সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র নামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই শাসনতন্ত্রকেন্দ্রিক বিতর্ক শুরু হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের দৃষ্টিতে ছয় ধরনের শাসনতন্ত্রের উপস্থিতি রয়েছে। একজনের বিশুদ্ধ শাসনকে বলা হয় রাজতন্ত্র, যেখানে রাজা সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন। রাজতন্ত্রের বিকৃত রূপ হলো স্বৈরতন্ত্র, যেখানে শাসক কেবল নিজের স্বার্থ চিন্তা করে শাসন পরিচালনা করেন। গুটিকয়েক মানুষের শাসনের বিশুদ্ধ রূপ হলো অভিজাততন্ত্র, যেখানে শাসনতন্ত্রের কেন্দ্রে থাকা গুটিকয়েক মানুষ কাজ করেন সকলের মঙ্গলের জন্য। অভিজাততন্ত্রের বিকৃত রূপ হচ্ছে কতিপয়তন্ত্র, যেখানে কতিপয়ের স্বার্থকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয় রাষ্ট্র আর শাসনতন্ত্র।
বহুজনের শাসনের বিশুদ্ধ রূপ হচ্ছে পলিটি, যেখানে বহুজন একসাথে সামষ্টিক কল্যাণের জন্য কাজ করেন। পলিটির বিকৃত রূপ হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে চতুর দরিদ্ররা শাসনতন্ত্রে ঢুঁকে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করে, চেষ্টা করে অবৈধভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে। তবে, বহুজনের শাসন হওয়ায়, একক বিচ্যুতি তুলনামূলক কম প্রভাব ফেলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়।
স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষের শাসনতন্ত্রকেন্দ্রিক আদর্শের যে সংঘাত, সেটি সমাপ্ত হয়েছে বলে ধরা হয়। মানবসভ্যতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় গণতন্ত্রকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্টদের উত্থানে যেখানে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা নেমে এসেছিল এক ডজনে, বর্তমানে সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দেড়শোয়েরও বেশি। এরমধ্যে, কার্যকর গণতন্ত্র আছে কয়েক ডজন দেশে, কিছু দেশে বিকশিত হয়েছে অনুদার গণতন্ত্র, নির্বাচন ম্যানুফেকচারিংয়ের মাধ্যমে কোথাও কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাইব্রিড রেজিম। নতুন গণতন্ত্রগুলোতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে বিকাশ লাভ করেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অবতারবাদ, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক কাঠামোতে।
এই বিবর্তনগুলোর বাইরে, তাত্ত্বিকভাবে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, সংসদীয় গণতন্ত্র, দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি।
সংসদীয় গণতন্ত্র
প্রতিটি রাষ্ট্রের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্র সেই অর্থ সাধারণত বিভিন্ন ধরনের করের মাধ্যমে নাগরিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। প্রাচীনকালে যেসব রাজার কাছে নাগরিকদের উৎপাদন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য থাকতো না, তারা কর আদায়ের সুবিধার জন্য এবং তথ্যের জন্য নাগরিকদের মধ্য থেকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দিতেন। নাগরিক প্রতিনিধিরা স্থানীয় এসেম্বলিতে মিলিত হয়ে করব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত নিতেন, আবার সেই মতামত গিয়ে উপস্থাপন করতেন কেন্দ্রীয় এসেম্বলিতে। প্রাচীন রাষ্ট্রগুলোর সেই এসেম্বলির লিগ্যাসিই বর্তমানে ধরে আছে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টগুলো।
যেসব দেশের পার্লামেন্ট সদস্যরা সরাসরি নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকারপ্রধান নির্বাচন করেন, সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বলা হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। পার্লামেন্ট সরকারপ্রধান এবং সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, শাসনতন্ত্রের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, আইন তৈরির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের কাজকে নির্দেশিত করে। এই নিয়মিত কাজের বাইরে পার্লামেন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রের ব্যয় সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করে, সরকারের পছন্দক্রম নির্ধারণ করে দেন, কাজ করেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
বর্তমান সময়ের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংসদীয় গণতন্ত্রর চর্চা রয়েছে, গণতন্ত্রের প্রধান দুই ধারার এটি একটি। শাসনতান্ত্রিক মতাদর্শ হিসেবে এর বেশকিছু সীমবদ্ধতা রয়েছে, যেগুলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিক অর্জনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণত অনির্বাচিত হন
সংসদীয় গণতন্ত্র যেসব দেশে রয়েছে, সেগুলোতে সাধারণত দুই উপায়ে রাষ্ট্রপ্রধান উঠে আসেন। প্রথমত, সাংবিধান রাজতন্ত্র থাকা দেশগুলোতে উত্তরাধিকার সূত্রে, দ্বিতীয়ত, গত শতাব্দীতে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রিপাবলিকগুলোতে পার্লামেন্টের সদস্যদের ভোটে।
যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে, সেসব দেশের অধিকাংশই সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে শাসিত হয়। এসব দেশের রাজারা একতা দীর্ঘ সময় ধরে কর আদায়ের জন্য এসেম্বলি তৈরির সুযোগ দিয়েছেন, নাগরিকদের মধ্যে অতীত থেকেই তুলে এনেছেন জনপ্রতিনিধিত্ব। আবার, আটলান্টিক রেভ্যলুশনের পরে যখন শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন শুরু হয়েছে, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমেছে, তখন এই রাজারা রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই রাজারা মসৃণভাবে নির্বাহী ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন পার্লামেন্টের কাছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধের কাছে।
সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে অনেক দেশই রয়েছে। কিন্তু, যুক্তরাজ্য, জাপান, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনের মতো দেশগুলোতে রাজারা তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারলেও, থাইল্যান্ডের মতো রাজতন্ত্র গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়লে নাগরিকদের মসৃণ কোনো ‘এক্সিট পয়েন্ট’ নেই।
আবার, যেসব রিপাবলিকে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন, সেসব দেশেও রাষ্ট্রপতির পদটি মোটাদাগে আলংকরিক। এসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সাধারণত সরকার প্রধানের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করেন, রাজনৈতিক ভূমিকা থাকে খুবই সামান্য। ফলে, সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে, এমন অনেক দেশের নাগরিকেরাই তাদের করের অর্থের ব্যয়ের এই খাতকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, প্রশ্ন তুলছেন বিপুল ব্যয়ে এই আলংকরিক পদ রাখার প্রয়জনীয়তা নিয়েও।
সরকারপ্রধান সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন না
সংসদীয় গণতন্ত্র থাকা দেশগুলোতে সাধারণভাবে সরকারপ্রধান নির্বাচিত হন পার্লামেন্টের সদস্যদের মাধ্যমে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্ব দেন মন্ত্রীসভার। সরকারপ্রধানের পছন্দ অনুযায়ী তৈরি হয় মন্ত্রীসভা, মন্ত্রীসভার আকার ও মন্ত্রণালয় বণ্টনও এককভাবে নির্ভর করে সরকারপ্রধানের উপর।
সংসদীয় গণতন্ত্রে যেহেতু সরকারপ্রধান সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন, সেহেতু নাগরিকেরা সরাসরি সরকারপ্রধান নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হয়, যিনি পরবর্তীতে নির্বাচন করে সরকারপ্রধান। এই প্রক্রিয়াতে, নাগরিকদের স্থানীয় প্রতিনিধি এবং সরকারপ্রধান হিসেবে ভিন্ন দলের প্রার্থীকে পছন্দ করা বা সমর্থন করার সুযোগকে সীমিত করা হয়।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে সমস্যা
আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্রগুলোর শাসনতন্ত্রে সাধারণত তিনটি বিভাগ থাকে। আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সংসদীয় গণতন্ত্র যেসব দেশে রয়েছে, সেসব দেশে সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীসভার সদস্যরা সাধারণত একইসাথে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার সদস্য হন। বিভিন্ন সময়েই এই দুই বিভাগের মধ্যে তাই পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে, বিভিন্ন ইস্যুতেই তৈরি হয় ‘স্বার্থের সংঘাতের’ ক্ষেত্র। একই ব্যক্তি দুই বিভাগের সদস্য থাকায়, তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যেক বিভাগের যেসব দায়িত্ব পালন করার কথা, সেগুলোর খুব কমই সম্ভবপর হয়।
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সংকট
তাত্ত্বিকভাবে, নির্বাহী বিভাগে থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা আইনসভার। এখন, সরকারপ্রধান ও অন্যান্য মন্ত্রীরা নির্বাহী বিভাগের অংশ, সরকারপ্রধান আবার সংসদেরও নেতা, মন্ত্রীরা সংসদের শক্তিশালী নেতা। ফলে, জবাবদিহিতা নিশ্চিতের প্রক্রিয়াটি সবসময়ই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়। আইনসভার কোনো সদস্য ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহিতা চর্চার উদাহরণ তৈরি করতে চাইলেও, সরকারপ্রধানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চাইলেও, বাস্তবিক রাজনীতিতে একইসাথে সরকারপ্রধান এবং সংসদের নেতা হিসেবে কাজ করা ব্যক্তির প্রভাবকে পাশ কাঁটিয়ে সেটি করা প্রায় অসম্ভব।
সরকারপ্রধানের সীমাহীন ক্ষমতা
সংসদীয় গণতন্ত্র যেসব দেশে আছে, সেসব দেশে সরকারপ্রধানের ইচ্ছাতেই সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। ফলে, রাষ্ট্রপ্রধানের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়, সেগুলো সাধারণত সরকারপ্রধানের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে। সরকার প্রধানের সম্মতির মাধ্যমে চলে পদায়ন, বদলী আর নিয়োগের প্রক্রিয়াগুলো। এইভাবে, সরকারপ্রধান মন্ত্রিসভার সদস্যদের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি নিয়োগে ভূমিকা রাখেন, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগে ভূমিকা রাখেন, বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও আসে সরকারপ্রধানের দপ্তর থেকেই।
আবার, সরকারপ্রধান সাধারণভাবে ক্ষমতাসীন দলেরও প্রধান হন। ফলে, দলের মধ্যেও থাকে তার সীমাহীন কর্তৃত্ব, বিভিন্ন সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনয়ের সিদ্ধান্তও আসে একই ব্যক্তির কাছ থেকে। ফলে, এক ব্যক্তি চাইলে দেশের যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন, যে কাউকে দায়মুক্তি দিতে পারেন।
একক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক তৈরি করে সুবিধা নিতে পারে যেকোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, সুবিধার জায়গা তৈরি করতে পারেন যেকোনো ব্যক্তিও। ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন রাষ্ট্রের আদর্শ, রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিগুলো।
শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
গণতন্ত্র নাগরিকদের ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আটকে দিতে চায় রাজনৈতিক অবতারবাদ। সংসদীয় গণতন্ত্রের যে সীমবদ্ধতাগুলো রয়েছে, সেগুলো কাঁটিয়ে উঠার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনটা গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। গণতন্ত্রের বিকল্প কতিপয়তন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র হতে পারে না।