ইউক্রেন সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ইতিহাসের প্রথম ‘ফ্লায়িং এইস’ পেয়ে গিয়েছে। এই ব্যক্তি হচ্ছেন মিগ-২৯ ফাইটার প্লেনের একজন অজ্ঞাত পাইলট, যার ডাকনাম ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’ (কিয়েভের ভূত)। রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর প্রথম ত্রিশ ঘণ্টায় ছয়টি রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছেন তিনি। এরপর এখন পর্যন্ত আরও চারটি, অর্থাৎ মোট দশটি রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি। ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর এই পাইলট ইতোমধ্যে আক্রমণকারী রুশ বিমানগুলোর ‘দুঃস্বপ্ন’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ণমাত্রায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এরপর তিন দিন পরে, ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন সরকারের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল থেকে সাঁইত্রিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছাড়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে, যে ভিডিওটি এখন পর্যন্ত পনের লক্ষেরও বেশি মানুষ দেখে ফেলেছেন। ভিডিওটিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে ইউক্রেনীয় একজন পাইলট দেশটির আকাশে রাশিয়ান যুদ্ধবিমানকে দুর্ধর্ষ আক্রমণের মাধ্যমে ধরাশায়ী করে আবার গতির ঝড় তুলে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছে।
ভিডিওটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে, এই অজ্ঞাত ইউক্রেনীয় পাইলটকে ‘ফ্লায়িং এইস’ (Flying Ace) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সাধারণত আকাশে যুদ্ধবিমানের সংঘাতে (যেটিকে ‘ডগফাইট’ বলা হয়) যে পাইলট পাঁচটি বা ততোধিক বিমান সফলভাবে ভূপাতিত করতে পারেন, তাকে ‘ফ্লায়িং এইস’ বলা হয়। ‘ফ্লায়িং এইস’ শব্দদ্বয় প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। মিত্রপক্ষের বিমান বাহিনীর একজন ফরাসি পাইলট, যার নাম ছিল অ্যাডলফ পেগ্যু, তিনি পাঁচটি জার্মান বিমানে হামলা চালিয়ে সফলভাবে ভূপাতিত করতে সক্ষম হন। ফরাসি গণমাধ্যমে তাকে ‘দ্য এইস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এরপর থেকে এটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে যে, যুদ্ধের সময় কোনো পাইলট যদি ডগফাইটে প্রতিপক্ষের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করতে পারেন, তাহলে তাকে ‘ফ্লায়িং এইস’ উপাধি দেয়া হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বিমান বাহিনীতে একজন তরুণ পাইলট ছিলেন, যার নাম ম্যানফ্রেড ভন রিখথোফেন। তিনি একাই প্রায় আশিটি ডগ ফাইটে জয়লাভ করে ইউরোপের আকাশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাকে বলা হতো ‘দ্য রেড ব্যারন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও বেশ কিছু ‘ফ্লায়িং এইস’ পাওয়া গিয়েছে, যাদের মধ্যে জার্মান পাইলট গেরহার্ড বারখোর্ন, সোভিয়েত পাইলট আলেক্সান্ডার পোখরিশকিন, ও জাপানি পাইলট শিনোহারা হিরোমিচি প্রমুখ রয়েছেন।
ইউক্রেনের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে সেই ৩৭ সেকেন্ডের ভিডিওটি ইন্টারনেটে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অত্যাধুনিক রাশিয়ান বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে তুলনামূলক কম শক্তিশালী ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একজন অজ্ঞাত পাইলট এরকম বীরত্ব প্রদর্শন করছে, এটা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি অনেকে। এছাড়া সেই ‘ফ্লায়িং এইস’ এর পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো (যিনি ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন) তার ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে প্লেনের ককপিটে বসে থাকা একজন পাইলটের ছবি ছেড়ে দেন, এবং এই পাইলটকেই তিনি ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’ (কিয়েভের ভূত) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের মাতৃভূমি রক্ষাকারী সৈনিক থাকলে যুদ্ধে অবশ্যই ইউক্রেনীয়রা জয়লাভ করবে।” তার সেই টুইটটি ইতোমধ্যে আঠারো হাজার আটশোর অধিক লাইক পেয়েছে, রি-টুইট করা হয়েছে প্রায় চার হাজার বারের মতো।
পোরোশেঙ্কোর টুইট কিংবা ইউক্রেনের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ছাড়া ভিডিও– দুটোই ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে খুবই দ্রুতগতিতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে ভিডিওটি ছাড়া হয়েছে, সেটি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কোনো ভিডিও নয়। ‘ডিজিটাল কমব্যাট সিমুলেটর ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি গেম রয়েছে, যেখান থেকে এই ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। গেমটির মান এত উন্নত যে, এখান থেকে কোনো ভিডিও ক্লিপ বাস্তবের কোনো যুদ্ধের ভিডিও হিসেবে অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যাবে। ইউক্রেনের সেই ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’-এর ক্ষেত্রে মূলত সেটিই হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সের কাছে ‘ডিজিটাল কমব্যাট সিমুলেটর ওয়ার্ল্ড’ এর একজন মুখপাত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া পোরোশেঙ্কো যে পাইলটের ছবি ছেড়েছেন, তার ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে সেটি তিন বছর আগে তোলা বলে জানানো হয়েছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে সেই পাইলটের ছবি ছেড়েছিল, যে ছবিতে পাইলট একটি নতুন হেলমেট পরিধান করে পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
ইউক্রেন সরকারের ভিডিও ও সাবেক প্রেসিডেন্টের ছেড়ে দেয়া ছবির মাধ্যমে যুদ্ধকালীন প্রোপাগাণ্ডার একটি খণ্ডচিত্র পাওয়া সম্ভব। উভয় ক্ষেত্রেই একজন ‘সুপারহিরো’কে দেখানো হয়েছে, যিনি ইউক্রেনের আকাশে আগ্রাসন পরিচালনা করা রুশ সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমানকে একের পর এক ভূপাতিত করে মাতৃভূমি নিরাপদ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তার পক্ষ থেকে। মূলত, যখন একটি দুর্বল দেশ তুলনামূলক শক্তিশালী দেশের সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়, তখন সেই দুর্বল দেশটির একজন ‘কাল্ট হিরো’র প্রয়োজন হয়, যে দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে সর্বস্ব দিয়ে দেয়। দুর্বল দেশের মানুষেরা সেই সেই ‘কাল্ট হিরো’কে দেখে প্রেরণা লাভ করে। যুদ্ধের সময় দুর্বল দেশের মানুষের মানসিক শক্তি একেবারেই কমে যায়। তাদের এমন কিছুর প্রয়োজন হয়, যা তাদের মনকে চাঙ্গা করে তুলবে। এক্ষেত্রে যদি সেই ‘সুপারহিরো’র গল্প মিথ্যাও হয়, সেটি যাচাই করার কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে না। ইউক্রেনে অভ্যন্তরে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাচ্ছে, গোলাবর্ষণ করছে, দেশটির নাগরিকেরা শরণার্থী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ দূরত্বে— এরকম একসময়ে তাদের দরকার এমন কিছু, যা তাদের মাঝে আশার সঞ্চার করবে। ইউক্রেনের সরকার মূলত তাদের যুদ্ধপীড়িত জনগণকে মানসিকভাবে সবল রাখতে এই কাজটিই করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে প্রতিটি যুদ্ধ হচ্ছে চতুর্মাত্রিক। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ তো রয়েছেই, এর পাশাপাশি ‘প্রোপাগাণ্ডা প্রেশার’ তৈরিও যুদ্ধকে নতুন মাত্রা প্রদান করে। যুদ্ধে প্রকৃত বিজয় অর্জন করতে হলে চারটি ফ্রন্টেই সমানতালে লড়তে হবে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে। মূলত, প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয় প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য। আবার নিজ দেশের জনগণকে চাঙা রাখতেও প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়।
ইউক্রেনের ‘কিয়েভের ভূত’ প্রোপাগাণ্ডা সেই ধরনেরই উদ্দেশ্য নিয়ে ছড়ানো হয়েছে, যাতে একদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধপীড়িত জনগণের মনোবল শক্ত থাকে, অপরদিকে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী এবং জনগণ কিছুটা শঙ্কিত ও হতাশ হয়। আমেরিকা ও জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমনভাবে প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল তরুণেরা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। বর্তমানে বিভিন্ন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মাধ্যমগুলোর কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ খুব সহজেই একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারছে, যেটি প্রভাবিত করেছে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর কৌশলকে। একসময় যেখানে পত্রিকা, পোস্টার কিংবা লিফলেটের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হতো, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে।
তবে প্রযুক্তি খুবই সহজলভ্য হওয়ায় একটি তথ্য সত্য নাকি মিথ্যা— এটি বের করাও সহজ হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন কাহিনীর সত্যতা নিরূপণের জন্য অসংখ্য ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট রয়েছে, যেগুলো আমাদের সামনে প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করছে প্রতিমুহূর্তে। সুতরাং এই যুগে প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে ঠিক কতক্ষণ পর্যন্ত সেটির গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, এটা নির্ভর করছে কখন এই প্রোপাগান্ডার সত্যতা নিরূপিত হচ্ছে, তার উপর। যেমন- ইউক্রেনের ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’ এর কথাই ধরা যাক। প্রথমে যখন সেটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, তখন সবাই সেই অজ্ঞাত পাইলটকে বাহবা দিতে থাকল, দেশকে বাঁচাতে ইউক্রেনীয়দের হার না মানা লড়াইয়ের গল্প ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। সেই ইউক্রেনীয় পাইলট ‘সুপারহিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন মুহূর্তের মধ্যেই। কিন্তু এরপরে একপর্যায়ে প্রকাশিত হয়ে গেল, যে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেটি আসলে বাস্তবতা-বিবর্জিত এক ভিডিও গেমের ক্লিপ। ডয়েচে ভেলে, রয়টার্স কিংবা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো গণমাধ্যমগুলো এই ভিডিও ও ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’ এর প্রোপাগাণ্ডা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করল। ‘ঘোস্ট অব কিয়েভ’ বা কিয়েভের ভূতের ঘটনাকে তাই প্রোপাগাণ্ডা যুদ্ধের সর্বশেষ সংস্করণ বললে ভুল হবে না।