প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কি এর আগেও একবার কিডন্যাপ হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে।
সুলতান বিন তুর্কি ছিলেন একইসাথে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ’র ভাইয়ের ছেলে, এবং মেয়ের জামাই। সরকারি কোনো পদে না থাকলেও তার আরেক চাচা, বাদশাহ ফাহাদের আশেপাশে তাকে প্রায়ই দেখা যেত। বেশিরভাগ সময়ই তিনি থাকতেন ইউরোপে। সেখানে তিনি হোটেলে হোটেলে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন এবং মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের সাথে সৌদি রাজপরিবার ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। এবং এই কথাবার্তাই শেষ পর্যন্ত তার কাল হয়েছিল।
২০০৩ সালে তিনি যখন লেবাননের প্রধান মন্ত্রী রফিক হারিরির দুর্নীতির সমালোচনা করেন, এবং মন্তব্য করেন যে সৌদি আরবের উচিত হারিরির প্রতি অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া, তখন তার চাচাতো ভাই, বাদশাহ ফাহাদের পুত্র, প্রিন্স আব্দুল আজিজ সেটাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে নেন। কারণ হারিরি ছিলেন আব্দুল আজিজের ব্যক্তিগত বন্ধু। এর কয়েক মাস পরে প্রিন্স সুলতান যখন আবারও গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান, এবং দাবি করেন যে তিনি সৌদি রাজপরিবারের ২৫ বছরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে যাচ্ছেন, তখন আব্দুল আজিজ সিদ্ধান্ত নেন সুলতানকে সরিয়ে দিতে হবে।
আব্দুল আজিজ বিন ফাহাদ এবং সুলতান বিন তুর্কি, উভয়েই সে সময় জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। একদিন সুলতানকে জেনেভায় অবস্থিত বাদশাহ ফাহাদের প্রাসাদে ডিনারের নিমন্ত্রণ জানান আব্দুল আজিজ। শুরুতে তিনি ভদ্রভাবেই সুলতানকে সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সুলতান যখন তাতে অস্বীকৃতি জানান, তখন আব্দুল আজিজের গার্ডরা তাকে চেপে ধরে, সিডাটিভ দিয়ে তাকে অচেতন করে ফেলে এবং টেনে-হিঁচড়ে রয়্যাল এরোপ্লেনে করে তাকে রিয়াদে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
প্রিন্স সুলতানের জীবনের পরবর্তী ১১ বছর কাটে কারাগার এবং হাসপাতালে। সিডাটিভের ডোজ বেশি হয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, অথবা তার প্রায় ২০০ কেজি ওজনের অচেতন দেহকে টানা-হেঁচড়া করার কারণেই হোক, সুলতানের পায়ের সাথে বক্ষ ও উদরের মধ্যবর্তী ঝিল্লীর সংযোগ স্থাপনকারী নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১১ বছর পর, ২০১৪ সালে বন্দী অবস্থাতেই যখন তিনি সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হন, তখন সৌদি সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যাওয়ার অনুমতি দেয়। তারা আশা করছিল মৃত্যুপথযাত্রী, আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই প্রিন্স হয়তো আর রাজপরিবারের জন্য হুমকি হবে না। কিন্তু সুলতানের বেপরোয়া জীবনের সেটা ছিল কেবল শুরু।
২০১৫ সালের দিকে সুলতানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। এবং সেই সাথে শুরু হয় তার উচ্ছৃঙ্খল, বিলাসবহুল জীবন-যাপন। তিনি সঙ্গী-সাথী এবং সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। কখনো প্যারিসে, কখনো অসলো, বার্লিন বা জেনেভায়। একটি সুইস মডেলিং এজেন্সি থেকে তিনি পালাক্রমে “গার্লফ্রেন্ড” ভাড়া করতে শুরু করেন। তার মাসিক খরচ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে।
ততদিনে সৌদি রাজপরিবারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাদশাহ ফাহাদের পর কিছুকাল ক্ষমতায় ছিলেন সুলতানের সাবেক শ্বশুর, বাদশাহ আব্দুল্লাহ। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন সুলতানের আরেক চাচা, বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। আব্দুল্লাহ এবং সালমান কেউই টাকা-পয়সা খরচের দিক থেকে ফাহাদের মতো উদার ছিলেন না। তারা বিভিন্ন দিক দিয়ে খরচ কমানোর চেষ্টা করছিলেন। এবং সুলতানও বুঝতে পারছিলেন, তার এই বিলাসবহুল জীবনযাপন হয়তো আর বেশি দিন চালানো সম্ভব হবে না। কোনো একদিন হয়তো হঠাৎ করেই বাদশাহ সালমান তার ভাতার পরিমাণ কমিয়ে দেবেন। নিজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য সুলতান এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রিন্স সুলতান সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সৌদি সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবেন। তার দৃষ্টিতে তার ২০০৩ সালের অপহরণ এবং তার ফলে সৃষ্ট শারীরিক অক্ষমতার জন্য যেহেতু সৌদি সরকার দায়ী, তাই তিনি সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। কারণ তিনি যদি মুক্ত এবং সুস্থ থাকতেন, তাহলে অন্যান্য প্রিন্সদের মতো এতদিনে তিনি নিজেও কোনো একটা কোম্পানি বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে মিলিয়নিয়ার বনে যেতে পারতেন।
প্রিন্স সুলতান প্রথমে তার চাচাতো ভাই, প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে যোগাযোগ করেন। মোহাম্মদের সাথে তার পূর্ব পরিচয় ছিল না। তিনি যখন প্রথমবার অপহরণের শিকার হয়েছিলেন, মোহাম্মদ বিন সালমান তখনও কিশোর। সে সময় তাকে কেউই চিনত না। কিন্তু সালমান ক্ষমতায় আসার পর সেই মোহাম্মদই হয়ে উঠেছিলেন রাজপরিবারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। সুলতান বুঝতে পেরেছিলেন, সালমান নামে বাদশাহ হলেও দেশ বাস্তবে চলছে তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানের পরিকল্পনাতেই। কাজেই যদি কিছু চাইতে হয়, সরাসরি তার কাছে চাওয়াই ভালো।
কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমান তার চাচাতো ভাই সুলতানের ইতিহাস জানতেন। যাকে রাজপিবারের সমালোচনার দায়ে তুলে এনে কারাবন্দী করা হয়েছিল, তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো যুক্তি তিনি খুঁজে পেলেন না। সুলতানের অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে এবার সুলতান এক অভাবনীয় কাজ করে বসেন। ২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালে তিনি সুইস কোর্টে সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে তাকে অপহরণের দায়ে মামলা করে বসেন। প্রতিক্রিয়ায় রাজপরিবার থেকে তার খরচ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও তিনি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি খোদ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র শুরু করেন।
সৌদি আরবে যদিও বাদশাহর মৃত্যুর পর বয়সের দিক থেকে তার পরবর্তী ভাইয়েরই বাদশাহ হওয়ার ধারা চলে আসছে, কিন্তু ভাইয়েরা সবাই একমত হলে ক্ষমতার উত্তরাধিকার সম্পর্কে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এখতিয়ার আছে। যদি কোনো বাদশাহ রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্য বলে বিবেচিত হন, তাহলে তার ভাইয়েরা, অর্থাৎ তার পরবর্তী সম্ভাব্য উত্তরাধিকাররা একমত হয়ে তাকে সরিয়ে দিতে পারে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রিন্স সুলতান তার চাচাদের কাছে, অর্থাৎ বাদশাহ সালমানের ভাইদের কাছে দুটো বেনামী চিঠি প্রেরণ করেন।
চিঠি দুটোতে তিনি দাবি করেন, বাদশাহ সালমান হচ্ছেন “অযোগ্য”, “ক্ষমতাহীন”, এবং তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্রীড়নক; তার মানসিক অস্থিতিশীলতা তাকে তার পুত্রের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করেছে। তিনি আরও দাবি করেন, মোহাম্মদ বিন সালমান হচ্ছেন অত্যন্ত দুর্নীতিবাজ, যিনি দুই বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি রাষ্ট্রীয় অর্থ নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছেন। সুলতান প্রস্তাব করেন, সৌদি আরবকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, বাদশাহ সালমানের ভাইরা জরুরী বৈঠকে একত্রিত হয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বাদশাহ’র ভাইয়েরা কিছু করার আগেই সুলতানের এই চিঠি ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানে ফাঁস হয়ে যায়। যদিও চিঠির নিচে কারো নাম ছিল না, কিন্তু সৌদি প্রশাসনের বুঝতে দেরি হয়নি এর লেখক কে হতে পারে। সুলতান তার পরিণতির অপেক্ষা করতে থাকেন। মোহাম্মদ বিন সালমান কি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে? নাকি তার আগেই তার চাচারা তাকে সরিয়ে দেবে? নাকি মোহাম্মদ বিন সালমান তার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে উল্টো আরো টাকা-পয়সা দিতে শুরু করবে?
চিঠিগুলো প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন পরেই সুলতানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাজদরবার থেকে নতুন করে দুই মিলিয়ন ডলার এসে হাজির হয়। সুলতান আশ্বস্ত হন, শেষ পর্যন্ত তাহলে মোহাম্মদ বিন সালমান টাকা দিয়েই তার মুখ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি হোটেলের বকেয়া প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেন এবং নতুন করে ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করেন।
এর মধ্যেই তার বাবা, প্রিন্স তুর্কি বিন আব্দুল আজিজ, যিনি দীর্ঘদিন কায়রোতে বসবাস করছিলেন, তিনি সুলতানকে কায়রোতে বেড়িয়ে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করেন। তিনি আরও জানান, তাকে কায়রো নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজদরবার থেকে বিলাসবহুল রাজকীয় বিমান পাঠানো হচ্ছে। সুলতানের রাজি না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তার কৌশল আসলেই কাজে দিয়েছে। সৌদি প্রশাসন তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করছে না।
যথাসময়ে সৌদি আরব থেকে ১৮৯ জন যাত্রী-ধারণ ক্ষমতাবিশিষ্ট একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এসে প্যারিসে হাজির হয় প্রিন্স সুলতানকে কায়রোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুলতানের স্টাফদের একজন তাকে সতর্ক করেন, এটা হয়তো আগেরবারের মতো ফাঁদ হতে পারে। কিন্তু প্লেনের ক্যাপ্টেন সৌদ যখন প্লেনের নির্ধারিত ক্রুদের মধ্য থেকে দশজনকে প্যারিসেই রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান, তখন সুলতান আশ্বস্ত হন যে এটা অপহরণ হতে পারে না। যথাসময়ে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী, কয়েকজন সহকারী এবং মডেলিং এজেন্সির সরবরাহ করা একজন “গার্লফ্রেন্ড”সহ প্রায় এক ডজন সঙ্গী নিয়ে ২০১৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেন সুলতান।
শুরু থেকেই প্লেনের ভেতরের পরিবেশ ছিল কিছুটা সন্দেহজনক। ১০ জন ক্রুকে পেছনে রেখে যাওয়া সত্ত্বেও প্লেনের ক্রু ছিল ১৯ জন, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। সৌদি রাজকীয় প্লেনগুলোর নিয়মিত দৃশ্য, উন্মুক্ত পায়ের সোনালি চুলের ইউরোপিয়ান সুন্দরী ক্রুরা ছিল অনুপস্থিত। তাদের পরিবর্তে ১৯ জন ক্রুর সবাই ছিল শক্তসমর্থ পুরুষ, যাদেরকে পেশাদার ক্রুর পরিবর্তে নিরাপত্তাকর্মী বলেই বেশি মনে হচ্ছিল।
প্লেনের পাইলট, ক্যাপ্টেন সৌদ ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং হাসিখুশি। কিন্তু সুলতানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজনের প্লেন চালানোর প্রশিক্ষণ ছিল। তার সন্দেহ হতে থাকে, পাইলটের বেশ ধরে থাকলেও ক্যাপ্টেন সৌদ সম্ভবত আসলে পাইলট না। কারণ তার কথাবার্তা মোটেও পাইলটসুলভ ছিল না। একজন পাইলটের যেসব মৌলিক বিষয় জানার কথা, সেগুলোও তিনি জানতেন না।
নিরাপত্তা-কর্মীরা সুলতানকে সাবধান করেন: চলুন ফিরে যাই, এটা ফাঁদ। কিন্তু সুলতান তাদের কথায় পাত্তা দেননি। দীর্ঘদিন পর তিনি কায়রোতে গিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে উন্মুখ ছিলেন। তাছাড়া প্লেনটা পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং বাদশাহপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি তাকে সম্প্রতি ২ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা কেন ফাঁদ হতে যাবে? মোহাম্মদ বিন সালমান একই রকম কিডন্যাপিংয়ের ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটিয়ে রাজপরিবারের সুনাম নষ্ট করার ঝুঁকি কেন নিতে যাবে?
প্রথম দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। কেবিনের স্ক্রিনে প্লেনের অবস্থান দেখা যাচ্ছিল, সেটা কায়রোর পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই স্ক্রিন একটু মিটমিট করে বন্ধ হয়ে যায়। সুলতানের সঙ্গীরা সচকিত হয়ে ওঠেন, “কী ঘটছে?” ক্যাপ্টেন সৌদ ককপিট থেকে ঘুরে এসে জানান, সামান্য কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে, কিন্তু যে ইঞ্জিনিয়ার এটা ঠিক করতে পারবে, সে প্যারিসে রেখে আসা দশজনের মধ্যে একজন। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নাই, এতে কায়রোতে ল্যান্ড করতে কোনো সমস্যা হবে না।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর প্লেন যখন নিচের দিকে নামতে শুরু করে, তখন সবাই বুঝতে পারে জায়গাটা মোটেও কায়রো না। নিচে পিরামিডের কোনো অস্তিত্ব নেই, শহরের ঘনবসতির মধ্য দিয়ে এঁকে-বেঁকে যাওয়া নীল নদের কোনো চিহ্ন নাই, বরং বিস্তৃত ভূমির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘরের সাথে রিয়াদের সাদৃশ্যই বেশি। কিছুক্ষণ পরেই যখন রিয়াদের কিংডম সেন্টার টাউন নামের বিখ্যাত বহুতল ভবনটি দৃশ্যমান হয়, তখন কেবিনজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রিন্স সুলতান তার নিরাপত্তা কর্মীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ওঠেন, “আমার পিস্তলটা দাও!”
গার্ডরা অবশ্য সুলতানকে পিস্তল দেওয়া থেকে বিরত থাকে। প্লেন সৌদি আরবের মাটিতে নামলে যা হবে, তার চেয়ে উড়ন্ত প্লেনের ভেতর গোলাগুলি হলে সেটা আরও বেশি খারাপ হবে। সুলতানের আর কিছুই করার ছিল না। বিমর্ষ চেহারা নিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। প্লেন ল্যান্ড করার পর ক্যাপ্টেন সৌদের লোকেরা তাকে আগেরবারের মতোই টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়।
সুলতানের সঙ্গীদেরকে তিন দিন পর্যন্ত একটি হোটেলে আটকে রাখা হয়। চতুর্থ দিন তাদেরকে এক এক করে একটি সরকারি অফিসের কনফারেন্স হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সুলতানের লোকেরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, এই অফিসার আর কেউ না, প্লেনের সেই ক্যাপ্টেন, সৌদ। তবে পাইলটের ইউনিফর্মের পরিবর্তে তার পরনে এখন লম্বা আলখাল্লা। তিনি নিজের পরিচয় জানান, সৌদ আল-কাহতানি, রাজদরবারের একজন কর্মকর্তা। সৌদ আল-কাহতানি সুলতানের লোকদেরকে দিয়ে একটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টে সাইন করিয়ে নেন, এরপর তাদেরকে টাকা-পয়সা দিয়ে বিদায় করেন।
প্রিন্স সুলতানের অপহরণের ঘটনার আগে সৌদি আরবে সৌদ আল-কাহতানির পরিচয় ছিল “মিস্টার হ্যাশট্যাগ”। কারণ তার দায়িত্ব ছিল টুইটারে একের পর হ্যাশট্যাগ সৃষ্টি করে মোহাম্মদ বিন সালমানের গুণগান গাওয়া এবং তার সমালোচনাকারীদেরকে নিয়ে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করা। প্রিন্স সুলতানকে অপহরণ করা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে বাস্তব জীবনে তার প্রথম বড় ধরনের অপারেশন।
সফল ঐ অপারেশনের সাফল্যের পর রাজপরিবারের অন্য সমালোচকরা ভয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। আর সৌদ আল-কাহতানি পদোন্নতি পেয়ে রাজদরবারের নিরাপত্তা বিভাগে নিজের বিশেষ স্থান অর্জন করে নেন। তিনি হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একজন, যার উপর আরও কঠিন, আরও আক্রমণাত্মক অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকা যায়।
সেরকমই একটা অপারেশন ছিল দুই বছর পরে ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসের ভেতর ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যাকাণ্ড। সৌদ আল-কাহতানি হচ্ছেন ঐ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত নিচের দিকের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সৌদি সরকার বাধ্য হলেও সৌদ আল-কাহতানির বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে কোনো মামলাও করা হয়নি। তিনি এখনও মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করছেন।
আর তার অপহরণের শিকার প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কি এখনও বন্দী আছেন। ঐ ঘটনার পর তাকে প্রকাশ্যে আর কোথাও দেখা যায়নি।
— ভ্যানিটি ফেয়ারে প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক ব্র্যাডলি হোপ এবং জাস্টিন শেকের রিপোর্ট অবলম্বনে। প্রিন্স সুলতানকে অপহরণের এই ঘটনাটি সম্প্রতি পুনরায় আলোচনায় এসেছে কানাডা প্রবাসী সাবেক সৌদি গোয়েন্দা প্রধান, সাদ আল-জাবরির দায়ের করা একটি মামলার নথিপত্র থেকে। সৌদি রাজপরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা ঐ মামলায় সাদ দাবি করেন, সুলতানকে অপহরণের দায়িত্ব প্রথমে তার উপরে এসেছিল, তিনি অস্বীকৃতি জানানোয় পরে সৌদ আল-কাহতানির নেতৃত্বাধীন ‘টাইগার স্কোয়াড’-এর উপর এই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সৌদি রাজপরিবার সম্বন্ধে আরো জানতে পড়তে পারেন বই। কিনতে ক্লিক করুন নিচে লিংকে