২০২২ সালের শুরুতে ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই সেটাকে পুতিনের শেষের শুরু হিসেবে দেখেছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, পুতিন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আন্দোলনের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন, আবার মুখোমুখি হতে পারেন সামরিক বিদ্রোহেরও। ইউক্রেনে রাশিয়া যখন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, বিশ্লেষকরা তখন রাশিয়ার ক্ষমতাকাঠামোর শীর্ষে পুতিনের কর্তৃত্বের সমাপ্তির দিন গণনা শুরু করেছিলেন।
আবার, ক্রিমিয়া দখল (কিংবা পুনর্দখলের) পর থেকেই রাশিয়া একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রয়েছে, অগণিত নিষেধাজ্ঞা এসেছে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর। এমতাবস্থায় বিশ্লেষকরা ক্ষমতায় পুতিনের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছিলেন।
এই প্রশ্ন শুরুর আরেকটি কারণ ছিল- রাশিয়ার রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে অলিগার্করা। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর রাশিয়ান অলিগার্করা নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন, ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও ভালো চলছিল না, ফলে সম্ভাবনা ছিলো অলিগার্করা পুতিনের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার।
কিন্তু, ইউক্রেন অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে না পারার ব্যর্থতা রাশিয়ার নেতৃত্ব থেকে পুতিনকে সরিয়ে দেয়নি, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পুতিনের ক্ষমতার ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারেনি, রাশিয়ান অলিগার্করাও চলে যায়নি পুতিনের বিরুদ্ধে। বরং, পুতিন এখনও রাশিয়ার অবিসাংবাদিত নেতা, রাশিয়াতে পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে পুতিনের, অলিগার্করাও এখনও পুতিনের শাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করছে। এর সাথে উত্থান ঘটেছে পুতিনের অ্যাপ্রুভাল রেটিংও, ছাড়িয়ে গেছে সামরিক অভিযানপূর্ব জনপ্রিয়তা।
পুতিনের জনপ্রিয়তা
২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভ্লাদিমির পুতিনের অ্যাপ্রুভাল রেটিং ছিল ৬৯ শতাংশ, যুদ্ধ শুরুর পর বাড়তে শুরু করে সেটি। ২০২২ সালের মার্চের শুরুতেই রেটিং দাঁড়ায় ৮৩ শতাংশে; যুদ্ধের বহু উত্থান-পতনের পর আগস্টে এসেও স্থির আছে ৮৩ শতাংশেই, ডিস-অ্যাপ্রুভাল রেটিং ছিল ১৫ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রেটিং ৪১থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। রাশিয়াতে পুতিনের জনপ্রিয়তার অনেকগুলো মৌলিক কারণ রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক কারণ।
রাশিয়ান জাতীয়তাবাদ
পুতিনের নেতৃত্বাধীন ক্রেমলিন প্রশাসন একটি দীর্ঘ সময় ধরেই প্রচার করছে, পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে পরাস্ত করতে চায়, ভেঙে দিতে চায় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার কর্তৃত্ব খর্ব করতে চায়। পুতিনের এই জাতীয়তাবাদী প্রচারের পক্ষে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আছে, আছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণও। একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পুতিনের এই জাতীয়তাবাদী দাবিকে শক্তিশালী করেছে, বাড়িয়েছে তার জনপ্রিয়তা।
পুতিনের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব
রাশিয়ানদের অনেকেই গণতন্ত্রকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকার করেন না, গণতন্ত্রের চেয়ে অন্য অনেক কিছুকেই তারা প্রাধান্য দেয়। এর মধ্যে আছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে শক্তিশালী শাসকের প্রাধান্য। রাশিয়ানরা শক্তিকে সম্মান করে, দুর্বলতাকে ঘৃণা করে, বিশেষ করে সামরিক দুর্বলতাকে।
পুতিন রাশিয়ানদের সামনে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তুলে ধরেছেন, তার ব্যক্তিত্ব নির্মাণে সহযোগিতা করেছে অনুগত মিডিয়াগুলো। তিনি রাশিয়াকে সোভিয়েত পরবর্তী ইয়েলৎসিনের সময়কার বিশৃঙ্খলা থেকে বের করে এনেছেন, অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ক্রিমিয়াকে দখল করেছেন সামরিক উপায়ে, সামরিক অভিযান চালিয়েছেন চেচনিয়া ও জর্জিয়াতেও। এসব সামরিক অভিযান পুতিনের জনপ্রিয়তা স্থায়ীভাবে বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করেছে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি
রাশিয়ানরা হাজার বছর ধরে রাজতন্ত্রের অধীনে আছে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিকাশ শুরু হলেও অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়া আবার প্রবেশ করে কর্তৃত্ববাদী যুগে, কমিউনিস্টদের হাত ধরে। নব্বইয়ের দশকে এসে প্রথমবারের মতো রাশিয়াতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ শুরু হয়, শুরু হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এটি আইডিওলজিক্যালি খুব আদর্শিক হলেও, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সফলতা খুব বেশি ছিল না, গণতন্ত্রায়নও রাশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
রাশিয়াকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশের ঘটনাপ্রবাহ থেকে রক্ষা করেন ভ্লাদিমির পুতিন, সময়ের সাথে হয়ে ওঠেন কতৃত্ববাদী। হাজার বছর ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে থাকা রাশিয়া পুতিনের অধীনে আবার স্বরূপে ফেরে, পুতিনও হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় নেতা।