কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর ফের সংবাদের শিরোনামে। কয়েকদিন আগে কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু শহরের এক অনুষ্ঠানে কেরালার এই পণ্ডিত নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লক্ষ্য করে মন্তব্য করে এক নয়া বিতর্কের জন্ম দেন। সম্প্রতি মোদীর উপরে একটি বই লিখেছেন থারুর। আর সেই প্রধানমন্ত্রীর উপরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন যে, তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর পছন্দ নয়। ভারতীয় জনতা পার্টির এই নেতাকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রিত না করতে না পেরে আরএসএস দিনদিন আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছে বলে থারুরের অভিমত। এবং তাদের এই হতাশাকে বর্ণনা করার জন্যে নাকি আরএসএস-এরই এক সূত্র মোদির তুলনা করেছে শিবলিঙ্গের উপরে বসে থাকা এক কাঁকড়াবিছের সঙ্গে, যাকে হাত দিয়েও সরানো যাবে না আবার চপ্পল দিয়ে মারাও সম্ভব নয়।
থারুরের এই উক্তি শুনে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সাধারণ বিজেপি সমর্থক তো বটেই, কিছু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন যে, থারুর তার মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে ভগবান শিবকে অপমান করেছেন এবং এজন্য তিনি কংগ্রেস অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি জানান। আরেক মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় থারুরের শিক্ষাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন তোলেন।
থারুর পরে একটি টুইটে জানান যে, তিনি তার মোদীকে নিয়ে লেখা বই ‘দ্য প্যারাডক্সিক্যাল প্রাইম মিনিস্টার’-এ ২০১২ সালে লেখা ‘দ্য ক্যারাভান’ পত্রিকাতে বেরোনো ওই একই উদ্ধৃতিকেই তুলে ধরেছেন। এর আগেও নানা উপলক্ষ্যে থারুর বিজেপি এবং মোদীকে বিভিন্ন প্রশ্নে বিঁধেছেন এবং গেরুয়াবাহিনীও তাকে পাল্টা আক্রমণ করেছে।
থারুরের প্রচেষ্টায় সততা থাকলেও সময়টা ভুল
থারুরের “হিন্দু পাকিস্তান” বা “হিন্দুদের মধ্যে তালিবানের উত্থান” বা “কোনও ভালো হিন্দু দেবতা অযোধ্যায় রাম মন্দির চাইবে না” জাতীয় মন্তব্য কতটা ঠিক বা বেঠিক তা বলা দুরূহ, কারণ এসব তার পণ্ডিত মনের প্রশ্ন। এই মন্তব্যগুলোর মধ্যে দিয়ে থারুর বর্তমান ভারতের সামনে এক ধরনের নৈতিক প্রশ্ন রাখার চেষ্টা করছেন। বোঝাতে চাইছেন যে, ভারতের ঐতিহ্য এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে অনুমোদিত করে না। একজন কংগ্রেসি নেতা হিসেবে থারুর যেন ভারতকে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছেন জওহরলাল নেহরুর আমলে।
কিন্তু তার সে চেষ্টা সৎ হলেও এ কথা অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই যে, সেই ভারত অনেকদিন হলো গত হয়েছে। বিগত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে ভারতের রাজনীতিতে যে গতি-প্রকৃতি দেখা গিয়েছে তাতে এই বললে অত্যুক্তি হয় না যে, এদেশের জনজীবনে আজ এক বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে আর থারুরের পক্ষে কিছুতেই তার আগের সময়ে দেশকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উল্টো তার মন্তব্যগুলো আজ বুমেরাং-এর মতো ফিরে আসতে পারে তার নিজের দলের দিকেই। আসন্ন নির্বাচনের ভরা মরশুমে তার রাজনৈতিক দর্শন যে কংগ্রেস দলকে বেশ বিপাকে ফেলতে পারে, তা একটু অতীত খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
গত নির্বাচনের আগেও এমন কাণ্ড করে দলকেই বিপাকে ফেলেন মণিশঙ্কর আইয়ার
গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালেও এমনই এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছিলেন আরেক বর্ষীয়ান এলিট কংগ্রেসি নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার। মোদী সম্পর্কে অল্পবিস্তর কটুকথা কংগ্রেসের অনেক নেতাই বলছিলেন, কিন্তু আইয়ার যখন দলীয় সমাবেশে মোদীকে ‘চা-ওলা’ বলে কটাক্ষ করেন, তখনই কংগ্রেসের কফিনে পেরেক পোঁতা হয়ে যায়। তার কটাক্ষকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলে বিজেপি, প্রশস্ত হয় মোদীর উত্থানের পথ। আর কংগ্রেস পৌঁছে যায় খাদের কিনারায়। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করে রাহুল গান্ধীর দল। এবারেও যদি থারুর এবং অন্যান্যরা অচিরেই মুখে আগল না দেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে বেশি সময় লাগবে না।
থারুরের দোষ দিই না। একজন উচ্চশিক্ষিত ও বিজ্ঞ মানুষের ন্যায় তিনিও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, নিজের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে ভারতের সমসাময়িক রাজনীতি-সমাজনীতিকে অনুধাবন করেছেন; বলতে চেয়েছেন রাজনীতির কার্য-কারণ নিয়ে। কাঁকড়াবিছের যেই রূপক উনি ব্যবহার করেছেন, তা ভুল কি ঠিক পরের কথা, কিন্তু প্রাসঙ্গিক অবশ্যই। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত সেখান থেকেই। থারুর যেই যুগে রাজনীতি করেন, সেই যুগে রাজনীতি কিন্তু এলিট সমাজের চর্চার বিষয় আর নয়। এ এখন আসমুদ্রহিমাচল জনসাধারণের নাগালের মধ্যে অতি সুলভ এক খাদ্য এবং এই খাদ্য তৈরি করতে দামি মশলাপাতি নয়, প্রয়োজন অতি সাধারণ নিত্যসামগ্রী। আর সেটা যখন বিজেপির নেতারা করতে পারছেন তখন থারুর সাহেবের সুচিন্তিত, সুবিশ্লেষণের প্রয়োজন কী?
এই রূপকের ফলে কংগ্রেসকেই দেখা হবে হিন্দু-বিরোধী হিসেবে
কাঁকড়াবিছের যে রূপক থারুর উত্থাপন করেছেন, জনসমাজের বিতর্কে তা দেখা হবে মোদীর বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ হিসেবে। আর চপ্পল দিয়ে শিবলিঙ্গের মাথায় আঘাত করার যে রূপক উচ্চারিত হয়েছে, তা হয়ে দাঁড়াবে কংগ্রেসের হিন্দুবাদের বিরুদ্ধাচরণ। এর সম্মিলিত ফল হবে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুদের হৃদয়সম্রাট নরেন্দ্র মোদীর উপরে কংগ্রেসের অন্যায় আক্রমণ। যে কংগ্রেস নির্বাচনী লড়াইতে ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া, তার কাছে এমন পরিস্থিতি মোটেই সুখকর হবে না।
বিজেপির সঙ্গে আরএসএস-এর অভ্যন্তরীণ সমীকরণে সবসময়ই টানাপোড়েন ছিল। দলের দুই প্রাক্তন কাণ্ডারি অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে নানা সময়ই সংঘের নেতৃত্বের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছে। আজও তার অন্যথা নয়। সংঘের কাছে যে ভারত নির্মাণ আবশ্যিক, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির পক্ষে তা রাতারাতি হাসিল করা কষ্টসাধ্য কাজ। তবে এই আকচাআকচিকে যদি থারুর মনে করেন যে মোদীকে কোণঠাসা করার এক বড়সড় সুযোগ, তাহলে তিনি ভুল করবেন। কারণ মোদীর যারা সমর্থক, তাদের কাছে সংঘের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। তারা পছন্দ করেন মোদীর এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক আবেদনকেই, যা থারুরের মতে, সংঘের অনেকেরই না-পসন্দ।
২০১৪-পরবর্তী মোদীকে তার আগের আঞ্চলিক বিজেপি নেতা মোদী বা কার্যকর্তা মোদীর সঙ্গে এক করে দেখাটা ভুল হবে। মোদীর উত্থানের পিছনের কাহিনী, তার রাজনৈতিক-সমাজনৈতিক কারণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতদের কাছে আকর্ষক হতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সেসবের কোনো মূল্য নেই বিশেষ। আর বিজেপির হাতের পাঁচ এই সাধারণ মানুষই, যারা অতশত নিয়ে ভাবিত নন; তাদের কাছে দেশের সামনে এখন সেরা অবলম্বন মোদীই।
শুধু পাণ্ডিত্য দিয়ে মোদীকে হারানো সম্ভব নয়, তার জন্যে দরকার তৃণমূলস্তরে জনসংগঠন
থারুরের মতো নেতা, যাদের কাছে জনভিত্তির থেকে প্রজ্ঞা এবং পাণ্ডিত্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ জনসংযোগের কাজে, তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে অন্তত মোদীকে হারানোর মতো হাতিয়ার বিশেষ কিছু নেই। নৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যে গিয়ে ভালো-খারাপের বিচার করতে গেলে তা আখেরে ক্ষুব্ধ করবে সাধারণ মানুষকেই; বলা হবে কংগ্রেসই হিন্দুদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর তাতে মোদী তো বটেই, বিজেপির চুনোপুঁটি নেতারাও পেয়ে যাবেন বেশ সুবিধা। মেরুকরণ হবে আরও। ২০১৯-এ তার ফায়দা তুলবে পদ্মবাহিনীই।
থারুর যে পন্থা নিয়েছেন মোদীর বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা করার, তা বিশেষ ফলপ্রসূ হওয়ার নয় এই মুহূর্তে। তার জন্যে কংগ্রেসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যার যখন সময় আসে তখন তাকে পরাস্ত করা সহজ নয়, আর এখন মোদীর সময় চলছে। কংগ্রেস এবং থারুরের মতো নেতার বরং উচিত তৃণমূলস্তরে জনসংযোগ বাড়ানো। মিডিয়াতে নানা চমকপূর্ণ মন্তব্য করতে থাকলে তাতে বিতর্ক, জটলাই বাড়বে, আখেরে লাভ হবে মোদীরই; আরও চাপে পড়বে বিরোধীরাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, থারুরের মতো এলিট নেতাদের পক্ষে তৃণমূলস্তরে গিয়ে বিজেপি এবং আরএসএস-এর মতো জনসংযোগ স্থাপন করা ঠিক কতটা সম্ভব?