স্বাধীনতার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ধারাবাহিক গণতন্ত্র, গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। প্রায় আড়াইশো বছরের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোগত অবস্থানকে ক্রমাগত শক্তিশালী করেছে, শক্তিশালী করেছে গণতান্ত্রিক আর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই উদার বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা। জাতিসংঘ, আইএমও, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছে বৈশ্বিক রাজনীতি, নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলোর অর্থনীতিও। বৈশ্বিক এ পরাশক্তির দেশে, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম এই প্রেসিডেন্টের ছিল না আইনসভাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা, ছিল না প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকে উঠে আসার উদাহরণও। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়টুকুতে একের পর এক বেফাঁস মন্তব্য করেছেন, বলেছেন একের পর এক মিথ্যা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছেন এ বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারিকে সামাল দিতে। ফলে তিনি হেরেছেন ২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন, বিদায় নিতে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত প্রেসিডেন্টদের একজন, জনতুষ্টিবাদী নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভিন্ন দিকও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত রাজনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে কাজ করা এই প্রেসিডেন্টের রয়েছে উল্লেখ করার মতো সাফল্য।
বিচারব্যবস্থায় রক্ষণশীলদের আধিপত্য
তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই রাজনীতি নির্ধারিত হয় রাজপথে, রাষ্ট্রের মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয় ক্ষমতাসীন দলের সাথে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরিণত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ নির্ধারিত হয় আইনসভার বিতর্কে, বিচার বিভাগের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভপাত, সমলিঙ্গের বিয়ের মতো অনেকগুলো ইস্যুতেই বিভাজিত আমেরিকান সমাজ, বিভাজিত আমেরিকান রাজনীতি। এসব ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিচার বিভাগ।
ফলে, বিচার বিভাগে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আমেরিকান রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্সিতে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিয়েছেন তিন বিচারক, প্রতিষ্ঠা করেছেন রক্ষণশীলদের আধিপত্য। ফেডারেল কোর্টে নিয়োগ দিয়েছেন ২২০ জন বিচারক, সার্কিট কোর্টে নিয়োগ দিয়েছেন আরো ৫৩ জন বিচারক। ফলে, কয়েক দশকের জন্যই বিচার বিভাগ চলে গেছে রক্ষণশীল ভাবাদর্শের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বাহিনী
প্রাচীনকালে ঢাল-তলোয়ারের যুদ্ধের যুগ পেরিয়েছে, পেরিয়েছে মধ্যযুগে বিশাল সামরিক বাহিনী তৈরি করে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার আবেদনের যুগও। তথাপি, বিশ্বব্যাপী রয়ে গেছে স্বার্থের সংঘাত, রয়ে গেছে যুদ্ধ। আধুনিক যুগে সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র, যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। স্থল, নৌ আর আকাশের পরে সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে অন্তহীন মহাকাশ।
ভবিষ্যতের নিরাপত্তা আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে মাথায় রেখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিতে যুক্ত হয়েছে নতুন একটি বাহিনী, যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ষষ্ঠ বাহিনী এটি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেনারেল ডব্লিউ রেমন্ড।
অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর মহাকাশ সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছাবে না, সম্ভাবনা নেই মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংঘাত তৈরি করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ বাহিনীর কাজ হবে রক্ষণশীল ঘরানার, মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদগুলোকে রক্ষা করবে এ বাহিনী। বিভিন্ন যুদ্ধে প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে সামরিক বাহিনীর অন্য অংশগুলোকে, সরবারহ করবে প্রযুক্তিগত সহায়তা।
সামরিক সাফল্য ও প্রতিরক্ষানীতি
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনীর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সামরিক খাতে, ব্যয় হয় নাগরিকদের আর সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে, বিভিন্ন স্থানে শান্তিরক্ষী হিসেবে প্রেরণ করতে হয়েছে সৈন্যদেরকে। এই যুদ্ধগুলোর সাথে বিভিন্নভাবে বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রশ্নটি জড়িয়ে যাওয়ায়, একক পরাশক্তি হওয়ার বাসনায় বিভিন্ন যুদ্ধে বিপুল ব্যয় করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
যুক্তরাষ্ট্র যখনই এসব যুদ্ধে জড়িয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয়, আনুপাতিকভাবে কমেছে যুদ্ধ থেকে সরে এলে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে এসে এ সমীকরণের ব্যতিক্রম দেখে যুক্তরাষ্ট্র। তার আমলে নতুন কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্র, তবু ক্রমাগত বেড়েছে সামরিক ব্যয়। এই বাড়তি অর্থ ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যয় করেছে সামরিক বাহিনী আধুনিকায়নে, ব্যয় করেছেন সামরিক বাহিনীর জন্য নতুন নতুন বিমান কেনার কাজে, সৈনিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার কাজে।
আইএসকে পরাস্ত করা
প্রতিটি যুদ্ধ বয়ে আনে অন্তহীন দুর্ভোগ, সেখান থেকে তৈরি হয়ে নতুন সংঘাতের পটভূমি। সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র, জড়িয়ে পড়তে থাকে নতুন নতুন যুদ্ধে। বারাক ওবামার আমলে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তৈরি হওয়া পাওয়ার-ভ্যাকুয়ামকে পূরণ করতে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠে অনেকগুলো চরমপন্থী সংগঠন, তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে সবচে বেশি আলোচনায় আসে আইএস। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের ‘লোন-উলফ’ দিয়ে হামলা চালিয়ে বৈশ্বিকভাবে নিরাপত্তার ধারণার সংকট তৈরি হয়, অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে মূলধারার সাথে যুদ্ধের। হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়া আইএসের অর্থনৈতিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস ছিল তেল-মুনাফা।
নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বনের অভিযোগ থাকলেও প্রেসিডেন্সির সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আইএসকে মোটা দাগে পরাস্ত করেছেন, হত্যা করছেন আইএসের প্রধান আবু-বকর আল-বাগদাদিকে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি হুমকি হয়ে ওঠা ইরানি জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকেও হত্যার ‘কৃতিত্ব’ পাবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অর্থনীতি
২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে, পপুলার ভোটে বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্প কম পেয়েছেন প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ভোট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এক বাক্যে স্বীকার করছেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয়টি সামনে না আসলে এবারও নির্বাচনে হয়তো উতরে যেতে পারতেন ট্রাম্প। প্রকৃত অর্থেই, করোনাভাইরাসের আক্রমণের আগে ধনকুবের এই ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্টের আমলে ভালো অবস্থায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি।
অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ যেখানে প্রবৃদ্ধির হার ১.৫ শতাংশ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল ২ শতাংশের উপরে। বেকারত্বের হার নেমে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার পরে সর্বনিম্ন হারে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেকার ছিল মাত্র ৩.৫ শতাংশ আমেরিকান। ভালো অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার, চীনের সাথে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধের সুবিধা পাচ্ছিল অভ্যন্তরীণ শিল্পগুলো। ইউরোপের স্টিল-আয়রনজাত পণ্যের ওপর করারোপের সুবিধা পাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এ খাতে জড়িতরা।
করকাঠামোর সংস্কার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন দু’টি পেশা থেকে। ট্রাম্পের পূর্ববর্তী ৪৪ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ৩২ জন কাজ করেছেন সামরিক বাহিনীতে, এদের মধ্যে নয়জন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জেনারেল। বাকিরা বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভাতে, কাজ করেছেন বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর হিসেবে। কিন্তু, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম প্রেসিডেন্ট, যার আসলে এ ধরনের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে, প্রথাগত রাজনীতিবিদদের কাঠামোর বাইরে থেকে আসা এই ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট বিভিন্নভাবে সুবিধা দিয়েছেন কর্পোরেট শ্রেণিকে; করকাঠামোর সংস্কার এ শ্রেণিকে দেওয়া সুবিধাগুলোর একটি।
করকাঠামো সংস্কার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্পোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনেন ২১ শতাংশে, বিশেষ সুবিধা দেন কিছু স্বার্থগোষ্ঠীকে। ফলে, বেড়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ, বেড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, তৈরি হয়েছে চাকরির সুযোগ।
প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে থেকে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্প বদলে দিয়েছেন রাজনীতির মানচিত্র, বিভাজিত করেছেন আমেরিকান সমাজকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অশ্রদ্ধা আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার হেঁয়ালিপনা তাকে করেছে এক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট। তবে, আমেরিকার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থেকে যাবে ট্রাম্পিজম, থেকে যাবে ট্রাম্পের বিভাজনের রাজনীতি।