধগুলো।