বেশ বেকায়দায় পড়েছেন ডোনাল্ড জন ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পয়ঁতাল্লিশতম রাষ্ট্রপতি প্রথম থেকেই নানা কেরামতি তো দেখাচ্ছিলেনই, কিন্তু এবারে তিনি যা করলেন, তাতে বেজায় চটেছে তামাম আমেরিকাবাসী। ঘরোয়া রাজনীতিতে এতদিন ট্রাম্পের পক্ষে এবং বিপক্ষে মতামত শোনা যেত- তাকে কেন্দ্র করে তুমুল মেরুকরণ প্রত্যক্ষ করা যেত মার্কিন সমাজে। কিন্তু গত ১৬ জুলাই ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার বৈঠকের এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথাবার্তার পর ট্রাম্পের নিজের ঘরেই তার গ্রহণযোগ্যতা পড়েছে বড়সড় প্রশ্নের মুখে। তার ‘আমেরিকাকে ফের মহান’ বানানোর শপথ যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে। আর অবস্থা বেগতিক বুঝে ট্রাম্প প্রশাসন প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে ড্যামেজ কন্ট্রোলের। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে।
ট্রাম্প শাসনকার্যে এসে বরাবরই আগুন নিয়ে খেলেছেন। রাজনীতির বাইরের লোক হওয়ার যেমন কিছু সুবিধা তার ছিল, তেমনই প্রশাসন এবং রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ হওয়ার অসুবিধাও ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামার জমানা শেষ হওয়ার পরে মার্কিন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা ট্রাম্পকে যাবতীয় সমর্থন যোগান; ক্ষুণ্ন ভাবমূর্তির হিলারি ক্লিনটন তার বিপক্ষে থাকাতেও বিতর্কিত ট্রাম্পের সুবিধা হয় শেষপর্যন্ত। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে এবং জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া অবতার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নারীবিদ্বেষ; মানুষকে ন্যূনতম সম্মান না জানানো; সময়ে সময়ে পরস্পরবিরোধী মতামত জ্ঞাপন করা- ইত্যাদি নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠলেও শেষ হাসি হেসেছেন ট্রাম্পই। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতে এসেছেন ক্ষমতায়।
এর পর থেকেই ট্রাম্প এক সম্পূর্ণ নতুন দিশায় পরিচালনা করতে থাকেন মার্কিন বিদেশনীতিকে। ওয়াশিংটনের পুরোনো বন্ধুদের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করেন ন্যাটোর ব্যয়ের অসাম্য; বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে। চীনের বিরুদ্ধে রীতিমতো বাণিজ্যিক যুদ্ধে নেমে পড়েন; ভারতের মতো বন্ধুস্থানীয় দেশের বিরুদ্ধেও অসন্তোষ প্রকাশ করেন বাণিজ্য বিষয়ে; দক্ষিণের প্রতিবেশী মেক্সিকোর সঙ্গে সীমানাতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আটকে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আলাদা করে রাখার কঠোর সিদ্ধান্তও নেন। বহুদিনের মিত্র কানাডারও চাঁছাছোলা ভাষাতেও নিন্দা করেন।
এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অন্ধ ভক্তরা তার পক্ষেই ছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল যে ট্রাম্প যা করছেন তা আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভালোর জন্যই। ট্রাম্পও তার সমর্থকদের মনের কথা বুঝতে পেরে তার পপুলিস্ট শাসনের পারদ চড়াচ্ছিলেন; ভাবছিলেন তিনি যা করছেন তাতে সোনাই ফলবে।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং মাতব্বরি ট্রাম্পকে ডোবাল হেলসিঙ্কিতে
কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাকে ডোবায় হেলসিঙ্কিতে। যখন ২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগে রীতিমত আলোড়িত মার্কিন রাজনীতি; এক বিশেষ উকিল তার তদন্ত চালাচ্ছেন জোরকদমে, ১২ জন রুশ চরকে অভিযুক্তও করেছেন হেলসিঙ্কি বৈঠকের প্রাক্কালে; পাশাপাশি মার্কিন গোয়েন্দারা জানিয়েছেন যে ২০১৬ তো বটেই, রুশ সাইবার আক্রমণের নিশানায় মার্কিন মুলুকের যাবতীয় ডিজিটাল পরিকাঠামোই- তখন পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের এই বৈঠকের কোনো সার্থকতা দেখেননি মার্কিন পর্যবেক্ষকরা। এমনকি, ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী প্রচারকে লক্ষ্য করার অভিযোগে ওই ১২ জন রুশ চর অভিযুক্ত হলে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির তরফ থেকে ট্রাম্পকে বলা হয় পুতিনের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে দেশে ফিরতে।
কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরে বলে বসেন যে তিনি আদতে তার দেশের গোয়েন্দা-ইন্টেলিজেন্স নয়, ভরসা করেন পুতিনের কথাতেই। অর্থাৎ, পুতিন যে আমেরিকার নির্বাচনে নাক গলানোর অভিযোগকে খারিজ করেছেন, ট্রাম্প তাতেই সততা দেখেছেন। সোজাসুজি বলে দিয়েছেন “আমার মনে হয় না রাশিয়া এমন করবে বলে।” পরে আবার গোঁজামিল দিয়ে বলেন, “আমার বলা উচিত ছিল ‘আমার মনে হয় না রাশিয়া এমন করবে না বলে’।” কিন্তু তা যে অবস্থা সামাল দেওয়ার মরিয়া প্রয়াস, তা বলে দিতে হয় না।
আর এতেই হয়েছে বজ্রপাত। ট্রাম্প যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা চীন বা উত্তর কোরিয়াকে চোখ রাঙাচ্ছিলেন তখন তার সমর্থনে বিশেষ ভাটা পড়েনি কারণ হাজার হলেও তাতে ছিল জাতীয়তাবাদী জিগির। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের আত্মঘাতী গোল যেন ভরা আসরে গণেশই উল্টে দিল।
রাশিয়ার ব্যাপারে মার্কিনীদের সংবেদনশীলতা ট্রাম্প কেন বুঝতে চাননি সেটা বোঝা গেল না। যেখানে তিনি বাকি দুনিয়ার সঙ্গে মার্কিন জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে লড়তে ব্যস্ত, সেখানে পুতিনের সামনে আশ্চর্যরকমভাবে গুটিয়ে গিয়ে নিজের দেশকেই আক্রমণ করে বসলেন কীভাবে, তার ব্যাখ্যা এখনও খুঁজে পাননি- তার বন্ধু বা শত্রুপক্ষ কেউই। পুতিনের সঙ্গে একক বৈঠকে আর কী কথা হলো, তাও জানতে উদগ্রীব সব মহল। চিরশত্রু দেশের কাছে আর কী কী ভাবে মার্কিন গর্বকে ধূলিস্যাৎ করতে উদ্যোগী হয়েছেন ট্রাম্প, সেই আশঙ্কাতেই শঙ্কিত সেদেশের মানুষ এখন।
ট্রাম্পের এই অদ্ভুত আচরণের নেপথ্যে কী?
ট্রাম্প বরাবরই বলে এসেছেন যে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চান। তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু হেলসিঙ্কিতে ট্রাম্প যেভাবে নিজেকে চালনা করলেন- রাশিয়ার নেতৃত্বের সামনে খাটো করলেন স্বদেশকে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। তিনি কি ইতিহাসের খবর রাখেন না? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বিতা- যা পৃথিবীর ইতিহাসের এক বড় অংশ জুড়ে চলেছিল- সেটা কি তার কাছে বিস্মৃত এক অধ্যায়? নাকি তিনি কিছুরই পরোয়া করেন না? নাকি তিনি কূটনীতির রাজনীতি বোঝেনই না? নাকি রুশ নেতৃত্বের সঙ্গে তার এমন কিছু গুপ্ত সম্পর্ক রয়েছে যে তিনি সম্পূর্ণ তার প্রভাবাধীন?
ট্রাম্পের প্রহসন এবারে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তাকেই বিপদে ফেলছে
উত্তরটা খুঁজে বের করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই। এবং তাড়াতাড়ি। কারণ যত দিন যাচ্ছে, ট্রাম্পের প্রহসন ক্রমেই ওয়াশিংটনের কাছে এক জাতীয় নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন যে তিনি মার্কিন শাসনকার্যে এক বিপ্লব নিয়ে এসেছেন, কিন্তু তিনি এটা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ যে ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ ছাড়া রাজনীতিতে এবং কূটনীতিতে সাফল্য পাওয়া দুরূহ।
প্রশাসক হিসেবে দলগত মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া; বিদেশনীতির কিছু নির্দিষ্ট ছক মেনে চলা; বাচালতা কম করে অর্থবহ দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করা; জাতীয় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে যখন তখন আবোলতাবোল টুইট না করা; ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার না দেওয়া ইত্যাদি নানা দায়িত্ব নিষ্ঠাভরে পালন না করলে জনসমক্ষে আরও পর্যুদস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ট্রাম্পের। ট্রাম্পের শাসনকালের এখনও অর্ধেক সময়ও পেরোয়নি আর ইতিমধ্যেই তিনি তার প্রশাসনকে দেশ-বিদেশে এক হাসির খোরাকে পরিণত করে ফেলেছেন যা আম আমেরিকানদের কাছে যথেষ্ঠ বেদনার কারণ।
ট্রাম্পের সময়কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অধঃপতন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করছে নিঃসন্দেহে। শীতল যুদ্ধে যেই মহাশক্তিধর দেশটি পশ্চিমের নেতৃত্ব দিয়ে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেই এখন তার পুরোনো মিত্রদের ত্যাগ করে সেই সোভিয়েত মুলুকের উত্তরসূরি রাশিয়ার সঙ্গে কোলাকুলিতে ব্যস্ত- এমনকি, তাতে সে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করতেও পিছপা নয়। মার্কিন-রুশ সম্পর্কের এই নয়া অধ্যায় ইউরোপকে যথেষ্ঠ উদ্বেগে ফেলেছে; যেমন এশিয়াতে জাপানকে ফেলেছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের ‘সুসম্পর্ক’। রাশিয়াকে সামলাতে এখন নেটো এবং ইইউকে নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, অন্তত যদ্দিন ট্রাম্প ক্ষমতায় রয়েছেন।
ট্রাম্পকে ঠেকাতে ব্যর্থ তার দলও
যদিও একাধিক জরিপ বলছে যে রিপাবলিকান দলের সদস্যের এক বড় অংশই মনে করছে, ট্রাম্প হেলসিঙ্কিতে ঠিকই করেছেন, একথা অস্বীকার করা যায় না যে সে দলের বেশ কিছু বিশিষ্ট সদস্য ট্রাম্পের কাণ্ডকারখানার বেশ বিব্রতও। এমনিতেই ট্রাম্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় এক দলবিহীন গণতন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে- কেননা তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনকার্যে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান দুটি দলই আড়ালে চলে গিয়েছে। ট্রাম্পের খামখেয়ালি কাজকর্মে তার দল রিপাবলিকান পার্টি (যদিও ট্রাম্পের সঙ্গে এই দলের কতটা মিল রয়েছে তা বলা কঠিন) শুরু থেকেই অস্বস্তিতে রয়েছে আর হেলসিঙ্কিতে তার কাণ্ড, যাকে অনেকে দেশদ্রোহিতা বলেও আখ্যা দিচ্ছে- এখন আব্রাহাম লিঙ্কনের দলকে প্রকাশ্যে আরও ছোট করেছে। “রিপাবলিকানরা এবার জেগে উঠুন, ট্রাম্পের লাগাম টানুন”- শোনা যাচ্ছে এমন দাবি।
আগামী নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্বর্তী নির্বাচন। কোণঠাসা ডেমোক্র্যাটদের কাছে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ এখনও টাটকা এবং নভেম্বরের নির্বাচনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকেরই। এই অবস্থায় সোজাসুজি পুতিনের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের সামনে একটি সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছেন হারানো জমি পুনরুদ্ধারের। এখন তারা কতটা তা কাজে লাগাতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।
Featured Image Source: Fortune