আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বিভিন্ন বিষয় এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, মাঝেমধ্যে সেসবের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমাদের বেশ অবাকই হতে হয়। হয়তো খেলার সম্পর্কে কোনো বিষয় নিয়ে আপনি ভাবিত, দেখা গেল সেই বিষয়টির গুরুত্ব খেলার থেকেও বেশি রাজনীতির আঙিনাতে প্রতিফলিত হচ্ছে।
এরকম একটি উদাহরণ দেওয়া যায় সাম্প্রতিক সময় থেকেই। গত ১৩ জুন মস্কোতে ফুটবলের আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থা ফিফা জানায়, ২০২৬ সালের বিশ্বকাপের আয়োজন যুগ্মভাবে করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মেক্সিকো। আটচল্লিশ দেশের সেই মহারণ যদিও এখনও আট বছর দূরে, কিন্তু বর্তমান সময়ে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের ওই তিনটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক এতটাই খারাপ যে, প্রায় এক দশক পরে তারা যে একসঙ্গে কোনো প্রকল্প সফলভাবে করতে পারে, তা বিশ্বাস করতে বেশ কষ্টই হয়।
আশার কথা একটাই- আট বছর পরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প আর হোয়াইট হাউসে থাকবেন না, দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও না। এক যদি না তিনি দেশের সংবিধান বদলে কিছু একটা নাটকীয় করতে চান, তবে সে পথ কতটা সফল হবে তা বলা মুশকিল।
যখন ট্রাম্প যখন তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রবল লড়ছেন জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে, তখনই এল ‘সুখবর’
ফিরে আসা যাক ২০২৬-এর ফুটবল বিশ্বকাপের কথায়। যদিও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প তার অতি-জাতীয়তাবাদী মুখটি দেখাতে গিয়ে চটিয়েছেন কানাডা এবং মেক্সিকোকে- এই দেশগুলো থেকে আমদানি হওয়া ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের উপরে কড়া শুল্ক বসিয়ে মার্কিন স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে চেয়েছেন; অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমানা বরাবর উঁচু পাঁচিল তুলে দিতে চেয়েছেন। ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ এই তিন দেশকে আয়োজন করার দায়িত্ব দিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে বেশ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে ফিফা, যদিও কূটনীতি বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে হয়তো তার কোনো যোগাযোগই নেই।
কিন্তু খেলার মাধ্যমে কীভাবে দেওয়া হলো এই অদ্ভুত মাস্টারস্ট্রোকটি?
ব্যাপারটি অনেকটা এরকম।
ট্রাম্প এই মুহূর্তে মার্কিন স্বার্থের পক্ষে জোর সওয়াল তুলেছেন ঠিকই (যদিও এই সওয়ালের মধ্যে কতটা যুক্তি রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়) কিন্তু বিশ্বকাপের আয়োজনের কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দুই প্রতিবেশী দেশের কাঁধে পড়া মানে এখন আর্থিক সমীকরণটিই পরিবর্তিত হবে নিঃসন্দেহে। যদি মার্কিন প্রশাসন উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অথবা ‘নাফটা’কে (নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) বাতিল বা পর্যটকদের ভিসার ব্যাপারে কড়া অবস্থানে অটুট থাকে, তাহলে বিশ্বকাপের আগে ও চলাকালীন ক্ষতির মুখে পড়বে স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই।
বিশ্বকাপের আয়োজনের সময়ে নাফটা বাতিল করা হলে ভুগবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই
বিশ্বকাপের মতো বড় অনুষ্ঠান সংগঠন করা মানে প্রচুর অর্থনৈতিক মুনাফার সম্ভাবনা তৈরি করা। কারণ, একটি বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি পর্বে পরিকাঠামো তৈরি এবং মেরামতি এবং আনুষঙ্গিক শিল্পে জোয়ারের মাধ্যমে আয়োজক দেশের অনেক অর্থনৈতিক লাভ হয়।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প রাষ্ট্রনেতার থেকেও বড় ব্যবসায়ী আর তিনি ভালো করেই জানেন যে বিশ্বকাপ আয়োজনের এই সুযোগে তার দেশের নানা উৎসাহী সংস্থা কানাডা এবং মেক্সিকোতে গিয়ে সেখানকার পরিকাঠামো শিল্পকে উন্নত করার বরাত পেতে পারে। আর এজন্যই প্রয়োজন নাফটার মতো চুক্তির অস্তিত্ব রক্ষা। যদি ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ওয়াশিংটন নাফটা বাতিল করে এবং কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে বিবাদ আরও বাড়ায়- ঠিক যেভাবে ট্রাম্প করলেন সদ্যসমাপ্ত জি৭ সম্মেলনে- তাহলে অদূর ভবিষ্যতে অটোয়া এবং মেক্সিকো সিটির সরকারও ওয়াশিংটন ডিসির সংস্থাগুলোর মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দেবে; তা বিশ্বকাপের আগে হলেও।
আর ঠিক যেভাবে মার্কিন সংস্থাদের আশা নিমেষে শেষ হয়ে যেতে পারে, তেমনই দরজা খুলে যেতে পারে চীনের সামনে। সস্তায় এবং প্রবল উৎসাহে মহাযজ্ঞ করার সুনাম চীনের এমনিতেই রয়েছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আজকের অন্যায্য ব্যবহারে ক্ষুব্ধ কানাডা এবং মেক্সিকোর সামনে তখন প্রতিশোধ নেওয়ার এক দারুণ সুযোগ এসে যাবে। অথচ, নিজের দায়িত্বে সবার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনেও তখন আর মুখ লুকোনো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
কানাডা এবং মেক্সিকোর হাতে নিদারুণ অস্ত্র তুলে দিয়েছে ফিফা
আট বছর পরের বিশ্বকাপ নিয়ে তাই এখনই কানাডা এবং মেক্সিকোর হাতে অস্ত্র তুলে দিল ফিফা। ট্রাম্প যদিও নিজে সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকবেন না, কিন্তু তার সময়কার নীতির কারণে সেই সময়ে চূড়ান্ত মাশুল গুণতে হতে পারে তার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আর বিশেষ করে যে চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প জান-প্রাণ দিয়ে লড়ছেন, তারা যদি তার একগুঁয়ে মনোভাবের ফায়দা তুলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী অঞ্চলে, তাহলে হোয়াইট হাউসের নীতি প্রণয়নকারীদের কাছে তা সম্মুখ পরাজয়ের সমান বলেই বিরোধীরা সরব হবে।
২০২৬ সালের বিশ্বকাপ তাই উত্তর আমেরিকার তিন বৃহত্তম দেশকে আয়োজন করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মার্কিন বিদেশনীতিকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে নিঃসন্দেহে।
ট্রাম্পের কণ্ঠে কি এখন নাফটার সপক্ষে সওয়াল করতে শোনা যাবে?
ট্রাম্প যদিও বেজায় খামখেয়ালি, কিন্তু তার কণ্ঠে এখন নাফটাকে রদ করার দাবি কতটা শোনা যাবে সেটাই দেখার বিষয়। রাষ্ট্রপতির লাগাম হাতে নিয়েও ট্রাম্প অনেক ক্ষেত্রেই তার মনের মতো সিদ্ধান্তকে বলবৎ করে উঠতে পারেননি, মনে মনে বিরক্ত হয়েছেন কিন্তু কিছু করতে পারেননি কারণ মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবল শক্তিধর রাষ্ট্রপতিকেও কিছু নিয়মবিধির মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। এখন বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব তার দেশের ঘাড়ে পড়াতে ট্রাম্পকে যে নতুন করে জাতীয় লাভক্ষতির অঙ্ক করতে হবে, সে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে প্রকাশ্যে গিলতে হবে নিজের কথাই; অপরদিকে স্বস্তির নিঃশেষ ফেলবে কানাডা এবং মেক্সিকোর নেতৃত্ব।
ট্রাম্প যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিকে ভুল পথে চালনা করে ভ্রান্তি বাড়াচ্ছেন, ওয়াশিংটনের পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে মিছে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন, তাতে যে ভবিষ্যতে একদিন হোয়াইট হাউসকে বড়সড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ট্রাম্প আজকে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত যোগ্যতাকে দুনিয়ার সামনে বেআব্রু করছেন, তাতে তার পরবর্তী প্রশাসককে কম ঝক্কি পোহাতে হবে না। কিন্তু যেরকমভাবে সম্পূর্ণ একটি অরাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ট্রাম্প এবং তার গোঁয়ার রাষ্ট্রনীতিকে বেসামাল করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সম্প্রতি, তা যথেষ্ঠ অভিনব।
Featured Image Source: Video | The Australian