সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ একতাবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত, নিরাপত্তার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে আর নৈরাজ্য থেকে বাঁচতে মানুষ সম্মিলিতভাবে তৈরি করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মানুষ শাসনব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করেছে, বিভিন্ন সময়ে বিবর্তন ঘটিয়েছে শাসনব্যবস্থার। কোনো কোনো সময়ে সেই বিবর্তন ছিল স্থূল, কখনো শাসনব্যবস্থাকেন্দ্রিক সেই বিবর্তন ছিল সূক্ষ্ম। কখনো শাসনব্যবস্থাতে বিবর্তন ঘটেছে দ্রুত, কখনো বিবর্তনের প্রক্রিয়া ছিল মন্থর। কখনো শাসকের সম্মতিতে ঘটেছে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন, কখনো ঘটেছে বিপ্লবের মতো রাজনৈতিক ঘটনা।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তারকারী শাসনব্যবস্থা ছিল তিনটি- গণতন্ত্র, কমিউনিজম আর ফ্যাসিজম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার আর ইতালির মুসোলিনির পতনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা হিসেবে পতন ঘটে ফ্যাসিজমের, শাসনব্যবস্থা হিসেবে কমিউনিজম টিকে ছিল আরো অর্ধশতাব্দী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে শাসনব্যবস্থা হিসেবে পতন ঘটে কমিনিজমের, মানবসভ্যতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র।
বিভিন্ন প্রকারের গণতন্ত্র
বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে প্রাধান্য বিস্তারকারী শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও, সভ্যতার শুরু থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কাঠামোতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চর্চার উদাহরণ রয়েছে। গণতন্ত্র মানে বহুজনের শাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের দুটি ধরনের কথা আলোচনা করা যায়।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সাধারণত একটি রাজনৈতিক কাঠামোর অধীনে থাকা সকল রাজনৈতিক ব্যক্তি অ্যাসেম্বলির নিয়মিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোতে, যেখানে প্রতি দশ থেকে পনেরো দিন অন্তর অন্তর বসতো অ্যাসেম্বলির অধিবেশন। অ্যাসেম্বলির প্রত্যেক সদস্যের ভোটদানের ক্ষমতা ছিল। অ্যাসেম্বলির মাধ্যমেই নগররাষ্ট্রগুলো রাজস্ব আদায়ের হার নির্ধারণ করত, দৈনন্দিন কাজের বাইরে আমলাতান্ত্রিক কাজগুলোর ব্যাপারে মতামত দিত অ্যাসেম্বলির সদস্যরা।
তবে প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলো নারীদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারতেন না দাসেরাও। তাত্ত্বিকভাবে, এই চর্চা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অংশ নয়।
পরোক্ষ গণতন্ত্র
পরোক্ষ গণতন্ত্রে একটি রাজনৈতিক কাঠামোর অধীনে থাকা নাগরিকেরা ভোটের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, নির্বাচিত প্রতিনিধি অ্যাসেম্বলিতে সেই এলাকার নাগরিকদের স্বার্থ আর নাগরিক সুবিধাগুলো নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করেন। এই প্রক্রিয়ায় দেশের অধিকাংশ নাগরিকের নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও শাসনতান্ত্রিক কাজগুলোতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগই থাকে না। সাধারণত, একজন জনপ্রতিনিধি চার বা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। এই চার বা পাঁচ বছরের মধ্যে তাকে নাগরিকদের মাধ্যমে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রায় অসম্ভব। বরং, তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য পাঁচ বছর বা চার বছর পরের ভোটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্রগুলোতে সাধারণত পরোক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা হয়।
আধুনিক যুগে কেন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা প্রায় অসম্ভব?
প্রাচীন গ্রিস, মেসোপটেমিয়া সভ্যতা আর আফ্রিকার গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা ছিল। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উপস্থিতি রয়েছে, রয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। এই সবগুলো দেশেই সাধারণত পরোক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা হয়। প্রায় ১৬০টি গণতান্ত্রিক দেশের শাসনব্যবস্থার যে পার্থক্য রয়েছে, তা মূলত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেন্দ্রিক। যেসব দেশে আগে থেকেই প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার চর্চা ছিল, সেসব দেশে নাগরিকরা সাধারণত স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পান, সুযোগ পান রাজনৈতিক কাঠামোগুলোকে প্রভাবিত করার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার।
তবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামলা করে, রাষ্ট্রও অনেক সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করে দেয়। এসব দেশে রাজনৈতিক কাঠামো প্রভাবিত করার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার হতে পারে যেকোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক গোষ্ঠী।
রাজনৈতিকভাবে উদার সংস্কৃতির দেশ বা রাজনৈতিকভাবে অনুদার সংস্কৃতির দেশ, বর্তমান সময়ে কোনো দেশের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ নেই।
প্রথমত, যে প্রাচীন নগররাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ আমরা পাই, সেসব রাষ্ট্রে সাধারণত দাস আর নারী বাদে নাগরিক ছিল কয়েক হাজারের মতো, যারা অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেতেন, উপস্থিত উপায়ে গণতন্ত্রের চর্চা করতেন। বর্তমানে জাতিরাষ্ট্রগুলোতে নাগরিকের সংখ্যা কয়েক লাখ থেকে কয়েক কোটি পর্যন্ত হয়। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্রের দেশ ভারতে নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১৩৬ কোটি। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ে কাজ করার মতো অবকাঠামো তৈরি কষ্টসাধ্য, এই বিপুল মানুষের একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে মতামতের সংকলন করাও দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করা নাগরিকদের এক বিশাল অংশ রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ব, দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করে বিভিন্ন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত দেওয়া তাদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। আবার, অনেকেরই চিন্তা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা নেই। একজন শাসকের সাথে সাধারণ নাগরিকের পার্থক্য মূলত এখানেই। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সাধারণত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন, রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব হন, যেকোনো রাজনৈতিক বিতর্কে সুস্পষ্ট চিন্তা ও মতামত দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। ফলে, জনপ্রতিনিধির মাধ্যমেই শাসনব্যবস্থা দ্রুত কাজ করে, দক্ষ উপায়ে কাজ সম্পাদন করে।
তৃতীয়ত, শিল্পায়নের যুগে বর্তমান সময়ে অধিকাংশ নাগরিকই নিয়মিতভাবে একস্থান থেকে অন্যস্থানে বদলি হতে থাকেন, পরিবর্তিত হয় স্থায়ী ঠিকানাও। আবার, মানুষের ব্যস্ততাও বহুগুণে বেড়েছে আগের চেয়ে, ফলে প্রতি সপ্তাহে একদিন অ্যাসেম্বলিতে অংশ নেওয়ার আগ্রহ অধিকাংশ নাগরিকেরই থাকবে না। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর জন্য, আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের যুগে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চা করা কার্যত অসম্ভব।
সুইজারল্যান্ডের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
কাঠামোগত এসব সীমবদ্ধতা সত্ত্বেও, বর্তমান বিশ্বের একটি দেশে স্থানীয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। দেশটি হচ্ছে সুইজারল্যান্ড। পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলেও, সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল কাঠামোকে জনগণের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি উন্মুক্ত করা হয়েছে, জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তবে, বাজেট প্রণয়ন, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ দেওয়া, অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ নাগরিকেরা সাধারণত মিউনিসিপ্যালিটিস এবং ক্যান্টনসগুলোতে পেয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় ফেডারেল কাঠামোতে নীতি নির্ধারণ করে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই। এই প্রদ্ধতিতে আধা-প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রও বলা যায়।
তবে, সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল কাঠামোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, নাগরিকেরা সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব রাখতে পারেন। সাধারণত, পপুলার ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই ধরনের প্রস্তাবনা রাখেন নাগরিকেরা। আবার, আইনসভাতে পাস হওয়া আইনের ব্যাপারে ঐচ্ছিক গণভোট আয়োজনের দাবিও জানাতে পারেন নাগরিকেরা। ১৯৯৫ সালে জানুয়ারি থেকে ২০০৫ সালের জুন পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের নাগরিকেরা ৩১ বার ভোট দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ইস্যুতে। ২০১০-১৮ পর্যন্ত একইভাবে নাগরিকেরা ভোট দিয়েছেন ৪২ বার, যা বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন দশকের প্রায় দ্বিগুণ।
সুইজারল্যান্ডের মডেল দেখাচ্ছে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মূল্যবোধ থাকলে, জবাবদিহিতা নিশ্চিতের প্রেরণা থাকলে, কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থাকলে, স্বল্প জনসংখ্যার দেশগুলোতে নাগরিকদের ক্ষমতায়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব, অন্তত সীমিত পরিসরে হলেও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা প্রয়োজন। গত শতাব্দীতে স্বাধীনতা পাওয়া অনেক দেশেই আইনসভার কার্যক্রমের উপর নাগরিকদের জনমতের খুব একটা মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়া হয় না, সিভিল সোসাইটিগুলোকেও জবাবদিহিতা আর বিকেন্দ্রীকরণের দাবি উত্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয় না।
প্রযুক্তি কি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারে?
সুইজারল্যান্ডের মডেল কি ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে প্রয়োগ করা সম্ভব, যেখানে নাগরিকের সংখ্যা ১৩৬ কোটি আর ভোটার সংখ্যা প্রায় একশো কোটির মতো? কিংবা সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতেও কি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব?
প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের সাথে সেই সম্ভাবনা তুলে ধরছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় চ্যানেলগুলো আজকাল বিভিন্ন জনপ্রিয় আর বিতর্কিত বিষয়ে ভোটের আয়োজন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনে আয়োজিত এসব ভোটে অংশগ্রহণ করে কয়েক লাখ থেকে কয়েক মিলিয়ন মানুষ। মন্তব্যের ঘরে হয় তুমুল বিতর্ক, পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেয় মানুষ। জাতীয় পর্যায়ে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের জন্য প্রযুক্তির এই বিকাশ একটা সম্ভাবনা হিসেবে কাজ করতে পারে।
সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে নাগরিকদের মতামত নেওয়ার জন্য এসব অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করতে পারে, তৈরি করতে পারে মতামত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপও। ফলে একজন নাগরিক তার মতামত ঘরে বসেই জানাতে পারবেন, জানাতে পারবেন সরকারের কোন কাজ তিনি অনুমোদন করছেন, কোনটি অনুমোদন করছেন না। জানাতে পারবেন অর্থনৈতিক বরাদ্দ সম্পর্কে তার মতামত, জানাতে পারবেন নিজের ভাবনা।
এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়নি, কর্তৃত্ববাদী অনেক দেশই ইন্টারনেটের বিকাশকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে এর অবকাঠামোগত বিকাশ আটকে রেখেছে। ফলে, পৃথিবীব্যাপী প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অনলাইন মডেল চালু করা এই মুহুর্তে কার্যত অসম্ভব। তবে, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে এই প্রক্রিয়ার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ সম্ভব। পাশাপাশি, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত তো থাকছেই।