স্ট্যালিন বলেছিলেন, একজন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ট্র্যাজেডি, কিন্তু এক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে পরিসংখ্যান। সম্প্রতি সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যাকাণ্ড এবং তা নিয়ে মিডিয়ার আলোচনা যেন স্ট্যালিনের সেই কথারই প্রতিফলন। গত দুই সপ্তাহ ধরে গণমাধ্যমের আলোচনার শীর্ষে আছে খাশোগজি হত্যাকাণ্ড। কিন্তু এর আগে তো বটেই, গত ১৩ অক্টোবরেও যে সৌদি বিমান হামলায় ইয়েমেনের হুদায়দা বন্দরে ১৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, সে সংবাদটি স্থান পায়নি অধিকাংশ মিডিয়াতেই।
“ #Millions of children don’t know when or if their next meal will come. In one hospital I visited in north #Yemen, the babies were too weak to cry, their bodies exhausted by #hunger. This could be any hospital in #Yemen.” @HelleThorning_S pic.twitter.com/XTYqWqkC8W
— Save the Children Yemen (@SaveChildrenYE) September 20, 2018
জাতিসংঘের মতে, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটছে ইয়েমেনে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় সেখানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে অন্তত ১৬ হাজার বেসামরিক মানুষ। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, পানি বিশোধন কেন্দ্রসহ সেবামূলক সব ধরনের স্থাপনা। সৌদি জোট কর্তৃক আরোপিত অবরোধের ফলে সেখানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে আছে ৫০ লক্ষ শিশু। তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে আরো প্রায় ৮৪ লক্ষ মানুষ।
এসব সংবাদ যে মিডিয়াতে একেবারেই আসে না, এমন না। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে জামাল খাশোগজিকে নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো যেরকম ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্রেকিং নিউজ, বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, পরিচিতদের সাক্ষাৎকার, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ প্রচার করেছে; পত্রিকাগুলো যেরকম নিয়মিত রিপোর্ট ছাড়াও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, মতামত ইত্যাদি প্রকাশ করেছে; সে তুলনায় ইয়েমেনের সংবাদ কখনোই মিডিয়াতে এরকম গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু কেন একজন জামাল খাশোগজি মিডিয়ার কাছে লক্ষ লক্ষ ইয়েমেনি শিশুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
এ কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে, জামাল খাশোগজির ঘটনাটি অন্য দশটি সাধারণ ঘটনার মতো না। এর আগেও বিদেশের মাটি থেকে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে অপহরণ করার ঘটেছে। সৌদি আরব নিজেই গত তিন বছরে ইউরোপ থেকে তিনজন প্রিন্সকে অপহরণ করে দেশে নিয়ে গেছে। বিদেশের মাটিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দ্বারা সংঘটিত গুপ্তহত্যার ঘটনাও প্রতিবছরই ঘটে থাকে। কিন্তু দূতাবাসের ভেতর প্রথিতযশা কোনো সাংবাদিক হত্যার মতো ঘটনা খুবই বিরল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরকম অন্য যেকোনো হত্যাকাণ্ডের চেয়ে এটি বেশি আলোচিত হওয়ার কথা।
তবে জামাল খাশোগজির ঘটনা আরো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে প্রধানত দুইটি কারণে। একটি হচ্ছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কনসুলেটের অভ্যন্তরে। তুরস্কের সাথে সৌদি আরবের সরাসরি কোনো যুদ্ধ বা কূটনৈতিক সংকট না থাকলেও সৌদি আরবের প্রধান দুই শত্রু ইরান এবং কাতারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে দেশটির সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ঠিক স্বাভাবিকও না। এছাড়াও তুরস্ক হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়িত বা পলাতক মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল, যে সংগঠনটিকে সৌদি আরব সম্প্রতি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
I’ve written about why the world is outraged over the killing of #Kashoggi but silent on unchecked Saudi aggression in #Yemen and its support by the UK government. https://t.co/vcJNX1w6hi
— Lloyd Russell-Moyle (@lloyd_rm) October 17, 2018
ফলে তুরস্কের কনসুলেট থেকে গুরুত্বপূর্ণ একজন সৌদি সাংবাদিক নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি তুরস্কের হাতে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক যুদ্ধে ব্যবহার করার উপযোগী একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ধরা দেয়। শুধু সৌদি আরব না, ঘটনাটির মাধ্যমে তুরস্ক সৌদি আরবের প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেন-দরবার করারও একটি উপলক্ষ্য পেয়ে যায়। ফলে প্রথম থেকেই তুরস্কের কাছে ঘটনার অডিও প্রমাণ থাকলেও সেটি প্রকাশ না করে ধীরে ধীরে মিডিয়ার মাধ্যমে একটু একটু করে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ফাঁস করানোর মাধ্যমে নাটক জমিয়ে তোলে এবং সংকটটিকে সফলভাবে একটি আন্তর্জাতিক সংকট হিসেবে রূপ দেয়।
তবে খাশোগজির ঘটনাটি আরো বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টের কারণে। গ্রেপ্তারের ভয়ে সৌদি আরব থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে জামাল খাশোগজি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখছিলেন। নিজেদের কলামিস্টকে হত্যা করার ব্যাপারটি ওয়াশিংটন পোস্ট সহজভাবে গ্রহণ করেনি। তারা প্রায় প্রতিদিন একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, কয়েকটি মতামত, সম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলে।
ওয়াশিংটন পোস্টের দেখাদেখি নিউইয়র্ক টাইমসসহ আমেরিকার অন্যান্য প্রভাবশালী গণমাধ্যমও এগিয়ে আসে। মূলত গণমাধ্যমের ভূমিকার কারণেই বিষয়টি শুধুমাত্র সৌদি আরব এবং তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক সংকট হিসেবে আবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। জনমতের চাপে পড়ে মার্কিন জনপ্রতিনিধিরাও বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়। জামাল খাশোগজি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস না করতেন, যদি তিনি ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট না হতেন, কিংবা মার্কিন লিবারেল সমাজের সাথে তার পরিচিত না থাকত, তাহলে তার ঘটনাটি এতটা আলোচিত হতো কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ব্যক্তি জামাল খাশোগজিকে নিয়ে যেখানে এত তোলপাড় হতে পারে, সেখানে ইয়েমেনে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যুর পরেও সেগুলো নিয়ে কেন আলোড়ন সৃষ্টি হয় না? নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এর একটি কারণ হলো, সাধারণ মানুষের পক্ষে হাজার হাজার মৃত্যু সংবাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া কঠিন। সেকারণেই সংবাদ মাধ্যমগুলো হাজার হাজার মৃত্যুর ঘটনার মধ্য থেকেও একজন বা দুইজনের ব্যক্তিগত গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করে। একই কারণে প্রতি বছর সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটলেও কেবলমাত্র আয়লান কুর্দির ঘটনাটিই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
The Khashoggi crisis has called attention to a largely overlooked Saudi-led war in Yemen. On a rare trip to the front line, New York Times journalists found Yemenis fighting and dying in a war that has gone nowhere. https://t.co/4OwcMmeJxp
— The New York Times (@nytimes) October 21, 2018
সৌদি আরবের ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই ঘটেছে। ইয়েমেনে বিমান হামলার সংবাদ আমরা প্রতিদিনই শুনি, কিন্তু খাশোগজি বা আয়লান কুর্দির মতো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত করুণ কাহিনী আমাদের সামনে উঠে না আসায় আমরা সেগুলো নিয়ে সেই অর্থে বিচলিত হই না। তাছাড়া ইয়েমেনে বিমান হামলা চলছে যুদ্ধের অংশ হিসেবে, যেখানে বিশ্বের অনেকগুলো দেশ জড়িত। কিন্তু খাশোগজির ঘটনায় কোনো যুদ্ধ ছাড়াই সম্পূর্ণ নিরাপদ স্থানে একজন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনাটি আমাদেরকে বেশি বিচলিত করে। এ ঘটনায় আমরা পরিষ্কারভাবে দুইটি প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করতে পারি। একদিকে এক নিরীহ সাংবাদিক জামাল খাশোগজি, অন্যদিকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলে ইয়েমেনের জটিল যুদ্ধের চেয়ে এই ঘটনা বুঝতে পারা এবং এতে ক্ষোভ প্রকাশ করা আমাদের জন্য সহজ হয়।
ব্যাপারটিকে মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একই রকম পরিস্থিতি হলেও হাজার হাজার মৃত্যুর চেয়ে একটি মাত্র মৃত্যুর ঘটনা মানুষকে বেশি আলোড়িত করে। নাম না জানা একশ জনের মৃত্যুর চেয়ে সন্তান হারা এক মায়ের বেদনা, স্বামী হারা এক স্ত্রীর হাহাকার, অথবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার এক নিরীহ সাংবাদিকের গল্পেকে মানুষ নিজের জীবনের সাথে বেশি মেলাতে পারে। এমন না যে, আমরা ১ লাখ মৃত্যুতে ব্যথিত হই না। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে না পারার ভয়ে আমাদের মস্তিষ্ক আগে থেকেই আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে আবেগের জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। এর একটি বৈজ্ঞানিক নামও আছে, যাকে বলা হয় Collapse of Compassion।
তবে জামাল খাশোগজির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, এর পেছনেও অবশ্য ইয়েমেনসহ অন্যান্য স্থানে সৌদি আরবের অন্যায় কর্মকাণ্ডগুলোর একটি ভূমিকা আছে। সৌদি আরবের কর্মকাণ্ড গণমাধ্যম আগে থেকেই জানত। কিন্তু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো সেই অর্থে সেগুলোর বিরুদ্ধে খুব বেশি সোচ্চার ছিল না। কেবলমাত্র খাশোগজির ঘটনায় একটি পত্রিকা সোচ্চার হওয়ার পরেই সবাই তাতে সাড়া দিয়েছে। বিষয়টি অনেকটা ‘me_too’ আন্দোলনের মতো। নারীরা সব সময়ই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আসছিল। সবাই সেটা জানতও। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ করেই একটি ঘটনার পর সবাই একসাথে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
তবে এই কারণগুলোর বাইরেও জামাল খাশোগজির ঘটনা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর সোচ্চার হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ থাকতে পারে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, সৌদি আরব সবসময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ছিল। ইয়েমেন যুদ্ধে ওবামা প্রশাসনও সমর্থন দিয়েছিল, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরবকে সমর্থন করা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিরই একটি অংশ। আমেরিকার অস্ত্র বাণিজ্যও এই যুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িত। তাই মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো মাঝেমাঝে দায়িত্বশীল প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কখনোই সৌদি আরবের অন্যায়গুলোর বিরোধিতা করে না।
They asked me to write on why Khashoggi’s death provoked a backlash to Saudi Arabia, when so many past transgressions did not
Here’s my answer, citing psychology, social science, the oddities of alliance politics, the history of Saudi and, yes, Bill Cosby https://t.co/vWpIWAAmD0
— Max Fisher (@Max_Fisher) October 17, 2018
কিন্তু খাশোগজিকে হত্যার ঘটনাটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাথে বা মার্কিন স্বার্থের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না। যুদ্ধে যেরকম পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে, খাশোগজির ঘটনায় সেরকমও কিছু নেই। দলমত নির্বিশেষে সবার চোখেই এটা পরিষ্কারভাবেই ভয়াবহ একটা অন্যায় এবং সীমালঙ্ঘন। ইয়েমেনের ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার হতে না পারা গণমাধ্যমগুলোও যে খাশোগজির ঘটনাকে লুফে নিয়েছে, এটিও তার একটি কারণ হতে পারে। তবে কারণ যেটাই হোক, অন্তত একটি ঘটনায়ও যে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলোর চাপে সৌদি আরব শেষপর্যন্ত জামাল খাশোগজিকে হত্যার বিষয়টা স্বীকার করেছে, সেটি মোটেও কম অর্জন না।