মানবজাতির অস্তিত্বের শুরু থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষে মানুষে বিতর্ক হয়েছে। মতপার্থক্য প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে। আবার, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মানুষ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে, সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যুক্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি সম্মতি মানুষের যে সহজাত প্রক্রিয়া, শাসনব্যবস্থায় তার প্রথম কাঠামোগত প্রকাশ ঘটে প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্সে। তৎকালীন এথেন্সে নারীদেরকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো না, নাগরিক অধিকার ছিল না দাসদেরও। তারপরও, এই নগররাষ্ট্র এথেন্সেই বিকাশ হয় গণতন্ত্রের ধারণার, নিজেদের মাধ্যমে নিজেদের শাসন করার ধারণার। নগররাষ্ট্র থেকে গণতন্ত্রের বিকাশ সুষম হয়নি। দ্রুতই রাষ্ট্রীয় কাঠামো নগররাষ্ট্রের যুগ পেরিয়ে প্রবেশ করে সাম্রাজ্যবাদের যুগে।
এ যুগে তৈরি হয় রোমান, ব্রিটিশ, ওসমানি, মুঘল ইত্যাদির মতো বড় বড় সাম্রাজ্য, যারা তাদের সময়ে শাসন করেছে পৃথিবীর বড় একটি অংশ। সাম্রাজ্যবাদের যুগে শাসনকাঠামো ছিল রাজতান্ত্রিক, অনেকসময় যা বিচ্যুত হয়ে ধারণ করত স্বৈরতন্ত্রের রূপ। সেখান থেকে, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আদর্শিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় গণতন্ত্রের। অনেকগুলো বিপ্লব, বিদ্রোহ আর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ফলে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গণতন্ত্র।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আধুনিক গণতন্ত্রের যে পথপরিক্রমা, আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন গণতন্ত্রের জন্য এই বিপ্লব, বিদ্রোহ আর সংগ্রামগুলোকে ভাগ করেছিলেন তিনটি গণতান্ত্রিক ঢেউয়ের মাধ্যমে। আবার, টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায় এই আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন ১৩টি ঢেউয়ের মাধ্যমে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্সপেকটিভ’ আর্টিকেলে অধ্যাপক সেভা এই ১৩টি ধাপের মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সম-অধিকারের মতো ভিত্তিমূলক ধারণা থেকে শাসনব্যবস্থায় শাসকের জবাবদিহিতা আসার প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, তুলে এনেছেন আটলান্টিক রেভল্যুশন থেকে আরব বসন্ত পর্যন্ত ঘটনাগুলো।
ধারাবাহিক আলোচনায়, ১৩টি পর্বের মাধ্যমে আলোচনা হবে অধ্যাপক সেভার আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের তেরোটি ঢেউ নিয়ে। এই লেখাটির মূল আলোচনা অধ্যাপক সেভার প্রথম গণতান্ত্রিক ঢেউ আটলান্টিক রেভল্যুশন নিয়ে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয় আধুনিক গণতন্ত্রের।
আটলান্টিক রেভল্যুশন
বর্তমানে বৈশ্বিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো উত্তর আমেরিকা অষ্টাদশ শতাব্দীতে ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশদের অধীনে। নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল ব্রিটিশরা। ছিল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরা; প্রতিযোগিতায় ছিল ডাচ, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান এবং স্প্যানিশরাও। শক্তি আর সম্পদে এগিয়ে থাকায় সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিল ব্রিটিশরাই। উত্তর আমেরিকাতেও বিজয় পতাকা উড়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের, বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটা অংশ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের অধীনে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের অধীনে থাকলেও মোটামুটি স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত আমেরিকানরা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক যুদ্ধে জড়ায় ব্রিটিশরা, যুদ্ধের খরচ বহনের জন্য করবৃদ্ধির চেষ্টা করে বিভিন্ন উপনিবেশে। ১৭৬৫ সালের স্ট্যাম্প আইন, ১৭৬৭-৬৮ সালের কর বৃদ্ধি সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আইন এই বিরোধ উস্কে দেয়, বোস্টন ম্যাসাকারের ঘটনা আমেরিকানদের প্রভাবিত করে স্বাধীনতার দিকে। সত্তরের দশকেই সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় আমেরিকানদের। ফ্রান্স আর স্পেনের সহায়তায় আমেরিকানরা অর্জন করে স্বাধীনতা।
রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার চর্চা, শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি আর রাজাদের ভোগবিলাসের জন্য উচ্চ করে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল ফরাসি জনগণ। সাথে যুক্ত হয়েছিল অভিজাত শ্রেণির শোষণ, ছিল চার্চের যাজকদের বিতর্কিত ভূমিকা। রাজা আর অভিজাত শ্রেণির অত্যাচার থেকে ফরাসি নাগরিকদের মুক্তির এ যাত্রা শুরু বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে, পরে যা ফ্রান্সকে ধাবিত করে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের দিকে। ১৭৮৯ সালের আগস্ট মাসেই নাগরিকদের সমান অধিকারের ঘোষণা আসে বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে। দুই বছর পরই ফ্রান্স থেকে বিলুপ্ত হয় রাজতন্ত্র।
একই সময়ে দাসত্ব আর অমানবিক জীবন থেকে মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয় হাইতিতে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে হাইতি ছিল ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি মুনাফা তৈরি করা উপনিবেশ, চিনি আর কফির বড় অংশ উৎপাদিত হতো হাইতির কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের মাধ্যমে। দাস মালিকদের নির্মম অত্যাচার আর অমানবিক ব্যবহার থেকে মুক্তি খুঁজতে বিদ্রোহের পর বেছে নেয় দাসেরা, এক দশকের মধ্যেই যারা সফল হয় স্বাধীনতা অর্জনে।
একই সময়ে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে সুইজারল্যান্ডে, বিপ্লবের ছোঁয়া পেয়েছিল পোল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডও। আয়ারল্যান্ডে এই বিল্পবের ঢেউ লেগেছিল দু’বার; প্রথমবার ১৭৭৮ সালে, পরেরটি ঠিক দুই দশক পর, ১৭৯৮ সালে।
গণতন্ত্রের প্রথম ঢেউ
আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবিতে যে বিল্পবগুলো হয়েছে, সংগ্রাম হয়েছে উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য, বিদ্রোহ হয়েছে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য, সেগুলোই আধুনিক গণতন্ত্রের প্রথম ঢেউ হিসেবে আলোচিত হয়েছে। শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের এ আন্দোলনের অনেক কিছুই স্থায়ী হয়নি, বেশ কিছু জিনিসকে কাঠামোগত রূপে আনতে পারেনি এ বিপ্লব। তবে নিশ্চিতভাবেই, এ বিপ্লব, গণতন্ত্রের প্রথম ঢেউ হিসেবে প্রভাবিত করেছে আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের পরবর্তী ধাপগুলোকে।
প্রথমত, নগরাষ্ট্রের যুগ কিংবা সাম্রাজ্যবাদের যুগ, পৃথিবীতে মানবসভ্যতা একটা বড় সময় কাটিয়েছে রাজতন্ত্রের অধীনে। মধ্যযুগের শেষদিকে এসে ব্রিটেনের মতো বিভিন্ন দেশে আইনসভা শক্তিশালী হওয়া শুরু হলেও, প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজতন্ত্রকে শাসনকাঠামোর বাইরে রাখতে পারেনি সেসব পরিবর্তন। আটলান্টিক রেভল্যুশন রাজতন্ত্রকে বাইরে রেখে শাসনকাঠামো তৈরির বাস্তবিক উদাহরণ তৈরি করে। তবে, যেহেতু প্রথম ঢেউতে হওয়া বিপ্লবগুলোর ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়ী হয়নি, রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটি প্রযোজ্য। ফ্রান্স যেমন দ্রুতই আবার নেপোলিয়নের সময়ে চলে যায় রাজতন্ত্রের অধীনে। হাইতির ক্ষেত্রেও বিপ্লবী জেনারেল তুঁসাই লুভ্যাচুর নিজেই হাঁটেন স্বৈরতন্ত্রের পথে। ঠিক যেমন ফ্রান্সের বিপ্লবী নেতা ম্যাক্সিমিলিয়ানও হেঁটেছিলেন স্বৈরতন্ত্রের পথে।
দ্বিতীয়ত, জঁ জ্যাক রুশোর সামাজিক চুক্তির ধারণায় যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার দিক উঠে এসেছে, তা প্রভাবিত করেছে বহু বিপ্লবী নেতাকে। রুশোর “মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে, পরাধীন হয়ে থাকে সর্বত্র” উক্তিটি ব্যবহার করেছেন বিপ্লবী নেতারা, আমেরিকান অন্যতম স্থপতি প্যাট্রিক হেনরির “আমাকে স্বাধীনতা দিন, কিংবা মৃত্যু” উক্তিতেও পাওয়া যায় রুশোর চিন্তার ছাপ। অর্থাৎ, ইউরোপীয় রেনেসাঁ বিশেষভাবে প্রভাবিত করে আটলান্টিক রেভল্যুশনকে।
আটলান্টিক রেভল্যুশন যখন মোটা দাগে আন্টলান্টিকের শাসনব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম-অধিকারের মতো বিষয়গুলোও প্রতিষ্ঠিত হয় শাসনকাঠামোতে।
তৃতীয়ত, সাম্যের ধারণা প্রভাবিত করেছে আন্টলান্টিক রেভল্যুশনকে, প্রভাবিত করেছে রুশোর “সকল মানুষই সমানভাবে সৃষ্টি” ধারণাও। ফলে, সমাজের অভিজাত শ্রেণি, যারা রাজতন্ত্রকে কতিপয়তন্ত্রের রূপ দিতেন, শাসনকাঠামো থেকে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে নিতেন, তাদের কাঠামোর বিরুদ্ধে বিপ্লব গড়ে ওঠে। নাগরিকদের সাম্যের ধারণা বিকশিত হওয়ায় কতিপয়ন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার প্রবণতা দেখায় আইনসভাগুলো।
তবে, আটলান্টিক রেভল্যুশনে সাম্যের ধারণার সবচেয়ে বড় প্রকাশ সম্ভবত হাইতির স্বাধীনতা পাওয়া। এর মধ্য দিয়েই উত্তর আমেরিকায় দাসব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে, কৃষ্ণাঙ্গ দাসদেরও যে সম-অধিকার প্রাপ্য, নাগরিক সুবিধা প্রাপ্য, এ ধারণার শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি স্থাপিত হয়।
চতুর্থত, মধ্যযুগে ইউরোপে রাষ্ট্রের বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয় চার্চ। চার্চের মাধ্যমে পাপ মোচনের ধারণা এ প্রতিষ্ঠানকে করেছিল বিপুল অর্থের মালিক। ফলে, সময়ের সাথে চার্চের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে, বিতর্কিত হয় ধর্মযাজকদের ভূমিকা। ইউরোপে রেনেসাঁর মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামো থেকে চার্চকে পৃথক করার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার কাঠামোগত রূপ আসে আটলান্টিক রেভল্যুশনের মাধ্যমে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রব্যবস্থা একটা দীর্ঘ সময় পরিচালিত হয়ে প্রথা দ্বারা। সেখানে, রাজা অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন, দেশ শাসন করতেন নিজের ইচ্ছামতো। ইসলামি খিলাফতে কিছু কিছু পর্যায়ে বিচার বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার উদাহরণ ছাড়া, রাজার অসীম ক্ষমতার মাধ্যমেই পরিচালিত হয়েছে রাষ্ট্রকাঠামো। রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতাকে সীমিত করার জন্য লিখিত সংবিধানের ধারণা আসে আটলান্টিক রেভল্যুশনের মাধ্যমেই। ব্রিটেনেও রাজার ক্ষমতাকে সীমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে আইনসভার প্রাধান্য বাড়িয়ে, কিন্তু তাদের লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে রাজার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়নি।
একবিংশ শতাব্দীতে আমরা যে উদার গণতন্ত্রের ধারণা, জবাবদিহিতা আর ব্যাক্তিস্বাধীনতার আলোচনা করি, আধুনিক যুগে তার বিবর্তন শুরু হয়েছিল আটলান্টিক রেভল্যুশনের মাধ্যমে। ১৭৬৩ সালে শুরু হওয়া এ পর্ব সমাপ্ত হয় ১৭৯৮ সালে এসে। সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই বিপ্লব চলমান থাকলেও, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের অনেককিছুই এ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই ধারণাগুলো কীভাবে কাঠামোগত রূপ ধারণ করেছে, তার আলোচনা থাকবে পরবর্তী পর্বগুলোতে। তবুও, শাসনব্যবস্থার যে আদর্শিক পরিবর্তন, তার শুরুর জন্য আধুনিক গণতন্ত্রের আলোচনায় গুরুত্ব থাকবে এই রেভ্যলুশনের।