২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন যে, আরব রাষ্ট্র বাহরাইন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। মিসর, জর্দান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত/ইমারাতের পর পারস্য উপসাগরীয় ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন চতুর্থ আরব রাষ্ট্র হিসেবে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে অগ্রসর হলো। বিশেষত ২০২০ সালের আগস্টে ইমারাতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাত্র এক মাসের মধ্যে বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন একটি ধাপের সূচনা করেছে।
বাহরাইন রাষ্ট্রটি বাহরাইন দ্বীপসহ ৪০টি প্রাকৃতিক দ্বীপ ও ৫১টি কৃত্রিম দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র, যেটি কাতার এবং সৌদি আরবের উত্তর–পূর্ব উপকূলের মধ্যে অবস্থিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মাত্র ৭৮০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল। ১৫২১ থেকে ১৬০২ সাল পর্যন্ত ভূখণ্ডটি পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং এরপর ইরানকেন্দ্রিক সাফাভি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ১৭৮৩ সাল থেকে আল–খলিফা রাজবংশ বাহরাইনের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাহরাইন ব্রিটেনের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের আগস্টে রাষ্ট্রটি ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। রাষ্ট্রটি প্রথমে ছিল একটি ‘আমিরাত’, কিন্তু পরবর্তীতে একটি ‘ইসলামি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে’র রূপ ধারণ করে।
বাহরাইনের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ ৯০ হাজার। রাষ্ট্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৫০.৭% জাতিগতভাবে আরব, ৪৫.৫% অনারব এশীয় এবং বাকিরা অন্যান্য জাতিভুক্ত। রাষ্ট্রটির অনারব জনসংখ্যার সিংহভাগই বিদেশি নাগরিক, যাদের বাহরাইনের নাগরিকত্ব নেই। বাহরাইনের জনসংখ্যার প্রায় ৭০.৩% মুসলিম, যাদের মধ্যে প্রায় ৬২% শিয়া এবং প্রায় ৩৮% সুন্নি। সংখ্যাগত দিক থেকে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাহরাইনের শাসক আল–খলিফা রাজবংশ এবং বাহরাইনি অভিজাতদের সিংহভাগ সুন্নি মুসলিম, ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রটিতে শিয়া–সুন্নি দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।
আরব বিশ্বের অংশ হিসেবে বাহরাইন দীর্ঘদিন যাবৎ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বাহরাইনের জনসাধারণও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের নিদর্শনস্বরূপ বাহরাইন দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান বা ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত ছিল। কিন্তু মিসর, সিরিয়া, জর্দান বা লেবাননের মতো বাহরাইন কখনো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘ফ্রন্টলাইন স্টেট’ হিসেবে ছিল না। ইসরায়েল থেকে বাহরাইন প্রায় ২,০০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত এবং এ পর্যন্ত কোনো আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে বাহরাইন সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি।
তদুপরি, বাহরাইন ও ইসরায়েল উভয়েই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্ররাষ্ট্র। বাহরাইনে মার্কিন নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহরের সদর দপ্তর অবস্থিত এবং এজন্য পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাহরাইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলাই বাহুল্য, বাহরাইন ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূল ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু বাহরাইন ও ইসরায়েলের মধ্যেকার সম্পর্কোন্নয়নকে সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে। অন্তত তিন দশক ধরে বাহরাইন এবং ইসরায়েলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বিদ্যমান। ১৯৯০–এর দশকে ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় থেকেই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলি পরিবেশমন্ত্রী ইয়োসি সারিদের নেতৃত্বে একটি ইসরায়েলি প্রতিনিধি দল আনুষ্ঠানিকভাবে বাহরাইন সফর করেছিল এবং তখন থেকেই রাষ্ট্র দুটির মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়। এই যোগাযোগ কেবল শান্তি আলোচনা বা ফিলিস্তিন সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছিল।
উইকিলিকসের তথ্য অনুসারে, ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাহরাইনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম মনরোর সঙ্গে এক বৈঠকে বাহরাইনের রাজা হামাদ বিন ঈসা আল–খলিফা জানিয়েছিলেন যে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তিনি আরো জানান, তার নির্দেশে বাহরাইনের প্রচার মাধ্যমগুলোতে ইসরায়েলবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাহরাইন ও ইসরায়েলের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিলে তিনি জানান, এরকম সম্পর্ক স্থাপনের সময় তখনও আসেনি।
২০০৭ সালের অক্টোবরে বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালিদ বিন আহমেদ আল–খলিফা ‘মার্কিন ইহুদি কমিটি’র সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন এবং একই মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৎজিপি লিভনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। অবশ্য এজন্য তাকে বাহরাইনের আইনসভায় তোপের মুখে পড়তে হয়। ২০১৬ সালে বাহরাইনে ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব ‘হানুক্কাহ’ উদযাপিত হয় এবং এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকালে বাহরাইনের রাজা হামাদ বিন ঈসা আল–খলিফা প্রকাশ্যেই ইসরায়েলকে বয়কট করার ব্যাপারে আরব লীগের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানান এবং বাহরাইনের নাগরিকদের প্রয়োজনে ইসরায়েল সফরের অনুমতি প্রদান করেন।
২০১৮ সালের মে মাসে বাহরাইন আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের ‘অস্তিত্বের অধিকার’কে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৯ সালের জুনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনি–ইসরায়েলি শান্তি প্রস্তাবের অর্থনৈতিক দিক নিয়ে বাহরাইনে একটি কর্মসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বাহরাইন ৬টি ইসরায়েলি প্রচার মাধ্যমকে এতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানায়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালিদ বিন আহমেদ আল–খলিফা এবং ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাক্ষাৎ করেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা এবং ডিসেম্বরে জেরুজালেমের প্রধান ধর্মীয় নেতা বাহরাইন সফর করেন।
২০২০ সালের আগস্টে ইমারাতি–ইসরায়েলি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর বাহরাইন প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েল ও ইমারাতের মধ্যে বিমান চলাচলের জন্য নিজস্ব আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে। অবশ্য এর অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বাহরাইনের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে এবং ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রটি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়। উল্লেখ্য, ইমারাত ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার বিনিময়ে ইসরায়েল সাময়িকভাবে পশ্চিম তীরে ভূমি দখল থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে সম্মত হওয়ার বিনিময়ে ইসরায়েল অনুরূপ কোনো ছাড় প্রদান করেনি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাহরাইন কেন ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল? কেনই বা বাহরাইন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হলো? বস্তুত এর উত্তর খোঁজার জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বাহরাইনের অবস্থান এবং বিশেষত ইরান, সৌদি–ইমারাতি অক্ষ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাহরাইনের সম্পর্ক বোঝা জরুরি।
প্রথমত, ইরান ও বাহরাইনের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের পিছনে রাজনৈতিক, ভূকৌশলগত ও ধর্মীয় কারণ রয়েছে। বাহরাইন একসময় ইরানের অংশ ছিল এবং সেজন্য ইরান বাহরাইনকে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। ১৯৭০ সালে রেজা শাহ পাহলভির শাসনাধীন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ইরান বাহরাইনকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে দাবি করেছিল, কিন্তু ব্রিটিশ মধ্যস্থতার কারণে সাময়িকভাবে সেই দাবি পরিত্যাগ করে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর রাষ্ট্রটির শিয়া–নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও ইরানের অনুরূপ ইসলামি বিপ্লব ‘রপ্তানি’ করার প্রচেষ্টা চালায়। বাহরাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু শিয়া, স্বভাবতই ইরান বাহরাইনেও বিপ্লব ‘রপ্তানি’ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯৮১ সালে বাহরাইনি শিয়ারা একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বাহরাইন এজন্য ইরানকে দায়ী করে, এবং ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়।
২০০০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের সঙ্গে বাহরাইনের সম্পর্কের আংশিক উন্নতি ঘটে, কিন্তু ২০১১ সালে আরব বসন্ত বাহরাইনেও ছড়িয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভকারীদের সিংহভাগই ছিল শিয়া এবং ইরান এই বিক্ষোভকে সমর্থন জানালে উভয় পক্ষের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। বাহরাইনি সরকার রাষ্ট্রটির শিয়া অধিবাসীদের বিক্ষোভের জন্য উস্কে দেয়া, শিয়া বিরোধী দলগুলোকে সহায়তা করা, বাহরাইনের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসবাদী’ কার্যক্রম পরিচালনা ও আরো বিভিন্ন অভিযোগে ইরানকে অভিযুক্ত করেছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ইরানে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসে হামলার পর বাহরাইন সৌদি আরবের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
বস্তুত বাহরাইনের ক্ষমতাসীন আল–খলিফা রাজবংশ ইরানকে নিজেদের ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে, ইরানি দৃষ্টিকোণ থেকে বাহরাইনের বর্তমান সরকার ‘সৌদি ও পশ্চিমাদের পুতুল’ এবং তারা বাহরাইনি শিয়াদের ওপর নিষ্পেষণ চালাচ্ছে। এমতাবস্থায় ইরানি–ইসরায়েলি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে বাহরাইন ‘ইরানি হুমকি’ মোকাবেলা করার জন্য (অর্থাৎ আল–খলিফা রাজবংশের টিকে থাকার জন্য) ইসরায়েলি সহায়তা লাভ করতে আগ্রহী।
দ্বিতীয়ত, ঐতিহ্যগতভাবে বাহরাইন সৌদি আরব ও ইমারাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ২০১১ সালে বাহরাইনের গণআন্দোলন দমন করার জন্য সৌদি আরব ও ইমারাত বাহরাইনে সৈন্য প্রেরণ করেছিল এবং আল–খলিফা রাজবংশের ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে সৌদি–ইমারাতি হস্তক্ষেপের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ২০১১ সালের এই গণআন্দোলনের ফলে বাহরাইনি সরকারের অভ্যন্তরীণ গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে, এবং ফলশ্রুতিতে বাহরাইন বিশেষত সৌদি জোটের ওপর মাত্রাতিরিক্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তদুপরি, ২০১৮ সালে সৌদি আরব বাহরাইনকে অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে প্রায় ১,০০০ কোটি বা (১০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করেছিল। অর্থাৎ, বাহরাইন সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সৌদি–ইমারাতি অক্ষের ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি–ইরানি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের সঙ্গেও সৌদি–ইমারাতি জোটের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি–ইমারাতি জোটের পক্ষে একাকী ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। এদিক থেকে ইরানি–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বের কারণে ইরানের ব্যাপারে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি–ইমারাতি জোটের অবস্থানের সামঞ্জস্য রয়েছে। ইসরায়েল ও সৌদি–ইমারাতি জোট উভয়েই মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব সীমিত রাখতে আগ্রহী। এরই অংশ হিসেবে ইমারাত ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে এবং ধারণা করা হচ্ছে যে, সৌদি আরবও ভবিষ্যতে একই পথ অনুসরণ করবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অন্যান্য কৌশলগত কারণে সৌদি আরবের পক্ষে এখনই ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সৌদি–ইসরায়েলি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এক্ষেত্রে, বাহরাইন মূলত সৌদি প্রভাবের ফলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত, বাহরাইন ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের তুলনামূলক বিচ্ছিন্নতাকে হ্রাস করা এবং ইরান ও অন্যান্য মার্কিনবিরোধী শক্তির বিপরীতে ইসরায়েলের অবস্থান শক্তিশালী করা এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এর পাশাপাশি মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থও এর সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতা লাভের পর থেকে ট্রাম্প ফিলিস্তিনি–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বে খোলাখুলিভাবে ইসরায়েলের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তিনি ইসরায়েলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ‘ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা’র (পিএলও) কার্যালয় বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং সিরিয়ার কাছ থেকে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলি ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এসব ইসরায়েলপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণের পেছনে ট্রাম্পের মূল উদ্দেশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নিজস্ব জনসমর্থন বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবি অত্যন্ত সংগঠিত ও প্রভাবশালী, এবং মার্কিন ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানদের মধ্যে ইসরায়েলপ্রীতি ব্যাপক। আসন্ন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয় লাভের জন্য ট্রাম্পের এদের সমর্থন প্রয়োজন। এজন্য ইমারাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে ট্রাম্প অভ্যন্তরীণ সমর্থন বৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাহরাইনের ওপর মার্কিন প্রভাব এমনিতেই বেশি, এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে এটি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ওবামা প্রশাসন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাহরাইনের নিকট এফ–১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, কিন্তু ট্রাম্প সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ফলে স্বভাবতই বাহরাইনের ওপর তিনি তুলনামূলক বেশি প্রভাব প্রয়োগ করতে পেরেছেন।
সর্বোপরি, সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃত্ববাদী বা কার্যত একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। চাদ ও সুদান থেকে শুরু করে ইমারাত সকলের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। এই কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতকে দমন করার জন্য ইসরায়েলি প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা সহায়তা লাভে আগ্রহী। বাহরাইনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে অনুমেয়।
অন্যদিকে, বাহরাইন একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হতে পারে, কিন্তু বাহরাইনের স্বীকৃতি লাভ ইসরায়েলের জন্যও অত্যন্ত লাভজনক। বাহরাইন যেহেতু কার্যত সৌদি আরবের ‘আশ্রিত রাষ্ট্র’ স্বরূপ, এজন্য বাহরাইন কর্তৃক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানের অর্থ ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে বড় একটি অগ্রগতি। বিপুল পরিমাণ জ্বালানির মজুদসমৃদ্ধ এবং ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কা ও মদিনার কর্তৃত্বধারী সৌদি আরবের সমর্থন ইসরায়েলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে গণ্য হবে।
তদুপরি, বাহরাইনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ফলে পারস্য উপসাগরে ইসরায়েলের সামরিক উপস্থিতি গড়ে তোলার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এর ফলে একদিকে যেমন ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে ইসরায়েলি প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনারও সুযোগ তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে ইরানের উত্তরে আজারবাইজানে অবস্থিত বিমানঘাঁটি এবং দক্ষিণে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত নৌঘাঁটির মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানকে কৌশলগতভাবে ঘেরাও করে ফেলতে সক্ষম হবে।
বাহরাইনের অভ্যন্তরে অবশ্য বাহরাইন–ইসরায়েল স্বাভাবিকীকরণের প্রতি সেখানকার জনগণের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। বাহরাইনের আরব জনসাধারণের বৃহদাংশ এখনো ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বাহরাইনি সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের মতো বাহরাইনেও পররাষ্ট্রনীতির ওপর জনমতের প্রত্যক্ষ প্রভাব সীমিত, তাই এটি বাহরাইনের সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে বলে প্রতীয়মান হয় না।
বস্তুত, সৌদি–ইমারাতি অক্ষের ওপর বাহরাইনের নির্ভরশীলতা, বাহরাইনের ওপর মার্কিন প্রভাব, বাহরাইনের ক্ষমতাসীন আল–খলিফা রাজবংশের ইরানভীতি এবং নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ – এই কারণগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে বাহরাইনকে পরিচালিত করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয়/সরকারি স্বার্থ যে নৈতিক/সাংস্কৃতিক/ধর্মীয়/জনমত সংক্রান্ত বিবেচনার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, বাহরাইনের এই সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ মাত্র!