মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত রাষ্ট্রেও হয় সরকারি ধর্মঘট। একে কেউ কেউ বলেন অচলাবস্থা, ইংরেজিতে বলে শাটডাউন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে তেমনই এক অচলাবস্থা বা সরকারি ধর্মঘট চলছে। এ অচলাবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ অচলাবস্থা হতে যাচ্ছে। আর এর সৃষ্টি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরির চেষ্টা করে আসছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেই বলেছিলেন, আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করবেন। এজন্যই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরির বিল তুলেছিলেন অনুমোদনের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মানুযায়ী, উত্থাপিত কোনো বিল অনুমোদনের জন্য সিনেটের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন। এই অনুমোদনে সবার সম্মতি না পেয়ে অবশেষে শাটডাউনের পথ বেছে নেন ট্রাম্প। নিজের উত্থাপিত বিল অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে অচলাবস্থা জারি করেছেন। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে চলছে এই অচলাবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৯০০ মাইল। দীর্ঘ এই সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ বেশ ব্যয়বহুল। অবশ্য ট্রাম্পের দাবি, তিনি অল্প খরচেই এ বিশাল দেয়াল নির্মাণ করবেন। তিনি দাবি করেন, এ দেয়াল তৈরিতে ব্যয় হবে সর্বোচ্চ ১,২০০ কোটি ডলার। কিন্তু বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের মতে, দেয়াল নির্মাণের এ ব্যয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া আনুমানিক হিসাবকে কয়েকগুণ ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে মেক্সিকোর সাথে ৬৫০ মাইল জুড়ে দুর্বল বেড়া রয়েছে। ৬৫০ মাইল জুড়ে থাকা এই দুর্বল বেড়া তৈরি করতেই খরচ করতে হয়েছে ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি। আর তাই এটা সহজেই অনুমান করা যায়, ১,৯০০ মাইল জুড়ে বিশাল দেয়াল তৈরিতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন।
মেক্সিকো সীমান্তে এ দেয়াল তৈরি নিয়েই যত সমস্যার সূত্রপাত। দেয়ালের জন্য বাজেটের অনুমোদন পেতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সদস্যদের নিয়ে ট্রাম্প মিটিংয়ে বসেন। তার প্রস্তাবে উভয়পক্ষ একমত না হওয়াতেই বেঁকে বসেন তিনি। ঘোষণা দেন অচলাবস্থার। আর এই অচলাবস্থায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ জনগণ। এক জরিপে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ ভোটারেরই চলমান এই অচলাবস্থার প্রতি সমর্থন নেই। একই চিত্র সিনেটেও। ট্রাম্পের নিজ দলের অনেক সিনেটরও ইতিমধ্যে চলমান এই অচলাবস্থায় বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। সীমান্তে দেয়াল ইস্যু অমীমাংসিত রেখেই সরকার চালু রাখার দাবি করছে তারা। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়বেন না বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। বরাদ্দ না পাওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো অর্থ বাজেটেও স্বাক্ষর করবেন না তিনি।
এই অবস্থায় ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশের সাধারণ নাগরিকরা। ২০১৯ যেন অন্যান্য বছরের চেয়ে একটু আলাদা হয়েই এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে। সরকারি চাকরিজীবী সহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চলমান এই শাটডাউনের কারণে ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। অনেকে বছরের প্রথম বেতনটিও পাননি। বিমানবন্দরকর্মী, কারারক্ষী, এমনকি এফবিআই এজেন্টসহ নানা পেশাজীবী মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন বছরের প্রথম বেতন থেকে। হিসাবে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৮ লাখ কর্মী বছরের প্রথম বেতন পাননি। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা দাবি জানাচ্ছেন, দেয়াল নয়, আমাদের বেতন চাই। বেতন না পাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদেরও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যস্ততম মায়ামি বিমানবন্দরের একটি পুরো টার্মিনাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে চলমান শাটডাউনের কারণে। আর এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিমানবন্দরের কর্মী, এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রক থেকে শুরু করে সবাই। নিরাপত্তা কর্মীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এর ফলে জননিরাপত্তাও এখন হুমকির মুখে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। যারা খাদ্য ভর্তুকি পেতেন তারা ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
মার্কিন অর্থনীতিবিদদের মতে, চলমান শাটডাউনের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে অচলাবস্থা চলতে থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর তা অনেক বড় প্রভাব ফেলবে। এই অচলাবস্থা মানবিক সহায়তা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যের উপরও প্রভাব ফেলবে। এই শাটডাউনের প্রভাব পড়বে আমদানি রপ্তানিতেও। বিচার ব্যবস্থায়ও এর অনেক বড় প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। আমেরিকার ফেডারেল আদালতগুলোর হাতে চালু থাকার মতো আর মাত্র নয়দিনের অর্থ রয়েছে! এরপর কী হবে কেউ জানে না। এরপরও যদি অচলাবস্থা চলতে থাকে তবে আদালতগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন অচলাবস্থা এই প্রথম নয়। এর আগেও অনেক প্রেসিডেন্ট বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্র অচল করে দিয়েছিলেন। আমেরিকায় সর্বপ্রথম এ ধরনের অচলাবস্থার তৈরি হয় ১৯৮০ সালে। ১৯৮০ সালের ১ মে ফেডারেল ট্রেড কমিশন একদিনের জন্য অচলাবস্থা জারি করেছিল। বাজেট বিতর্ক নিয়ে এটিই আমেরিকার প্রথম অচলাবস্থা। কংগ্রেস এজেন্সির জন্য একটি অনুমোদন বিল পাস না করায় এই অচলাবস্থার সৃষতি হয়। একদিনের এই অচলাবস্থায় ১,৬০০ কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হন। একদিনের এই শাটডাউন কার্যকর করতে খরচ করতে হয় ৭ লাখ ডলার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের শাসনামলেই চারবার এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
চলমান অচলাবস্থার প্রায় ১ মাসের মাথায় রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, শাট ডাউন চলবে। তাই চলমান এ ‘শাট ডাউন’ কত দিন চলবে, কেউ বলতে পারছেন না। অবশ্য এ পর্যায়ে এসে শেষপর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প আংশিক শাট-ডাউন থেকে বেরিয়ে আসতে আপোষ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির সাথে আপোষের কথা বলেছেন।
হোয়াইট হাউজ থেকে তিনি বলেছেন, প্রায় ১০ লাখ অভিবাসীকে বহিষ্কারের হুমকি তিনি প্রত্যাহার করে নেবেন। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যে তরুণরা রয়েছে, তারাও এর আওতায় পড়বে। তিনি আরও বলেন, “মানবিক সাহায্যের জন্য আটশ’ মিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। একইসাথে সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য একই পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে। এই অর্থ সীমান্তে অতিরিক্ত ২৭৫০ জন নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগে সহায়তা করবে।”
কিন্তু সমঝোতার প্রস্তাব দিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য যে ৫৭০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন, সমঝোতার প্রস্তাবে তার সেই দাবি বহাল রয়েছে এখনো।
এখন দেখবার পালা, এ অচলাবস্থার শেষ কোথায়! অচলাবস্থা শেষ হলেও অচলাবস্থাকালীন যে ক্ষতির সম্মুখীন হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সে ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেবে। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী আইন ও মেক্সিকো সীমান্তে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটি এখনো অজানা।