নিবন্ধের শুরুতে পাঠকদের এমন একটি ইউটোপিয়ান সমাজে নিয়ে যেতে চাই, যেখানে পরিপূর্ণ আইনের শাসন আছে, নাগরিকদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা শূন্যের কোঠায়, নাগরিক নিরাপত্তার ব্যাপারে আইনি কাঠামোর পাশাপাশি রয়েছে পারস্পরিক সমঝোতা। এমন এক সমাজে দুজন আগন্তুকের আগমন ঘটলো, যারা এসেই আমাদের কল্পিত সমাজে একটি চুরির ঘটনা ঘটায়, এবং চুরির সাথে যে সেই দুই আগন্তুক জড়িত, সেটি স্থানীয় লোকজন জেনে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দুই চোরকে গ্রেপ্তার করার আগেই আমাদের কল্পিত সমাজে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে, যার সাথে আগন্তুক চোরেরা জড়িত নয়। কিন্তু, যেহেতু চুরির ঘটনার সাথে সম্পৃকতা ছিল, সেহেতু মানুষজন ধরে নেয় ডাকাতির ঘটনাও তারাই ঘটিয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দুই চোরকে গ্রেপ্তার করে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। দুজনই চুরির অভিযোগ স্বীকার করলেও ডাকাতির অভিযোগ অস্বীকার করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন তখন প্রথম আগন্তুককে শর্ত দেয়, সে যদি নিজের চুরির অভিযোগ স্বীকার করে এবং সাক্ষী দেয় যে ডাকাতি অপর আগন্তুক করেছে, তাহলে সে দুই বছরের সাজা পাবে, দ্বিতীয়জন ডাকাতির জন্য পাবে দশ বছরের সাজা। একই শর্ত পুলিশ দেয় দ্বিতীয় আগন্তুককেও।
এরকম পরিস্থিতিতে নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে রাখার তাড়না থেকে, নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ না থাকার কারণে দুই আগন্তুকই রাজি হয়ে যাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের শর্তে এবং দুজন দাঁড়িয়ে যাবে একে অপরের বিপরীতে। কিন্তু, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যদি দুই আগন্তুককে একই জায়গায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করত, তাহলে দুই আগন্তুক যোগাযোগের সুযোগ পেত এবং একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতো না। একইরকম পরিস্থিতি পরিচিত ‘হবসিয়ান ট্র্যাপ’ নামে।
একটি দেশের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা এই হবসিয়ান ট্র্যাপের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। আধুনিক যুগের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিটি রাষ্ট্র রাজনীতির মূল একক হিসেবে কাজ, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত চলে সম্পদের অধিকার নিয়ে প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হওয়ায় বন্ধুত্ব হয় কেবলই জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে। প্রতিযোগিতা আর অবিশ্বাস রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের মনে সবসময় হেরে যাওয়ার ভয় তৈরি করে রাখে, বজায় রাখে মর্যাদা আর সার্বভৌমত্ব হারানোর ভয়। এই ভয় থেকেই, সম্পদের উপর কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সামরিক বাহিনী তৈরি করে, সামরিক বাহিনীর উপর বিপুল বিনিয়োগ করে। সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, মর্যাদা হারানোর ভয় আর পারস্পরিক অবিশ্বাস না থাকলে সামরিক বাহিনীর উপর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নির্ভরশীলতা কমে যেতো।
সামরিক বাহিনীতে নারী নেতৃত্ব
আদিমকাল থেকেই মানুষ অভ্যন্তরীণ শত্রু আর বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজের জীবিকা রক্ষার জন্য নির্ভর করেছে সামরিক বাহিনীর উপর, সার্বভৌমত্বের অধিকার আবর্তিত হয়েছে সামরিক বাহিনীকে কেন্দ্র করে। আদিমকাল থেকেই সামাজিক কাঠামোতে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্মানের চোখে দেখা হয়, দেখা হয় জাতীয় বীর হিসেবে। পৃথিবীর ইতিহাস আসলে রচিত হয়েছে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ত্যাগ আর বীরত্বের মধ্য দিয়েই।
সামরিক বাহিনীগুলোর ইতিহাসে বেশ কয়েকজন নারী সেনাপতির কথা জানলেও, সামরিক বাহিনীতে সাধারণত সংখ্যা আর নেতৃত্বে প্রাধান্য থেকেছে পুরুষদেরই। রক্ষণশীল সমাজগুলোতে নারীদের সুযোগ ছিল না সামরিক বাহিনীতে কাজ করার, সাংস্কৃতিকভাবেও নারীদের সামরিক বাহিনীতে কাজকে উৎসাহিত করা হতো না। জাতিরাষ্ট্রের যুগে এসে বদলেছে এই পরিস্থিতি, সামরিক বাহিনীর প্রায় সব কোর আর ফ্রন্টে পুরুষ সদস্যদের মতোই ভূমিকা রাখছে নারীরা সদস্যরা, অর্জন করছেন সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ দায়িত্বগুলো।
সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফোর স্টার জেনারেলের র্যাংক অর্জন করেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অ্যান এলিজাবেথ ডানউডি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে বিভিন্ন র্যাংকে প্রায় ৬০ জন জেনারেল কাজ করছেন। থ্রি-স্টার জেনারেল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নারী সদস্যরা নিয়মিতই অর্জন করলেও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম লেফটেন্যান্ট জেনারেলের র্যাংক অর্জন করেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর পুনিতা আরোরা, সম্প্রতি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের র্যাংক অর্জন করেছেন নিগার জোহর খান। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান অংশ, সেনাবাহিনীতে প্রথম নারী হিসেবে মেজর জেনারেলের র্যাংক অর্জন করেছেন সুসানে গীতি।
মেজর জেনারেল সুসানে গীতি
মেজর জেনারেল সুসানে গীতির বাবা খলিলুর রহমান ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির নিগুঢ়তম, নিবিড়তম আকাঙ্ক্ষা, পরমপ্রিয় স্বাধীনতা অর্জনে শহীদ হন। সুসানে গীতির স্কুলজীবন কেটেছে রাজশাহীর পি এন গার্লস স্কুলে, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাশ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সুসানে গীতি, ছয় মাসের স্বল্পমেয়াদী কোর্স শেষে ক্যাপ্টেন হিসেবে কমিশন লাভ করেন।
সেনাবাহিনীর প্রতিটি পদ আর দায়িত্বই শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মতান্ত্রিক কাজ আর কর্তব্যবোধ দিয়ে পালন করেছেন সুসানে গীতি, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন পদোন্নতি। ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজিতে এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করেন সুসানে গীতি। জাতিসংঘের প্রথম বাংলাদেশ মেডিকেল মিশনের সদস্য ছিলেন সুসানে গীতি, ফ্রি ফ্রাইডে মেডিকেল সার্ভিস চালু করে লাইবেরিয়ার গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষদের দিতেন চিকিৎসাসেবা। ফ্রি ফ্রাইডে মেডিকেল সার্ভিস অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে লাইবেরিয়াতে।
আর্মি মেডিকেল কোর তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নারী কর্নেল ছিলেন রোকেয়া আনিস, প্রথম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন সুরাইয়া রহমান। সামরিক বাহিনীর সফল এই নারীদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে আসা সুসানে গীতি ছাড়িয়ে যান সবাইকে; ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদোন্নতি পান মেজর জেনারেল হিসেবে। আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাবাহিনীর প্রধান ও কোয়াটারমাস্টার জেনারেল র্যাংকব্যাচ পরিয়ে দেন মেজর জেনারেল সুসানে গীতিকে। বর্তমানে মেজর জেনারেল সুসানে গীতি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
মেজর জেনারেল সুসানে গীতির উদাহরণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ব্রান্ডিট লাইনের দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ, পার করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে সামাজিক কাঠামো সুদীর্ঘকাল থেকেই রক্ষণশীল। ব্রিটিশ উপনিবেশ আর পাকিস্তান আমলে নারীরা বঞ্চিত হন সমতাভিত্তিক সমাজের অধিকার থেকে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই বাংলাদেশে শুরু হয় নারীর ক্ষমতায়ন আর স্বীকৃতির প্রক্রিয়া। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীদের দেওয়া হয় সকল চাকরিতে কোটা সুবিধা।
নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া বাংলাদেশে পরবর্তী পাঁচ দশকে শক্তিশালী হয়েছে; শিক্ষকতা, প্রশাসনিক চাকরির পাশে রাজনীতিতেও বেড়েছে নারীদের বিচরণ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিক্ষার হারে পুরুষদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে নারীরা।
নারীর ক্ষমতায়নে এই অর্জনগুলোর পরও বাংলাদেশে সামাজিক কাঠামোতে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে নারীরা এখনও বঞ্চিত হচ্ছেন নিজেদের অধিকার থেকে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে নারীরা এগিয়ে থাকলেও উচ্চশিক্ষায় নারীদের শিক্ষার পেছনে সামাজিক ও পারিবারিক বিনিয়োগ কম। মেজর জেনারেল সুসানে গীতির উদাহরণ বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে নারীর ক্ষমতায়নকে আরো বেগবান করবে, সমাজকে লিঙ্গবৈষম্য থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করবে, উচ্চশিক্ষায় নারীদের শিক্ষায় পারিবারিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে।
সামরিক বাহিনীতে স্বাধীনতার প্রথন তিন দশকে মেডিকেল কোর ছাড়া অন্য কোনো কোরে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হতো না, নারীদের সুযোগ ছিলো না লংকোর্সের মাধ্যমে কমিশন লাভ করার। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই বিধিনিষেধ উঠে যায়, সামরিক বাহিনীতে লংকোর্সের মাধ্যমে কমিশন লাভের সুযোগ পান নারীরা। প্রথম ব্যাচের নারী সেনা সদস্যদের মধ্যে চারজন নারী সদস্য ইতোমধ্যেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এরকম নারীদের জেনারেলের র্যাংক অর্জনের অনুপ্রেরণা ও আদর্শ হিসেবে কাজ করবেন মেজর জেনারেল সুসানে গীতি।
সিভিল সোসাইটি নারীদের ক্ষমতায়নে একটা দীর্ঘ সময়ে ধরেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। মেজর জেনারেল সুসানে গীতি সিভিল সোসাইটির সামনে নতুন উদাহরণ তৈরি করেছেন, নারীর প্রতি সবধরনের বৈষম্য হ্রাসকরণে এই উদাহরণ পাথেয় হবে।