পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের একটি কলেজে গত ২২ জুন সদ্য স্কুলের গণ্ডি পাশ করা ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের অভিভাবকরা গিয়েছিলেন ভর্তির ব্যাপারে। কিন্তু ভর্তির জন্য কাউন্সেলিং পর্ব শুরু হতে না হতেই কলেজে দেখা দেয় তুমুল হট্টগোল। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের যুযুধান দুই গোষ্ঠী একে অপরকে আক্রমণ করে বসে কলেজ কার দখলে থাকবে, সেই নিয়ে। নিমিষেই বিষয়টি হাতাহাতির পর্যায়ে যায়, ডাক পড়ে পুলিশী হস্তক্ষেপের। তখনকার মতো ব্যাপারটির নিষ্পত্তি হলেও প্রশ্নটা থেকেই যায়, রাজ্যের সর্বত্র এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের হাত থেকে রেহাই কীভাবে মিলবে?
আশঙ্কার কথা এই যে, দক্ষিণ কলকাতার কলেজটিতে ঘটে যাওয়া এই নিন্দনীয় ঘটনার ঠিক একদিন আগেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের কারবারিদের সাবধান করেছিলেন দলাদলি, তোলাবাজি ইত্যাদি নিয়ে ঘোঁট না পাকাতে।
বিরোধীদের পাশাপাশি মমতা নিজের দলকে তিরস্কার করতেও ছাড়েননি
দলের কোর কমিটির বৈঠকে হাজার হাজার দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সামনে মুখ্যমন্ত্রী একদিকে যেমন বিরোধীদের চাঁছাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেছেন সম্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তুলে, পাশাপাশি নিজের দলের যুব শাখা, শ্রমিক সংগঠন, বিধায়ক, সংগঠক কাউকেই রেয়াত করেননি ভরা সভাতে।
এমনকি একজন পৌর কর্তাকে তোলাবাজির অভিযোগেও তীব্র ভর্ৎসনা করেন মুখ্যমন্ত্রী সবার সামনেই। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে মানুষ তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আর তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দল যেন আত্ম-সংশোধনের পথে এগোয়। সভাতে তিনি এও বলেন যে তৃণমূল স্তরেও তিনি স্বয়ং এবার হাল ধরবেন- পঞ্চায়েতের নজরদারি চালাবেন; জেলা পরিষদের নেতৃত্ব ঠিক করবেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমনতরো নেতৃত্ব নতুন কিছু নয়। সরকার এবং দলের প্রধান মুখ হওয়ার দরুন তিনি আজ সমস্ত রাজ্যের একেশ্বরী, সেই নিয়ে কোনো দ্বিমত তার সবচেয়ে বড় শত্রুরও নেই। কিন্তু সাম্প্রতিকতম এই দলীয় অধিবেশনে নেত্রী যেভাবে তার নিজের দলকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাতে এটাই ফের প্রমাণিত হল যে, একনায়কতন্ত্রে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল পশ্চিমবঙ্গে আজ শাসনযন্ত্র এবং সমাজ জীবন সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত। সেই সাথে কলকাতার কলেজের ঘটনা এও বুঝিয়ে দেয় যে, এই বিপর্যয় থেকে বেরোনোর পথ আপাতত বন্ধ, তা সে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই যতই সাবধান করুন না কেন।
শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক রীতিতে কাজ সুষ্ঠুভাবে হওয়ার নয়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ বুঝেছেন যে, যতই তার জনপ্রিয়তা অটুট থাকুক না কেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে ভাল ফল করে টিকে থাকতে গেলে প্রয়োজন একটি সম্পূর্ণ দলের, একজন ব্যক্তির পক্ষে এই সফলতা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়। রাজ্যে তৃণমূল যে বিরোধীশূন্য নির্বাচন করে জয় পেল সম্প্রতি, তার অন্যতম কারণও ছিল দলের অন্তর্কোন্দল। কিন্তু এত কিছু করেও শাসক দল দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে নিজের দখলদারি রাখতে পারেনি, জিতে গিয়েছে বিজেপির মতো ঘোর শত্রুদল।
যেই জঙ্গলমহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সরকারের কৃতিত্ব নিয়ে ঢাক পেটাতেন প্রায়শই, সেখানে নব্য শত্রু বিজেপি জিতে যাওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন তিনি এবং তার দল। কিন্তু যদি আত্মসমীক্ষা সত্যিই তারা করে থাকেন, তবে তারা দেখবেন যে, এই পরাজয়গুলোর কারণ তৃণমূল নিজেই- স্থানীয় পর্যায়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, নেতাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস- এই সব মিলিয়েই এই বিপর্যয়।
রাজনৈতিক দিশাহীনতা দিন দিন কোণঠাসা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে
অন্যদিকে, তৃণমূলের এই রাজনৈতিক দিশাহীনতার দিনে মাটি কামড়ে সামাজিক প্রকল্প তৈরি করার কাজে মন দিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মতো সংগঠন। একেবারে প্রান্তিক স্তরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তো বটেই, তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত এবং বিপর্যস্ত সমর্থকের নৈতিক সমর্থন জোগানোর কাজও তারা করেছে। পাশাপাশি, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাক্তন বিশ্বস্ত সেনানী মুকুল রায় জঙ্গলমহল অঞ্চলে তার নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে দলের অসন্তুষ্ট সমর্থকদের তার নতুন দলের দিকে নিয়ে গিয়েছেন।
আগামী দিনে যদি পশ্চিমবঙ্গে মমতা বনাম বিজেপির লড়াই আরও তীব্র হয়, তাহলে তা কার্যত মমতার ব্যক্তিগত জনভিত্তির সঙ্গে আরএসএস-এর তৃণমূলী সংগঠনের দ্বৈরথ হয়ে দাঁড়াবে। আর এই লড়াইতে মমতার জনপ্রিয়তা শুরুতে এগিয়ে থাকলেও, ক্রমশই আরএসএস-এর সামাজিক সংগঠনের কাজ তার এই ব্যক্তিগত আবেদনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। আর সেক্ষেত্রে, মমতার প্রয়োজন পড়বে শক্তিশালী সংগঠন নামক প্ল্যান বি-র, আর এখানেই তার দলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
ভারতীয় রাজনীতিতে যে দলটি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সফল, সেই বিজেপির নিজের শক্তিবর্ধনের অন্যতম বড় কৌশল হচ্ছে অন্যান্য নানা দল থেকে বিক্ষুব্ধ নেতাদের ভাঙিয়ে নিজেদের দলে নিয়ে আসা এবং নির্বাচনের সময়ে এই বিক্ষুব্ধদের উপস্থিতিতে দলের পুরোনো সৈনিকদের অসন্তোষ দেখা দিলে তা নিরাময় করার জন্যে একটি যোগ্য দল তৈরি করা।
বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা অমিত শাহ এই পন্থাতে অনেক রাজ্যেই বিরোধী দলগুলোকে পরাস্ত করতে সফল হয়েছেন। আর এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ হলো, তিনি দলকে চালানোর কাজ একার মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে রাখেননি। বিজেপির নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা সবাই বললেও নিচুতলা থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত যে সাংগঠনিক দৃঢ়তা গেরুয়া বাহিনী তৈরি করেছে, তার কৃতিত্বকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা চলে না। বরং এই সংগঠনই অনেক ক্ষেত্রে মোদীর কাজ সহজ করে দিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই দৃঢ়তা দেখা যায়নি। তার দলের নিচুতলার কর্মীদের শাসন তিনি নিজেই করছেন; বিভাগীয় কার্যপ্রক্রিয়ার কথাও তিনিই বলছেন; দলের নাম তোলাবাজির অভিযোগের বিরুদ্ধে তিনিই মুখ খুলছেন; আবার তৃণমূল স্তরে কাজকর্ম দেখার দায়িত্বও তিনিই নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন।
অতিকেন্দ্রিকতা আদতে কতটা সাহায্য করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে?
এই অতিকেন্দ্রিকতা আদতে মমতার দলের শিকড় দৃঢ় করার কাজে কতটা সাহায্য করছে? অতীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীও এই একই পদ্ধতিতে কাজ চালাতেন এবং তাতে তার নিজের ভাবমূর্তি আরও কঠিন প্রতিপন্ন হলেও দলের তৃণমূল সংগঠন পুরো ধসে পড়েছিল এবং তার মাসুল কংগ্রেসকে আজও দিতে হচ্ছে। কংগ্রেস তাও জাতীয় দল বলে সারা দেশে তার এই পতন সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছে। তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক দলের সেই একই পরিণতি হতে কতটা সময় লাগবে?
মমতার রাজনৈতিক সফরের প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক পথচলার প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এক সময়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসকদের গা-জোয়ারি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রধান মুখ ছিলেন। পরবর্তীকালে এ রাজ্যে বামদের বিরুদ্ধে লড়াইতে কংগ্রেসের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হয়ে সে দল ছেড়ে তিনি নিজেই তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন এবং প্রথমদিকে বারবার নির্বাচনী ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করা সত্ত্বেও তিনি হাল ছাড়েননি। শেষপর্যন্ত, ২০১১ সালে তিনি আবার সেই একার লড়াইতেই বামদের সিংহাসনচ্যুত করেন। আবার তার পাঁচ বছর পরে, ২০১৬ সালে, তার দল এবং অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরেও একা হাতে দলকে টেনে জয়ী করেন।
সুতরাং, শুরু থেকেই মমতাদেবীর কাজের ধরনটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এখন বিরোধী নেত্রী হিসেবে সেটা সফল হলেও প্রশাসক হিসেবে প্রয়োজন যোগ্য দলের আর সেটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেই। হয় স্তাবক নয়তো পাড়ার গা-জোয়ারি দাদাদের সম্মিলিত তার তৃণমূল কংগ্রেসে দলীয় অনুশাসনের অভাব সবসময়ই প্রকট। আর দলীয় অনুশাসনের গুরুত্ব না থাকাতে দেদার নেতা এবং তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীতে ভরপুর দলে নিত্যনৈমিত্তিক কলহ-বিবাদ লেগেই থাকে।
এই সমস্যার প্রতিকার শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর বকুনি দিয়ে হওয়ার নয়। কারণ, এই সর্বনাশা দলীয় (অ)ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক জীবনের এক মস্ত বড় অভিশাপ, যার সূচনা সেই বাম শাসনের সময়তেই। আর এই ব্যবস্থাকে ঠিক করতে গেলে প্রয়োজন ব্যাপক হারে সংস্কার- রাজনৈতিক এবং পাশাপাশি অর্থনৈতিক। কারণ, বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি যা, সেখানে দলই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে আর দলের রাশ টানতে হলে আগে সেই সমস্যার সমাধান করার প্রয়োজন।
সেটা যতক্ষণ না মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় করতে পারছেন, ততক্ষণ তার কড়া কথাতেও কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
Featured Image Source: DNA India