মায়ানমার জাতিগত বৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যময় দেশ। এখানে বসবাস রয়েছে শত-শত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর, রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যের সম্মিলন ঘটা এ রাষ্ট্র প্রথম একত্র হয় একাদশ শতাব্দীতে, একত্র করেন বামার রাজারা। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার মতোই কিছু নৃগোষ্ঠী বামার রাজার শাসন মেনে নেয়, আনুগত্যের বিনিময়ে অংশ হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার। আবার মন, শানের মতো অনেকগুলো নৃগোষ্ঠী মেনে নেয়নি একত্রিত শাসনকাঠামো। তারা একাদশ শতাব্দী থেকেই সময়ের পরিক্রমায় বারবার রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, রাজার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অনেক সময় আদায় করে নিয়েছে নিজেদের স্বাধীনতা। আরাকানেও প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি বামার রাজারা, গত সহস্রাব্দের বেশিরভাগ সময়ই স্বাধীনভাবে শাসন করেছেন আরাকানের রাজারা।
ব্রিটিশ উপনিবেশকালে জাতিগত রাজনীতি
এই জাতিগত সংঘাতের রাজনীতির মধ্যে ১৮২৩ সালে বার্মা চলে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে, পতন হয় বামার রাজার। ব্রিটিশ শাসনের সময় কৌশলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের বাইরে রাখা হয় ক্ষমতার বৃত্তের, একটা দীর্ঘ সময় সামরিক বাহিনীতেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি বামারদের। ক্ষমতার বৃত্ত থেকে তাদের হটিয়ে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে কারেন, কাচিন, চিনের মতো নৃগোষ্ঠীগুলোকে, ব্রিটিশদের অনুগত বার্মিজ সামরিক বাহিনীও তৈরি হয় এদেরকে নিয়েই। সময়ের সাথে বার্মাতে স্বাধীনতার দাবি জোরদার হয়েছে, স্বাধীনতাকামী সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করেছে ব্রিটিশ বার্মিজ আর্মি।
ব্রিটিশ উপনিবেশকালে মিয়ানমারের প্রভাবশালী নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভাজনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। স্বাধীনতাকামী বামাররা যোগ দেয় জাপানের সাথে, সহযোগী হয় বার্মাতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাপানের আক্রমণে। অন্যদিকে কাচিন, চিন, কারেনের মতো নৃগোষ্ঠীগুলো অনুগত থাকে ব্রিটিশদের প্রতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় মিত্রশক্তির পক্ষে। উপনিবেশকালে যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী নৃগোষ্ঠীগুলো ব্রিটিশদের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানের রাজকীয় বাহিনীর দ্বারা একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় ব্রিটিশদের অনুগত থাকা নৃগোষ্ঠীগুলোও। একাদশ শতাব্দী থেকে নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলা এই ক্রমাগত সংঘাত, দ্বন্দ্ব স্থায়ী রূপ পায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বার্মার রাজনীতিতে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারে জাতিগত রাজনীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় মিয়ানমারের স্বাধীনতা, চূড়ান্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে। স্বাধীন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় আর শাসনকাঠামো নির্ধারণ করতে আয়োজিত হয় প্যাংলং কনফারেন্স, আমন্ত্রণ জানানো হয় সকল নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের। এই সম্মেলনে শান, চিন, কাচিনরা যোগদান করে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার প্রত্যাশায় সম্মেলন বয়কট করে কারেনরা। সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা একমত হন অখন্ড মিয়ানমার গঠনের ব্যাপারে, প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মত দেন বার্মাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গ্রহণের জন্য।
প্যাংলং সম্মেলনের পর থেকেই উত্তপ্ত হতে থাকে মিয়ানমারের জাতিগত রাজনীতি, মতভেদ দেখা দেয় স্বাধীন মিয়ানমারের শাসনব্যবস্থা নিয়েও। এই রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যেই আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন স্বাধীনতাকামী ছয় শীর্ষ নেতা, যাদের মধ্যে ছিলেন মিয়ানমারের জাতির পিতা জেনারেল অং সানও। এই আত্মঘাতী হামলার ছয়মাসের মধ্যেই স্বাধীনতা অর্জন করে মিয়ানমার।
স্বাধীনতার পরে মতাদর্শগত বিভাজন থেকে রাজনীতির বৃত্ত থেকে সরে যায় কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা (সিপিবি), শুরু করে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম। তাদের মাধ্যমেই স্বাধীন মিয়ানমার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, যা চলছে এখনও। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে কারেনরা, স্বাধীনতাকামী কারেন জাতীয়তাবাদীরা যুক্ত হতে থাকে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কারেন ন্যাশন ইউনিয়নে (কেএনইউ)। কাচিনদের একটা অংশও শুরু করে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম, গঠন করে কাচিন ইনডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশন (কেআইও)। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে কারেন্নিরাও, ১৯৫৭ সালে তারা গঠন করে কারেন্নি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি (কেএনপিপি)।
পরের বছর, ১৯৫৮ সালে মনরা তৈরি করে নিউ মন স্টেট পার্টি, মিয়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালায় নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। আরাকানে গঠিত হয় আরাকান লিবারেশন পার্টি, আরেকটি অংশ গঠন করে ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকান। চিন নৃগোষ্ঠী গঠন করে চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, নাগাল্যান্ডের দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল সোসিওলিস্ট কাউন্সিল নাগাল্যান্ড। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি চীন থেকে পালিয়ে আসা চাইনিজ ন্যাশনাল কুমিট্যাং (কেএমটি) এর সদস্যরা সংঘাতকে আরো জটিল করে তোলেন, ভূমিকা রাখেন সংঘাতের বিস্তৃতি বাড়াতে।
স্বাধীনতালগ্ন থেকেই বার্মার পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা নির্ভরশীল ছিল চীনের উপর, নির্ভর করতে হতো নিরাপত্তার জন্য। ফলে সময়ের সাথে তাতমাদৌর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে চীনের। আবার, ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে, ভূরাজনৈতিকভাবে মায়ানমারও গুরুত্বপূর্ণ ছিল চীনের কাছে। ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে মাথায় রেখেই, ষাটের দশকের শেষদিকে বার্মার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে চীন।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এই সময়ে সামরিক সহযোগিতা দেওয়া শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মাকে (সিপিবি), চীনের কাছ থেকে আসা শুরু হয় অর্থের যোগানও। সিপিবি চীন থেকে আসা অস্ত্র আর অর্থের যোগানে নতুন করে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদৌর সাথে, সিপিবির সাথে যুক্ত হয় আরো কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী। কয়েক বছরের মধ্যে সিপিবি আবির্ভূত হয় সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে, সরকারকে হটিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় কিছু কিছু জায়গায়। কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী এদের সাথে যুক্ত হলেও মতাদর্শগত ভিন্নতা থেকে অনেকেই যুক্ত হননি সিপিবির সাথে।
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের সশস্ত্র সংগ্রামকে বেগবান করতে এগারো সশস্ত্র জোট মিলে গঠন করে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), যাতে যুক্ত হয় কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ), কাচিন ইনডিপেনডেন্ট অর্গানাইজেশন (কেআইও), নিউ মন স্টেট পার্টি (এনএমএসপি) এর মতো প্রভাবশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও। নব্বইয়ের দশকে রাজনীতির মঞ্চে অং সান সু চির আগমন বদলে দেয় এই ফ্রন্টের গতিপথ, বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী চুক্তিতে আসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদৌর নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে। ফলে সশস্ত্র সংগ্রামে থাকা গোষ্ঠীগুলো আবার নতুন করে একটি ফ্রন্ট গঠন করে, ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স অব বার্মা (ডিএবি) নামে।
জাতিগত রাজনীতি ও তাতমাদৌ
স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশকে মিয়ানমারে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অধিকাংশরই স্বপ্ন ছিলো জাতিগত পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা বর্জন করা, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সময়ের সাথে রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটেছে, পরিবর্তন হয়েছে রাজনৈতিক বাস্তবতার। ফলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর স্বাধীনতার দাবির জায়গা দখল করেছে মিয়ানমারের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি, নিজেদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি। রাজনৈতিক বাস্তবতার এই পরিবর্তনের সুযোগ নিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, জাতি গঠনের স্বার্থে সুযোগ দিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সরকারের সাথে চুক্তিতে আসার।
সামরিক গোষ্ঠীগুলোকে সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে বের করে আনতে সামরিক বাহিনী দুই ধরনের নীতি নির্ধারণ করে। রাজনৈতিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে ফিরে আসা গোষ্ঠীগুলোর জন্য ব্যবস্থা করা হয় রাজনৈতিক পুনর্বাসনের, নিশ্চয়তা দেওয়া হয় তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণের। অন্যদিকে, তাতমাদৌ সামরিক অভিযান শুরু করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে, বন্ধ করে দেয় নিকটস্থ গ্রামগুলো থেকে খাদ্য সংগ্রহের পথ, বাধাগ্রস্ত করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অর্থ উপার্জনের পথও। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে বিশাল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, কঠিন হয়ে যায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নতুন সদস্য রিক্রুট করার প্রক্রিয়া। সামরিক বাহিনীর এ আগ্রাসী ভূমিকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের মুখে পড়েন পাহাড়ি অঞ্চলের নাগরিকেরা, পুড়িয়ে দেয় অনেকের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত। তবে সময়ের সাথে যুদ্ধবিরতিতে আসা গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
যুদ্ধবিরতি আন্দোলন
জাতিগত পরিচয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মিলিট্যান্ট গোষ্ঠীগুলো সময়ের সাথে তৈরি হয়েছে, স্বার্থ আর আদর্শের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বিভাজিত হয়েছে, আবার টিকে থাকার স্বার্থে একত্রিত হয়েছে। কারেনদের মতো কিছু প্রভাবশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের মতো পরিচালনা করে নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ড, গড়ে তুলেছে স্কুল, হাসপাতাল, বিচারালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানও। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে তাতমাদৌ দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করছে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, বার্মিজ জাতিগঠনের প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে।
এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই মিয়ানমারে পরিচিতি পেয়েছে ‘যুদ্ধবিরতি আন্দোলন’ নামে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকগুলো গোষ্ঠীই স্বাক্ষর করেছে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে। উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠীগুলো হলো:
- ডেমোক্রেটিক কারেন বুদ্ধিস্ট আর্মি
- কাচিন ইনডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশন
- কায়ান নিউ ল্যান্ড পার্টি
- নিউ মন স্টেট পার্টি
- সান স্টেট পার্টি-নর্থ
- ইউনাইটেড ওয়া স্টেট পার্টি
- ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি
- আরাকান ন্যাশনাল পার্টি
কেন সফল হয়েছে যুদ্ধবিরতি আন্দোলন?
১৯৮৮ সালে জেনারেল নে উইন এর পতনের পর আসে নতুন সামরিক সরকার, মনোযোগ দেয় জাতিগঠনের প্রক্রিয়ায়। এই জাতিগঠনের প্রক্রিয়ারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যুদ্ধবিরতি আন্দোলন। নব্বইইয়ের দশকে প্রথম সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করে সান রাজ্যের মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি। সময়ের সাথে এতে যুক্ত হয়েছে আরো অনেকগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠী, সামরিক যুদ্ধবিরতির চুক্তি হলেও ভূমিকা রাখছে মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে। বেশ কিছু কারণে সফল হয়েছে এই যুদ্ধবিরতি আন্দোলন।
প্রথমত, যুদ্ধবিরতি যথাযথভাবে কার্যকরের জন্য সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল, সদিচ্ছা ছিল চুক্তি রক্ষার ব্যাপারেও। এই প্রক্রিয়ায় সমর্থন জুগিয়েছে অন্যান্য ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলো, ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে ক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থও।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে পরিবর্তিত হচ্ছিল গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের রাজনৈতিক চিন্তা, কট্টর জাতীয়তাবাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা। ফলে রাজনীতির বাস্তবিক পরিবর্তনের স্বার্থেই নাগরিক গোষ্ঠীগুলো ভূমিকা রাখতে শুরু করে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে, হত্যা আর সহিংসতা বন্ধে।
তৃতীয়ত, নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমারের রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ভূমিকা রাখেন অং সান সু চি। মিয়ানমারের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি তার সমর্থন আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রভাব ফেলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপর, ভূমিকা রাখে সু চির দেশব্যাপী ভ্রমণ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাগরিকদের যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করার ঘটনাগুলোও।
যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর না করার রাজনীতি
এতগুলো গোষ্ঠী যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করলেও, বেশ কিছু গ্রুপ এখনো যুদ্ধবিরতি সশস্ত্র গ্রুপ এখনও যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। চুক্তি স্বাক্ষর করেনি, এরকম কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী হলো:
- চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট
- ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টী অব আরাকান
- পালং স্টেট লিবারেশন ফ্রন্ট
- পাও ন্যাশনাল লিবারেশন অর্গানাইজেশন
- শান স্টেট আর্মি- সাউথ
- ওয়া ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন
- লাহু ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট
- ন্যাশনাল সোসিওলিস্ট কাউন্সিল নাগাল্যান্ড (কাপলং)
বেশ কিছু কারণে এই তারা যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, ক্রমাগত সশস্ত্র প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে, করছে গেরিলা যুদ্ধ।
প্রথমত, যে গোষ্ঠীগুলো এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেনি, সেসব গোষ্ঠীর অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী। এদের নিয়ন্ত্রণে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের খনি, আছে পাহাড়ি বিভিন্ন সম্পদের নিয়ন্ত্রণও। আবার, কিছু গোষ্ঠীর জন্য অর্থের যোগান আসে বাইরের দেশ থেকে। ফলে এই গোষ্ঠীগুলো বাস্তবিক রাজনৈতিক অর্থনীতির হিসাবেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেনি।
দ্বিতীয়ত, কারেনের মতো কিছু গোষ্ঠী আছে, যেগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য না দেখানোর ঐতিহ্য বহন করে। এই আনুগত্য না দেখানো তাঁদের কাছে জাতীয়তাবাদের অংশ, নিজেদের সত্তার আত্মপরিচয়ের অংশ। আবার বামপন্থী কিছু দল আদর্শিকভাবেও বিরোধিতা করে বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোর।
তৃতীয়ত, এই জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অনেক সময় ব্যবহৃত হয় সামন্তের নিরাপত্তাবাহিনী হিসেবে, ব্যবহৃত হয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর রাজনীতিতে দরকষাকষির উপাদান হিসেবেও। ফলে, এই প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো নিজদের প্রয়োজনেই টিকিয়ে রেখেছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
নব্বইয়ের দশক থেকে সামরিক বাহিনী তাতমাদৌ দক্ষতার সাথে পালটা রাজনৈতিক ও সামরিক আন্দোলন চালু করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে। অনেকগুলো গোষ্ঠীকে বাধ্য করেছে যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে আসতে, বাকিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায়। সময়ের সাথে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সক্ষমতা কমেছে, কমেছে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় বদলাচ্ছে নাগরিকদের চিন্তাভাবনাও, কমছে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রভাবও। ফলে সামরিক গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রভাব হারাচ্ছে, হারাচ্ছে নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমিও। এই জাতিগত সংঘাতের রাজনীতি খুব দ্রুত শেষ হবে না, তবে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের রাজনীতিতে আর প্রভাব বাড়ানোর সম্ভাবনাও নেই, সম্ভাবনা নেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য হুমকি হয়ে ওঠার।