বর্তমান পৃথিবীতে কয়েক ধরনের সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিছু দেশ যেমন গণতান্ত্রিক, তেমনি কিছু দেশে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিদ্যমান। কিছু দেশে আবার সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র থাকলেও অলিখিতভাবে সেখানে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র বিদ্যমান। চরম স্বৈরতন্ত্র থেকে চরম গণতন্ত্র- এসব ধরনের সরকারের মধ্যেও একটি অলিখিত ব্যবস্থা থাকতে পারে, সেটি হলো অলিগার্কি। অলিগার্কি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সরকার ব্যবস্থা নয়। এটি একটি রাজনৈতিক অবস্থা, যেখানে সরকারের সিদ্ধান্ত গুটিকয়েক লোকের দ্বারা চরমভাবে প্রভাবিত হয়। এই গুটিকয়েক লোক সাধারণত দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে থাকে। সরকারের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে।
অলিগার্ক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে দুটি গ্রিক শব্দ ‘অলিগই’ এবং ‘আরখেন’ যুক্ত হয়ে। অলিগই অর্থ ‘মুষ্টিমেয়’, আরখেন অর্থ ‘শাসন করা’। অর্থাৎ উৎপত্তিগত দিক থেকে অলিগার্ক শব্দের অর্থ মুষ্টিমেয় লোকের শাসন। অলিগার্করা যদিও শাসকগোষ্ঠীর অংশ, কিন্তু অধিকাংশ অলিগার্ক সরাসরি শাসনকার্যের সঙ্গে জড়িত থাকে না। তবে দূর থেকে শাসনকার্যের কলকাঠি তারাই নাড়ে। অলিগার্করা সাধারণত অর্থবিত্ত ও আভিজাত্যে সমাজের অন্যদের থেকে ভিন্ন। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সমাজের অন্যদের থেকে আলাদা।
অর্থাৎ, অলিগার্কি হলো একটি অলিখিত ক্ষমতাকাঠামো, যার মাধ্যমে গুটিকয়েক লোক বা পরিবার একটি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। অলিগার্কি ব্যবস্থায় যারা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরকে অলিগার্ক বলা হয়। অলিগার্করা সাধারণত সবসময়ই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চেষ্টা করে। সরকারও নিজেদের স্বার্থে কিংবা বাধ্য হয়ে অলিগার্কদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। সরকারের নীতিনির্ধারক ও অলিগার্ক উভয়েই নিজেদের স্বার্থে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে।
প্লুটোক্রেসি ও অ্যারিস্টোক্রেসি অলিগার্কির কাছাকাছি দুটি ব্যবস্থা। প্লুটোক্রেসি হলো গুটিকয়েক ধনবান লোকের দ্বারা পরিচালিত শাসনকাঠামো। অলিগার্করা সম্পদশালী হতেও পারে আবার না-ও পারে, কিন্তু প্লুটোক্রেসিতে ধনী লোকদেরই রাজত্ব। অর্থাৎ প্লুটোক্রেসি অলিগার্কির অংশ, তবে অলিগার্কি মানেই প্লুটোক্রেসি নয়। প্লুটোক্রেসি ও অলিগার্কির মতোই আরেকটি ব্যাবস্থা হলো অ্যারিস্টোক্রেসি। প্লুটোক্রেসি ধনবানদের শাসনকাঠামো হলেও অ্যারিস্টোক্রেসি হলো অভিজাতদের শাসনকাঠামো। অ্যারিস্টোক্রেসিতে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় সমাজের সেরা ও যোগ্য লোকদের মাধ্যমে, অপরদিকে অলিগার্করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে থাকে এবং অনৈতিক উপায়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। তবে অলিগার্করাও অনেক সময় রাষ্ট্রের সেরা ও যোগ্য ব্যক্তি হতে পারে। অ্যারিস্টোক্রেসি একধরনের অলিগার্কি, কিন্তু অলিগার্কি মানেই অ্যারিস্টোক্রেসি নয়।
অলিগার্কির ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টা শিক্ষিত অভিজাতদের দ্বারা শাসিত হতো। একে যদিও অ্যারিস্টোক্রেসি বলে, তবে এটাও একধরনের অলিগার্কি। চতুর্দশ শতাব্দীতে ভেনিস ‘প্যাট্রিশিয়ান’ নামে পরিচিত ধনী অভিজাতদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে নতুন দেশগুলো তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে রাশিয়ায়, অলিগার্কি ব্যবস্থা শক্তিশালী অবস্থান নেয়।
বর্তমান সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশই অলিগার্কদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। রাশিয়া, চীন, ইরান এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক অলিগার্কির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
রাশিয়ান অলিগার্ক হলেন তারাই যারা মূলত ১৯৯১ সালের পর সরকারের সাথে নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে ব্যাপক অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। তাদের বিত্তশালী হওয়ার ধরন স্বাভাবিকের চেয়ে আলাদা। রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ান অলিগার্করা তাদের বেশিরভাগ সম্পদ অর্জন করেছেন সেখানকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে, কিংবা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সরকারি সম্পদের বেসরকারিকরণের মাধ্যমে। এরপর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল করার জন্য তাদের অন্যতম পন্থা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ।
কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সকল প্রতিষ্ঠান সরকারের অধীনে ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশ সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নেয়। এ সময় সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ লোকদের কাছে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করে। সরকারের কাছের মানুষরা অত্যন্ত কম দামে অনেক রাষ্ট্রীয় কিনে নেয়। ফলে নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ায় অনেক মানুষ রাতারাতি বিত্তশালী হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা এরাই রাশিয়ান অলিগার্ক নামে পরিচিত। যদিও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এটি অস্বীকার করেন, তার মতে সম্পদভিত্তিক অলিগার্কি শাসকগোষ্ঠীর সূচনা হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিছু রাশিয়ান অস্বচ্ছ উপায়ে অত্যন্ত ধনবান হয়ে ওঠে।
আধুনিক বিশ্বে অলিগার্কি কাঠামোর আরেক উদাহরণ হলো চীন। চীন যদিও নিজেকে পিপলস রিপাবলিক হিসেবে পরিচয় দেয়, কিন্তু সেদেশে জনগণের ক্ষমতা নেই বললেই চলে। কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ নেতা এবং তাদের ঘনিষ্ঠরাই চীনের ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্রে। ১৯৭৬ সালে মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর চীনে অলিগার্কি ব্যবস্থা বেশ প্রসারিত হয়। ১৯৮০ এর দশকে চীন যখন বিশ্ববাজারে নিজেকে উন্মোচিত করে এবং কিছুটা ক্যাপিটালিস্ট ধারায় প্রবেশ করে, তখন থেকে গুটিকয়েক মানুষই অর্থনৈতিক সুবিধা বেশি পেয়েছে। যারা কমিউনিস্ট পার্টির অনুগত তাদেরকে চীন সরকার অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা দেয়। এছাড়া চীনের বর্তমান চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় লোকের কাছে কুক্ষিগত, এরাই চীনা অলিগার্ক। চীনের সকল ক্ষমতা কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ কিছু নেতার হাতে। চীনের এসব নেতা এবং তাদের ঘনিষ্ঠরাই দেশটির সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে। এরাই চীনা অলিগার্ক।
বর্তমান ইরানকে একটি ধর্মতন্ত্র এবং যাজকীয় অলিগার্কি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মূলত ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে ধর্মগুরুরা ক্ষমতার কাঠামোর কেন্দ্রে চলে আসে। ইরানে ক্ষমতার যে শ্রেণিবিন্যাস সেখানে একজন সর্বোচ্চ নেতা (সুপ্রিম লিডার) ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছেন। এছাড়া ধর্মগুরুরাই সকল ক্ষমতার মালিক। ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামরিক ক্ষমতা গুটিকয়েক ধর্মীয় নেতার নিয়ন্ত্রণে। দেশটির সুপ্রিম লিডার, বিশেষজ্ঞ পরিষদ এবং গার্ডিয়ান কাউন্সিল দেশের সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা এসব ধর্মগুরুদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা পেয়ে থাকে। ইরানে এই ধর্মগুরুরাই অলিগার্ক।
গণতান্ত্রিক দেশগুলোও যে অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেক গবেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আর গণতান্ত্রিক দেশ নয়, বরং একটি অলিগার্কি হয়ে উঠেছে। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি অলিগার্কিতে পরিণত হচ্ছে বা ইতোমধ্যে হয়ে উঠেছে। কারণ হিসেবে তারা দেশের ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসের দিকে ইঙ্গিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ সম্পদের মালিক খুব কম সংখ্যক কিছু মানুষ। এরাই যুক্তরাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্টিন গিলেন্স এবং বেঞ্জামিন পেজের ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে মার্কিন নেতারা নীতিনির্ধারণের সময় মধ্যবিত্ত বা গরিবদের সুবিধার চেয়ে ধনীদের সুবিধার কথাই বেশি ভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে লবিং কালচারের মাধ্যমে অভিজাত অলিগার্করা সরকারের নীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যদিও বিশ্বাস করা হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ, কিন্তু সেখানে জনগণের স্বার্থকে খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে সরকারের সকল সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকয়েক বিত্তশালী ব্যক্তি।
মার্কিন অলিগার্ক হলো সেদেশের ধনী ব্যবসায়ীরা। ধনবান ব্যক্তিরা নির্বাচনে কোনো একটি দলকে বিশাল অংকের ডোনেশন দিয়ে থাকে, এবং পরবর্তীতে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা পেয়ে থাকে। মার্কিন সরকার সেদেশের অভিজাতদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। সরকারের অধিকাংশ নীতি অভিজাতদের কথা ভেবেই নির্ধারণ করা হয়। এমনকি, মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতেও অলিগার্কদের প্রভাব রয়েছে। মার্কিন অলিগার্কদের প্রভাবেই মূলত সেদেশের প্রশাসন ইসরায়েলকে অনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ধনী ব্যবসায়ীদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এমনকি সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও একজন অলিগার্ক।
বিশ্বের আরো অনেক দেশেই অলিগার্কদের প্রভাব রয়েছে। এমনকি, কোনো একটি রাষ্ট্রও অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে অলিগার্কদের মতো আচরণ করতে পারে। কোনো রাষ্ট্র যদি অন্যান্য রাষ্ট্রের মতামত আমলে না নিয়ে যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নেয় তখন সেটা রাষ্ট্রীয় অলিগার্কি হয়ে পড়ে। যেমন, কিছুদিন আগে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানি ও ফ্রান্স অলিগার্কির মতো আচরণ করছে। তার মতে, বার্লিন ও প্যারিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য ছোট দেশের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। কাগজে-কলমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল দেশ সমান হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতা এটাই যে জার্মান ও ফরাসিরা এখানে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এটা একটা গণতান্ত্রিক কাঠামো হলেও প্রকৃতপক্ষে এখানে অলিগার্কি ব্যবস্থা বিদ্যমান, কারণ যারা শক্তিশালী তাদের হাতেই ক্ষমতা।
অর্থাৎ যেকোনো প্রতিষ্ঠানই অলিগার্কিতে পরিণত হতে পারে। কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, সব জায়গাতেই অলিগার্কদের প্রভাব থাকতে পারে। অলিগার্কি ব্যবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রে চরম বৈষম্য তৈরি করে। অলিগার্করা সাধারণত দেশের সম্পদের বড় অংশের মালিক হয়ে থাকে, এবং দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।