বাংলাদেশে জোট রাজনীতির ইতিবৃত্ত || পর্ব ১ এর পর থেকে
এরশাদ পরবর্তী বাংলাদেশে জোট রাজনীতি
(প্রথম মেয়াদে বেগম জিয়া)
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধারক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার শরিক আট দলগুলোর সাথে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে ঐকমত্য হতে পারে না। সেকারণে জোট থেকে দলগুলো বেরিয়ে গিয়ে বামফ্রন্টের পাঁচ দলের সাথে মিলে ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট’ নামক একটি জোট গঠন করে। পরে, আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া শুরু করলেও এককভাবে পাঁচটি দলকে ৩৬টি আসন ছেড়ে দেয়। ফলে, ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট’-এর ভেতরেও টানাপোড়ন শুরু হয়। জোটের কেউ কেউ জোট ছেড়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জনসংযোগে মন দেয়। আবার কেউ কেউ একইসাথে আওয়ামীলীগ ও গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট দুটো রাজনৈতিক ঘরানা থেকেই মনোনয়ন লাভ করেন। ফলে, আওয়ামী ঘরানায় খানিকটা বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে যেটি নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিজয়কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
অপরদিকে, বিএনপি জামায়াতের সাথে আসন ভাগাভাগিতে ঐকমত্যে পৌঁছায়। জামায়াতকে ৬৮টি আসন ছেড়ে দেয় বিএনপি। উক্ত সমঝোতাকে জামায়াত আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলেও বিএনপির পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে নীরবতা বজায় রাখা হয়। ইসলামপন্থী দলগুলো পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ নামে আরেকটি জোট গঠন করে। নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি, জামায়াত ১৮টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, বাকশাল ৫টি, সিপিবি ৫টি অন্যান্য দল ৬টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসন লাভ করে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠিত হয়। সরকারে যাওয়ার পরে বিএনপি তত্ত্বাবধারক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রশ্নে জামায়াতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। পরে, তত্ত্বাবধারক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তখন, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (খালেক), জাসদ (ইনু), বাসদ (মাহবুব), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, সাম্যবাদী দল ও ঐক্য প্রক্রিয়া মিলে ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ পঠন করে। এরাও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মতো তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনে যোগ দেয়।
খালেদা জিয়া সরকারে থাকাবস্থায়ই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ বিরোধী দল এ নির্বাচন বয়কট করে। সারাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলোতে মোট ২১% ভোট পড়ে। ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেও ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১২ দিন।
শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে জোট রাজনীতি
একই বছর ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় পার্টি ও জাসদ (রব)-কে সাথে নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। ১২০টি বিরোধী দলীয় আসন নিয়ে বিএনপিজোট (বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট) সংসদে শক্তপোক্ত অবস্থানে থাকে।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের কিছুদিন পরেই বিরোধী দলগুলোর সাথে টানাপোড়ন শুরু হয়। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ তোলে যে সংসদে তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে বিএনপি, জামায়াত এবং সরকারের শরিক জাতীয় পার্টিও সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। সরকারের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতীয় পার্টি সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয়। এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি বড় অংশ বিএনপির সাথে জোট বাঁধে। কিন্তু আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি অংশ সরকারের সাথে থেকে যায়। এরশাদের জাতীয় পার্টি বিএনপি জোটে যোগ হওয়ার পরে বিএনপি জোটের নাম হয় ‘চার দলীয় ঐক্যজোট’।
চার দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে ১৯৯৯ সালে। এরশাদ বিএনপি জোটেও বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। তিনি বিএনপি জোট ছাড়ার সময় জাতীয় পার্টিতে আবার ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির এক অংশ দল থেকে বেরিয়ে যায় এবং বিএনপি জোটে অবস্থান নেয়। জাতীয় পার্টি (নাজিউর) বিজেপি নামে এখনও বিএনপির সাথে জোট বেঁধে সব ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরশাদ চারদলীয় জোট থেকে বের হয়ে গিয়ে কতিপয় কয়েকটি ইসলামপন্থী দল নিয়ে ‘ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামীয় আরেকটি জোট গঠন করে যেটির ব্যানারেই তিনি ও তার দল পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই অংশগ্রহণ করেছিল। এটি ছিল ১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে দ্বিতীয় নির্বাচন।
বেগম জিয়ার তৃতীয় মেয়াদে জোট রাজনীতি
চার দলীয় জোট সরকারে শরিক জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাদের মন্ত্রীসভায় স্থান দেওয়া নিয়ে জোটের ভেতরে অন্তঃদ্বন্দ্ব চলে কিছুদিন। সংসদে একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ছিল একদম একা। তখন সরকারের শাসনের অন্তিম লগ্নে বিরোধীপক্ষীয় একমাত্র জোট ছিল ১১ দলীয় বামজোট। জোটের শরিক দলগুলো যথাক্রমে সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, বাসদ (খালেক), বাসদ (মাহবুব), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল।
সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ বামজোটের সাথে সমঝোতায় অগ্রসর হয়। এর ফলে বাসদের দুই অংশ, সিপিবি ও কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল জোট থেকে বেরিয়ে যায়। অন্য সাত দল আওয়ামীলীগের সাথে জোট গঠনে রাজি হয়। জাসদ (ইনু), ন্যাপ (মোজাফফর), জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও খেলাফত মজলিস আওয়ামীলীগের সঙ্গে যোগ দেয়। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। একে মহাজোটও বলা হয়েছিল।
বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদের শেষের দিকে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, মাইজভান্ডারির তরিকত ফেডারেশন এবং বি. চৌধুরীর বিকল্প ধারার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একসময় ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যান মাইজভান্ডারি। পরে ড. কামালও বেরিয়ে যান ঐক্যফ্রন্ট থেকে। সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তারা আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন। গঠন করেন জাতীয় যুক্তফ্রন্ট। গণফোরাম ও বিকল্প ধারার পাশাপাশি এ দলে ছিল ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপি, জেনারেল ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ ফরোয়ার্ড পার্টি।
তবে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল মহাজোট ও চারদলীয় জোটের মধ্যে। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধারক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় পরবর্তীতে দেশীয় জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ ও মেরুকরণ তৈরি করেছিল।
আওয়ামী শাসনামলে জোট রাজনীতি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগির প্রশ্নে আবার জোটের শরিকদের ভেতর মন কষাকষির জন্ম হয়। জোটর শরিকদের ভেতর থেকে একমাত্র জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এবং সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ছাড়া কেউ মন্ত্রিত্ব পায় না। আওয়ামীলীগ তত্ত্বাবধারক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দিলে বিরোধী দলগুলো জোরেশোরে সরকার বিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে।
২০১২ সালে বিএনপি চারদলীয় জোটকে বিলুপ্ত করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে। জোটের শরিক দলগুলো হলো বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, জাগপা, এনপিপি, লেবার পার্টি, এনডিপি, বাংলাদেশ ন্যাপ মুসলিম লীগ, ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগ ও পিপলস পার্টি। এরা সবাই বিএনপির নেতৃত্বে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামে। ১৮ দলীয় জোট পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোটে পরিবর্তিত হয়।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বয়কট করে এ জোট। ফলে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩টি আসনে জিতে যায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দশম জাতীয় সংসদ ছিল ২০ দলীয় জোটশূন্য। পরে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’-এ যোগ দেয়।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী শুরুতে ঐক্যফ্রন্টে থাকেন। পরে মতের মিল না হওয়ায় ফ্রন্ট ছেড়ে আওয়ামী জোটে শরিক হন। ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলো হলো গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট লাভ করে মাত্র সাতটি আসন।
পরিশেষে
জোটের রাজনীতি শুধু বাংলাদেশে নয় পুরো উপমহাদেশেই বিস্তৃত ও বিখ্যাত। সুষ্ঠু গণতন্ত্রে জোট গঠনের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। বহুদলীয় এবং বহুজাতিক বা বৃহৎ দেশগুলোর রাজনীতিতে জোটের আবির্ভাব খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে জোট রাজনীতি ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত। অঞ্চলভিত্তিক বা রাজ্যভিত্তিক রাজনীতি চর্চার দরুন যেকোনো দলের পক্ষে এককভাবে কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণ করা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। ১৯৭৫ পরবর্তী ভারতে কংগ্রেস ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি সর্বস্তরীয় মানুষ ছিল বিতৃষ্ণা। ১৯৭৭ এর জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসকে হারানোর জন্যে চারটি বিরোধী দল মিলে জনতা পার্টি (জেএনপি) নামক জোট গঠন করে, যেটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে কংগ্রেসকে হারিয়ে দেয়। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
শাসনকার্যে জোটের অনভিজ্ঞতা ও অপারগতার দরুন জনতা পার্টি পরের নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হয়। গটবন্ধনের সরকার ভারতে হামেশাই দেখা যায়। জোটের রাজনীতিতে অনেক সময় ক্ষুদ্র একটি দলও ব্যাপক গুরুত্ব লাভ করে। জোট গঠনের সঠিক বা সংবিধিবদ্ধ কোনো নিয়ম নেই। শরিক দলগুলো নিজেদের ভেতর আলোচনার মাধ্যমে অংশীদারি ঠিক করে নেয়। দুটো বিপরীত ধারার বা বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক দলও জোটে একতাবদ্ধ হতে পারে। সমঝোতা, আস্থা ও আদর্শ জোট গঠনের পূর্বশর্ত।