মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্বন্ধে আমাদের ভালো জ্ঞান থাকলেও, দুই প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে যে একটি মিডটার্ম নির্বাচনও হয়, সেটা হয়তো অনেকেই জানি না। গত ৬ নভেম্বর হয়ে গেলো এবারের মিডটার্ম নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল বলার আগে জেনে নিই মিডটার্ম নির্বাচন কী?
আমরা সবাই জানি, যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট দুই ভাগে বিভক্ত। উচ্চ কক্ষকে বলা হয় সিনেট। নিম্ন কক্ষের নাম হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে সর্বমোট আসন ৪৩৫টি। এই ৪৩৫টি আসনেই প্রতি দুই বছর পর পর নির্বাচন হয়। হাউজে নির্বাচিত সদস্যদের বলা হয় রিপ্রেজেন্টেটিভ বা কংগ্রেসম্যান/কংগ্রেসউমেন। একজন রিপ্রেজেন্টেটিভের মেয়াদকাল ২ বছর।
উচ্চ কক্ষ অর্থাৎ সিনেটের আসন সংখ্যা ১০০টি। সিনেটে নির্বাচিত প্রার্থীদের বলা হয় সিনেটর। একজন সিনেটরের মেয়াদকাল ৬ বছর। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ আসনে নতুন নির্বাচন হয়। এবারের মিডটার্মে সিনেটের ৩৫টি আসনের জন্য ভোটিং হয়েছে।
মিডটার্ম ২০১৮
বলা হয়ে থাকে, মিডটার্ম নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্টের উপর জনগণের অ্যাসেসমেন্ট। সেই হিসেবে এই নির্বাচন যতটা না রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্র্যাট, তার চেয়ে বেশি ট্রাম্প বনাম বাকি আমেরিকা। তো ৬ নভেম্বর হয়ে যাওয়া নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা অনুমিতভাবেই হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করেছে। ৪৩৫ আসনের মধ্যে ৪২২টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। এর মধ্যে ২২৫টি আসনে জয়লাভ করেছে ডেমোক্র্যাটরা, ১৯৭টি আসনে রিপাবলিকানরা। দীর্ঘ আট বছর পর হাউজে নিজেদের দখল ফিরে পেলো ডেমোক্র্যাটরা। সেই ২০১০ সাল থেকে হাউজ রিপাবলিকানদের দখলে ছিল।
সিনেটে অবশ্য চিত্র বদলায়নি। রিপাবলিকানরা শক্তভাবেই তাদের ভীত ধরে রেখেছে মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষে। ৯৭টি আসনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এখন পর্যন্ত। তার মধ্যে জিওপি বা রিপাবলিকান পার্টি ৫১টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ৪৪টি আসন অধিকার করেছে। ডেমোক্র্যাটদের জন্য এবার সিনেট দখল করা প্রায় অসম্ভবই ছিল। কেননা, যে ৩৫টি আসনে নির্বাচন হয়েছে, তার ২৬টিই ছিল ডেমোক্র্যাট বিজিত। অন্যদিকে মাত্র ৯টি রিপাবলিকান আসনে নতুন নির্বাচন হয়েছে।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর ডেমোক্র্যাট পার্টির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, “ট্রাম্পের নীতি, আচরণ ও গোঁড়ামির প্রতি জনগণের রায় এই নির্বাচন।” সাধারণত মিডটার্ম নির্বাচনের পর পরই প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দেন আগ্রহী প্রার্থীরা। ২০২০ এ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়ছেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে বর্তমান আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বলেন, “মাত্রই মিডটার্ম শেষ হলো, আমেরিকানদের একটু দম ফেলতে দিন। আমি চাই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী যে আছে সে-ই লড়ুক, যাতে আমরা ট্রাম্পকে পরাস্ত করতে পারি। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
অপরদিক মিডটার্ম নির্বাচনকে বিশাল জয় বলে অভিহিত করেছেন ট্রাম্প এবং এর জন্য নিজেকে অভিনন্দনও দিয়েছেন তিনি। এক টুইটে তিনি আরও বলেন, “গত রাতে আমাদের বিশাল বিজয়ের পর চারদিক থেকে অগণিত অভিনন্দন পাচ্ছি, তার মধ্যে অনেক অভিনন্দনই এসেছে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর (বন্ধুদের) কাছ থেকে। তারা আমার সাথে বাণিজ্যচুক্তি করবার অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে। এখন আমরা আবার কাজে ফিরে যাবো এবং যা দরকার করবো!”
পরাজয়ের রাতেই অবশ্য নতুন শিরোনামের জন্ম দিয়েছেন ট্রাম্প। নির্বাচনের ফল প্রকাশ হওয়ার পরপরই ট্রাম্পের এটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস পদত্যাগ করেছে। বলা হচ্ছে, ট্রাম্পের চাপেই এই পদত্যাগ। এ ব্যাপারে বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, রিপাবলিকানদের পরাজয় থেকে সবার দৃষ্টি অন্যদিকে নিতেই ট্রাম্পের এই নাটক।
নারীদের জয়জয়কার
‘মি টু’ পরবর্তী আমেরিকার প্রথম নির্বাচন ছিল এটি। সব দলের হয়ে প্রায় ২৭৩ জন নারী প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। গত তিন নির্বাচনে এই সংখ্যা ছিল ১৬০ এর ঘরে। গত কয়েক বছরের সাথে তুলনা করলেই এবারের নারী প্রার্থীর সংখ্যা পাহারসম। বলা বাহুল্য, ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে, এবারের নারী প্রার্থী ও বিজয়ীর সংখ্যা মার্কিন ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এখনো সব অঙ্গরাজ্যের ফলাফল এসে পৌঁছায়নি। তবে সিএনএনের মতে, প্রায় ১০০ জন নারী সদস্য হাউজে আসন পেতে যাচ্ছেন। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে পূর্বের সর্বোচ্চ নারী আসনের রেকর্ড ৮৫টি।
আরও কিছু দিক দিয়েও এই নির্বাচন ঐতিহাসিক। মার্কিনিরা প্রথমবারের মতো ২ জন মুসলিম নারীকে নির্বাচিত করেছে (রাশিদা তাইয়িবা ও লিয়ান ওমর) কংগ্রেস সদস্য হিসেবে, নির্বাচিত করেছে ২ জন ন্যাটিভ আমেরিকান নারী সদস্যকে (স্যারিস ডেভিড, দেব হাল্যান্ড)। সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী (২৯ বছর) হিসেবে কংগ্রেস সদস্য হতে যাচ্ছেন নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাট সোশ্যালিস্ট আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও করতেজ। এছাড়া এলজিবিটি কমিউনিটির প্রথম সদস্য হিসেবে গভর্নর নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন ডেমোক্র্যাট জারেড পোলিস।
ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ
সাধারণত মিডটার্ম নির্বাচনগুলো হয় ম্যাড়মেড়ে, জাঁকজমকহীন। ভোটার উপস্থিতিও থাকে অনেক কম। ওবামা প্রেসিডেন্সির সবর্শেষ মিডটার্ম, ২০১৪ সালে এসে এই নির্বাচন একেবারেই রঙ হারিয়ে ফেলে। ঐ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩৬%, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বনিম্ন। মিডটার্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার একটি বড় কারণ হচ্ছে, মানুষ ওবামা প্রেসিডেন্সিতে এতটাই সন্তুষ্ট ছিল যে তখন তারা স্থানীয় পর্যায়ে তাদের গণতান্ত্রিক মতামত প্রদানটা প্রয়োজনীয় মনে করেনি। কিন্তু রিপাবলিকান সমর্থকরা তা প্রয়োজনীয় মনে করেছে এবং যে কারণে ঐ নির্বাচনে হাউজ ও সিনেট দুটিই দখল করতে সক্ষম হয়েছিল রিপাবলিকান পার্টি।
এবারের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির ভীতি আমেরিকান গণতন্ত্রের ধমনীতে বয়ে বেড়াচ্ছে। ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এই প্রথম মার্কিনিরা তাদের গণতান্ত্রিক মতামত দেয়ার সুযোগ পেলো। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ১১৩ মিলিয়ন ভোটার এই নির্বাচনে ভোট প্রদান করেছে, ২০১৪ সালের চেয়ে যা ৩০ মিলিয়ন বেশি। যেকোনো নন-প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের জন্য এটি সর্বোচ্চ অংশগ্রহণের রেকর্ড। ট্রাম্পকে দাঁতভাঙা জবাব দিতেই যেন ব্যালটকে বেছে নিয়েছে ভোটাররা। সিনেট নির্বাচনে হারলেও, ডেমোক্র্যাট ব্যালটে প্রায় ১২ মিলিয়ন বেশি ভোট জমা পড়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচন ট্রাম্পকে কতটা প্রভাবিত করতে পারবে? নিম্ন কক্ষের সমর্থন ছাড়া প্রেসিডেন্টের জন্য যেকোনো কাজ করাই কঠিন হয়ে যাবে। যদিও উচ্চ কক্ষ এখনো ট্রাম্পের শিরদাঁড়া মজবুত রাখার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু নিম্ন কক্ষ বিভিন্নভাবে ট্রাম্পের জীবন কঠিন করে দিতে পারে। যেকোনো নীতি অনুমোদন করার জন্য নিম্ন কক্ষের সমর্থন লাগবে ট্রাম্পের। নিম্ন কক্ষ চাইলেই ট্রাম্পের যেকোনো অস্বাভাবিক কাজের বিরুদ্ধে তদন্ত ডাকতে পারে। ট্রাম্প এখন পর্যন্ত তার করের হিসাব প্রকাশ করেননি। নিম্ন কক্ষ তা প্রকাশ করার জন্য আইন জারি করতে পারে। এমনকি ট্রাম্পের অভিশংসনের ডাকও তুলতে পারে নিম্ন কক্ষ।
তবে সিংহভাগ ক্ষমতা এখনো ট্রাম্পের হাতেই আছে। সুপ্রিম কোর্ট ও পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ এখনো তার দখলে। টিকে থাকতে হলে এখন ট্রাম্পের কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা, কাজ ও নীতির পরিমাণ কমাতে হবে। বারাক ওবামাও তার প্রথম মিডটার্মে নিম্ন কক্ষের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মিডটার্মে নিম্ন কক্ষ-উচ্চ কক্ষ দুটোরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি অফিস ছেড়েছেন ৫০ শতাংশের উপর অ্যাপ্রুভাল রেটিং নিয়ে। যদি ট্রাম্পের অধীনন্থরা নতুন নীতি নির্ধারণে তাকে চেপে রাখতে পারে এবং দুই কোরিয়া চুক্তির মতো নতুন কোনো বৈশ্বিক শান্তিচুক্তি যদি ট্রাম্প টেবিলে আনতে পারে, তাহলে উঁচু সম্ভাবনা আছে ট্রাম্প আজীবনই কনজারভেটিভদের সমর্থন ধরে রাখবেন এবং ২০২০ এ পুনঃনির্বাচিত হবেন।