১২১৫ সালের দিককার কথা। ইংল্যান্ডে শাসনব্যবস্থা তখন পুরোপুরি রাজতান্ত্রিক। রাজা জন উপভোগ করতেন অসীম ক্ষমতা, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল আমলাতন্ত্রের উপর। নিয়ন্ত্রণ ছিল বিচার বিভাগের উপরও। রাজার এই ক্ষমতাকে ভারসাম্যে আনার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। ছিল না রাজার নৈতিক স্খলন হলে সেটি রোধ করার উপায়। রাজার ক্ষমতার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল চার্চ, তৎকালীন সময়ে যারা অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। চার্চের অর্থনৈতিক সক্ষমতার সাথে টেক্কা দিতে রাজা জন কর বাড়িয়ে দেন রাজ্যের বাসিন্দাদের উপর। করারোপ করেন বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর। কর বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে কৃষকদের উপর, প্রভাব পড়ে সামন্তদের উপরও।
এমনই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু সামন্ত বিদ্রোহ করে বসেন রাজার বিরুদ্ধে, দ্রুতই যা রূপ নিতে শুরু করে গৃহযুদ্ধে। রাজা জন তখন বিদ্রোহীদের সাথে চুক্তিতে আসেন, ঐতিহাসিকভাবে যেটি পরিচিত ম্যাগনাকার্টা চুক্তি হিসেবে। এর মাধ্যমে রাজার করারোপ করার ক্ষমতাকে সীমিত করা হয়, রাজাকে আইনের অধীনে নিয়ে আসা হয়, সীমিত করা হয় রাজার প্রজাদেরকে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতাকে। স্বীকৃতি দেওয়া হয় আইনসভার ক্ষমতাকে।
মধ্যযুগের এই ম্যাগনাকার্টা চুক্তির মাধ্যমে আইনের শাসনের ধারণা শুরু হয়, শুরু হয় রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের ক্ষমতাকে ভারসাম্যে আনার ধারণারও। জবাবদিহিতার এ ধারণা পূর্ণতা পায় জাতিরাষ্ট্রের যুগে এসে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে।
এথেন্সে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারণা জাতিরাষ্ট্রের যুগে উদার অবস্থান গ্রহণ করেছে, আড়াইশো বছরে গণতন্ত্র গিয়েছে অনেকগুলো বিপ্লব, সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায় এই আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনমূলক ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন মোট ১৩টি ঢেউয়ের মাধ্যমে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্সপেকটিভ’ আর্টিকেলে অধ্যাপক সেভা এই ১৩টি ধাপের মধ্যে প্রথম ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আটলান্টিক রেভল্যুশনকে, দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রামকে, ইউরোপীয় উপনিবেশের যুগ পেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময়কে।
লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৮০৯-১৮২৪)
আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনে প্রথম ঢেউটি লেগেছিল আটলান্টিক পাড়ের বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি রাজ্য একত্র হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে ব্রিটেনের কাছ থেকে, ফ্রান্স থেকে উৎখাত হয় রাজতন্ত্র। কিন্তু, প্রথম পর্যায়ের এই গণতান্ত্রিক ঢেউয়ের অনেককিছুই কাঠামোগত রূপ লাভ করতে পারেনি দ্রুত। এই কাঠামোগত দুর্বলতা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ফ্রান্সে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেয় নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে, ক্ষমতায় এসে যিনি নিজেকে ঘোষণা করেন সম্রাট হিসেবে। রাজ্য জয়ের নেশায় তিনি কাঁপিয়ে তোলেন ইউরোপকে, যার প্রভাব পড়ে ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর উপরও।
উত্তর আমেরিকাতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল ইউরোপের দুই দেশ, ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে। লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশ শাসন ছিল স্পেনের ও পর্তুগালের। ১৮০৭ সালে ফ্রান্স আর স্পেনের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ আর নিজেদের উপনিবেশগুলোকে রক্ষা করে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে মোকাবেলা করার গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির পরপরই নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী আক্রমণ করে পর্তুগালে। সেখানকার রাজা ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর মাধ্যমে পালিয়ে আসেন পর্তুগালের উপনিবেশ ব্রাজিলে, রাজধানী স্থাপন করেন রিও ডি জেনিরোতে।
পর্তুগালের এই রাজনৈতিক সংকটকালে তৎকালীন রাজার মাধ্যমে দ্রুত উন্নত হয় ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো, গড়ে উঠে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ব্রাজিলকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধি পায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায় ব্রাজিলের, পর্তুগালের সাথে ফেডারেশন হবার পর বেড়ে যায় নাগরিক অধিকারও। নেপোলিয়নের পতনের পর রাজা পর্তুগালে ফিরে যান, রাজনৈতিক সংকটের সুযোগে ব্রাজিলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন পর্তুগালেরই তৎকালীন রিজেন্ট, রাজপুত্র পেদ্রো।
পর্তুগালে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর সাফল্যের পর ফ্রান্সের নজর পড়ে তাদেরই মিত্র স্পেনের দিকে। ইউরোপের দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেন আর ফ্রান্সের চেয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে ছিল স্পেন। ফলে, ফ্রান্সের আক্রমণে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয় স্পেনে। ক্ষমতার কাঠামো থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় রাজা আর রাজপুত্রদের। এ রাজনৈতিক সংকটের সুযোগে স্পেনের লাতিন আমেরিকান উপনিবেশগুলো নিজেদের স্বায়ত্ত্বশাসন উপভোগ করা শুরু করে, বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাথে উপনিবেশগুলো পায় অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ। এসব রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রভাবিত করে লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনকে।
সবার আগে স্বাধীন হয় ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টিনা। ইউরোপীয় রেনেসাঁয় প্রভাবিত হয়ে ১৮১৬ সালের নভেম্বরে আইনসভার মাধ্যমে স্পেনের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আর্জেন্টিনা, আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাব ছিল লাতিন আমেরিকার অন্যান্য স্প্যানিশ উপনিবেশের মধ্যেও। স্পেনে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট তৎকালীন রাজনৈতিক এলিটরা সামাল দিতে চেষ্টা করে উপনিবেশগুলোকে আরো বেশি স্বায়ত্তশাসন দেবার মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় আইনসভায় তাদের প্রতিনিধি নিয়ে আসার মাধ্যমে।
তবে, কেন্দ্রীয় আইনসভায় যথাযথ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ না থাকায় আর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ কমে যাওয়ায় লাতিন আমেরিকায় সংঘাত দানা বাঁধে। প্রায় দুই দশকব্যাপী যুদ্ধ আর সংঘাত চলে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ফ্রন্টে, স্পেনের অনুগত অংশ আর স্বাধীনতাকামী অংশের মধ্যে। সমাজের অভিজাত অংশ, যারা তিন শতাব্দীর স্প্যানিশ শাসনের সময় সম্পদের মালিক হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা করেছে, উচ্চ সামাজিক অবস্থান ধারণ করেছে, তারা নিজেদের অবস্থান হারাবার ভয়ে স্পেনের অনুগত অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতাকামী অংশে ছিল যুবকেরা, সমাজের উঠতি অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা।
ধারাবাহিক সংগ্রামে ভেনিজুয়েলা, পেরু, ইকুয়েডর, চিলি, প্যারাগুয়ে আর কেন্দ্রীয় আমেরিকা স্বাধীনতা পায় ১৮২১ সালে। লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ছিলেন সিমন বলিভিয়ার, নায়কোচিত ভূমিকা ছিল চিলির স্বাধীনতার নায়ক বার্নান্দ্রো ওহিগিন্সের, ফ্রান্সিস্কো ডি মিরান্ডারও। বীরত্ব দেখিয়েছিলেন নারীরা, বিপ্লবের নায়িকা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন ম্যানুয়েলা সানেজও। আদর্শিক দিক থেকে ভূমিকা ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁর পথপ্রদর্শকদ জঁ জ্যাক রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’ ধারণার; অরাজকতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করে- হবসের এ ধারণাও প্রভাবিত করে রেনেসাঁকে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় জন লকের মাধ্যমে, আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনে যার ছাপ ছিল প্রতিটি ঘটনাতেই।
একই চিত্র দেখা যায় ১৮২৪ সালে স্বাধীন হওয়া স্পেনের আরেক উপনিবেশ দেশ মেক্সিকোতেও। সমাজের অভিজাত অংশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল স্প্যানিশদের সাথে। সামাজিক মর্যাদা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য তাদের নির্ভর করতে হতো স্প্যানিশদের উপর। মেক্সিকোতে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাঠামোগত সূচনা হয় চার্চের মাধ্যমে। শুরুতে মেক্সিকোতে স্বাধীনতাকামী অংশের নেতৃত্ব দেন ধর্মযাজক ম্যানুয়েল হিদ্যালগো ওয়াই কস্টিল্লা, ৮০ হাজার সৈন্যের স্বাধীনতাকামী সেনাবাহিনী দিয়ে যিনি মেক্সিকোর যুদ্ধে জয় পান স্প্যানিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। ১৮১১ সালের এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি বন্দী হন। একই বছরে কার্যকর হয় তার মৃত্যুদণ্ড। হিদ্যালগোর পরে স্বাধীনতাকামীদের নেতৃত্বে আসেন আরেক ধর্মযাজক, জোসে মারিয়া মোরলেস পাভোন। তার মৃত্যু হয় ১৮১৫ সালে। মিলিশিয়া, চার্চ আর স্বাধীনতাকামীদের সংগ্রামে পরের দশকেই স্বাধীনতা অর্জন করে মেক্সিকো।
আধুনিক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় ঢেউ
নগররাষ্ট্রের যুগের পর পৃথিবীতে দেড় হাজারেরও বেশি সময় জুড়ে ছিল সাম্রাজ্যবাদের যুগ, বড় বড় সাম্রাজ্য নিয়ে শাসনকাঠামো গঠিত হতো, মধ্যযুগে এসে যার সাথে যুক্ত হয় উপনিবেশ করে রাখার কর্তৃত্ববাদী ইচ্ছা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ের দেশগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রাম আর রাজতন্ত্রকে উৎখাতের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদের যুগ থেকে জাতিরাষ্ট্রে প্রবেশের যুগ, শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গ্রহণের যুগ। প্রথম ঢেউয়ের প্রভাব পড়ে উত্তর আমেরিকার প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো উপর, শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম।
প্রথমত, “সকল মানুষই সমানভাবে সৃষ্টি”, কিংবা “মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে, পরাধীন হয়ে থাকে সর্বত্র”– রুশোর এই উক্তিগুলো গণতান্ত্রিক বিবর্তনের প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউকে প্রভাবিত করেছিল। ফলে, ব্রাজিল কিংবা লাতিন আমেরিকার অন্যান্য স্প্যানিশ উপনিবেশ, যেখানেই স্বাধীনতা এসেছে, স্বীকার করা হয়েছে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা দাসদের নাগরিক অধিকারকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম নৈতিক ভিত্তি এই সম-অধিকারের ধারণা, রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষে মানুষে বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজন না করা, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন না করা, শ্রেণির ভিত্তিতে বিভাজন না করার ধারণা।
দ্বিতীয়ত, মুক্তবাজার এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অবাধ বাণিজ্য আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার একটি মৌলিক কাঠামো। উপনিবেশ যুগে বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো, নিয়ন্ত্রণ করা হতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল ক্ষুদ্র একটি অংশের। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই লাতিন আমেরিকার দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে বাইরের পৃথিবীর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, বৃদ্ধি পায় আমদানি-রপ্তানি, বৃদ্ধি পায় আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর ফলে, একদিকে যেমন লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে কাঁচামাল রপ্তানি বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে এই রপ্তানি-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন অবকাঠামো। ফলে, নতুন একটি অর্থনৈতিক শ্রেণি তৈরি হয়। মানুষের মাথাপিছু আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
তৃতীয়ত, লাতিন আমেরিকায় স্প্যানিশ উপনিবেশ শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। এরপর প্রায় তিনশো বছর স্প্যানিশরা শাসন করে লাতিন আমেরিকাকে, আফ্রিকা থেকে দাস এনে শুরু করে বিভিন্ন খনিজের মাইনিং। আটলান্টিকের পাড়ে যখন স্বাধীনতার ঢেউ লাগে, তখন তা প্রবাহিত হয় লাতিন আমেরিকানদের মধ্যেও। এক দশকের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ, বাকিগুলো স্বাধীনতা পেয়ে যায় পরবর্তী দশকের মধ্যেই। রাজনৈতিক সংকটের সুযোগে স্বল্প সময়ে শাসনব্যবস্থার এ পরিবর্তন প্রমাণ করে, রাজতন্ত্র মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত শাসনব্যবস্থা নয়, সাম্রাজ্যবাদও নয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক চুক্তির অংশ।
চতুর্থত, উপনিবেশ শাসনামলে রাজতন্ত্রের পাশাপাশি কতিপয়তন্ত্র চলছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। রাজনৈতিক ক্ষমতা আর সম্পদ সীমাবদ্ধ ছিল ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণির হাতে, সীমাবদ্ধ ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগও। ফলে, স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ শুরু হলে, এই অভিজাত অংশ বিরোধিতা করে স্বাধীনতার, সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতাকামীদের সাথে। স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে এই ক্ষুদ্র অভিজাত অংশের কাছে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা ছড়িয়ে পড়ে বৃহৎ অংশের কাছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুবিধা বণ্টনের সুযোগ তৈরি হয়।
পঞ্চমত, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করে, স্বাধীনতার সমর্থক ছিল নাগরিকদের সিংহভাগ। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেলেও, শাসনকাঠামোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে লেগেছে দীর্ঘ সময়। স্বাধীনতার পরে দু’শো বছরের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই কেটেছে স্বৈরশাসনের অধীনে, কেটেছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আসা শাসকের কর্তৃত্ববাদী আচরণের মধ্য দিয়ে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার এই দীর্ঘ পরিক্রমা দেখিয়ে দেয়, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতার গুরুত্ব, নাগরিকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের গুরুত্ব, রাজা জনের মতো শাসকদের ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সীমিত করার গুরুত্ব।
আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের প্রথম ঢেউয়ের পরিবর্তনগুলোকে স্থায়ী করতে দীর্ঘ সময়ে লেগেছে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ের দেশগুলোর। প্রথম ঢেউয়ের ফলে সৃষ্ট দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিবর্তনগুলোকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে দীর্ঘ সময়ে লেগেছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর। সাংবিধানিক দুর্বলতার সুযোগে এসব দেশে কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঘটেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার সুযোগে এসেছে সামরিক শাসকরা। রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুযোগ দিয়েছে তাদের পুনরুত্থানের। এরপরও, সময়ের সাথে, উদার গণতন্ত্রের সাথে মানুষ নিজের স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধন প্রকাশ করেছে, বারবার শাসনব্যবস্থাকে ফিরিয়ে নিয়েছে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে।