যে পাঠকেরা এই লেখাটি পড়ছেন, উইঘুর নামটির সাথে নিশ্চিতভাবেই আপনারা পরিচিত। গণমাধ্যমে অজস্রবার এ জনগোষ্ঠীর লোকেরা শিরোনাম হয়েছেন চীনা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে। তাদের প্রতি রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণকে অনেকে মোটাদাগে চীনা সরকারের ইসলাম বা ধর্মবিরোধী অবস্থান হিসেবে দেখে থাকেন। অজ্ঞতাবশত অনেকে এটাও ভেবে থাকেন যে, উইঘুররাই বুঝি চীনের একমাত্র বা বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী।
হ্যাঁ, উইঘুর মুসলিমেরা সংখ্যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট মুসলিম জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। কিন্তু তারা নয়, চীনের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনগোষ্ঠী ‘হুই’রা। চীনের জনসংখ্যার ৯২ ভাগই হান নৃগোষ্ঠীভুক্ত। অবশিষ্ট ৮ ভাগের অন্তর্গত হলো ৫৫টি নৃগোষ্ঠী। এতগুলো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে আবার সংখ্যাগুরু হলো ‘হুই’। জনসংখ্যায় এরা প্রায় দেড় কোটি, যেখানে উইঘুরদের সংখ্যা ১ কোটির কিছু বেশি।
হুইদেরও কি মুসলিম হবার জন্য উইঘুরদের মতোই নিষ্পেষিত-নিগৃহীত হতে হয়? বিস্ময়করভাবে উত্তরটি হচ্ছে – ‘না’! বরং ধর্মীয়ভাবে অধিক স্বাধীনতা ভোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে হুইরা। রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক উইঘুরদের মতো শীতল নয়।
উইঘুরদের ওপর চলমান চীন সরকারের দমনপীড়ন কিংবা উইঘুর বিতর্কে চাপা পড়ে যাওয়া হুইদের পরিচিতিই কেবল নয়, বরং আজকের লেখায় থাকছে উভয় জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রীয় আচরণের তারতম্যের একটি তুলনামূলক চিত্র ও তার কার্যকারণ।
উইঘুর আর হুই : আলাদা মূলত কীসে?
শুধু চীনেই নয়, সোভিয়েত ভেঙে সৃষ্ট মুসলিম দেশসমূহ, পাকিস্তান ও পাশ্চাত্যের কিছু দেশেও রয়েছে উইঘুর মুসলিমদের বাস। ওদিকে চীনা উইঘুরদের প্রায় ৯০ ভাগেরই বাস দেশটির উত্তর-পশ্চিমের শিনজিয়াং প্রদেশে। প্রদেশটির পুরো নামই ‘শিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’।
চোখের দেখাতেই উইঘুর আর মূলধারার হান চীনাদের আলাদা করা যায়। তফাত যেন অনেকটা রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে ককেশানদের মতোই স্পষ্ট। শুধু নৃতাত্ত্বিকভাবেই নয়, তাদের ভাষাও আলাদা। উইঘুররা মূলত তুর্কিক ভাষায় কথা বলে, যা লেখা হয় আরবি হরফে।
অন্যদিকে হুইদের বাস সমগ্র চীনজুড়ে। তারপরও উইঘুরদের মতো হুইদেরও ‘নিজস্ব’ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আছে, যার নাম ‘নিংশিয়া’। এছাড়া কানসু প্রদেশের লিনজিয়া শহরটিকে বলা হয় ‘কুরআন বেল্ট’, যেটি মূলত হুই অধ্যুষিত এলাকা।
হুই মুসলিমদের পূর্বপুরুষেরা আজ থেকে ১,২০০ বছর আগে আরব-পারস্য থেকে এসেছিলেন চীনে। চীনা নারীদের বিয়ে করে এখানেই থিতু হয়েছিলেন তারা। সময়ের ফেরে তাদের রক্ত এতটাই চীনের মূলধারায় মিশেছে যে, সাদা টুপি বা হিজাব না থাকলে হানদের থেকে হুইদের তফাত করা বেশ দুষ্কর। মান্দারিনই তাদের অধিকাংশের মাতৃভাষা। শুকর আর মদ বাদে মূলধারার চীনাদের সাথে খাদ্যাভ্যাসেও হুইদের বড় কোনো তফাত নেই।
সমাজের মূলধারা বনাম হুই ও উইঘুর
মূলধারার হান চীনাদের সাথে হুই মুসলিমদের তফাত কমই– তা ইতোপূর্বের আলোচনাতেই খানিকটা উঠে এসেছে। তারা সমাজের মূলস্রোতে এতটাই আত্তীকৃত যে, তাদের এলাকাগুলোতে গেলে মসজিদকে প্যাগোডা ভেবে আপনি ভুলও করতে পারেন! ঐতিহ্যবাহী চীনা আদলের সাথে আরব্য স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব মেলবন্ধন তাদের মসজিদগুলো।
হুইরা মূলত ইসলামের সুফিবাদী আদর্শের অনুসারী। কনফুসিয়াসের দর্শনের সাথে তাদের সুফিবাদী আদর্শের একরকম সমন্বয় তারা ঘটিয়েছে।
ব্যবসা করতে গিয়ে হুইরা শেকড় বিস্তার করেছে গোটা দেশেই। চীনের সব উন্নত শহরে গেলেই হুইদের চোখে পড়বে। এমনকি নিষিদ্ধ নগরী লাসা (তিব্বতের রাজধানী)-এর অধিকাংশ দোকানপাটই হুইদের দখলে। চীনের দাপ্তরিক ভাষা মান্দারিন, হুইদের মাতৃভাষাও তা-ই। ফলে সরকারি চাকরিতেও তাদের অংশগ্রহণ বেশি, অন্তত উইঘুরদের চেয়ে তো বটেই।
ওদিকে উইঘুরদের অনেকে মান্দারিন শিখতেই রাজি নয়। শক্তিশালী নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে তাদের। সাংস্কৃতিক জাত্যাভিমান তাই তাদের মধ্যে প্রবল। এ জাত্যাভিমান আধিপত্যবাদী হানদের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতিকে মানতে চায় না। মূলধারায় মিশতে অনীহা মূলত তাদেরই। ওদিকে সাংস্কৃতিকভাবে উইঘুরদের ‘নিকৃষ্টতর’ জ্ঞান করবার প্রবণতাও আছে তথাকথিত মূলধারার চীনাদের।
১৯৪৯ সালে শিনজিয়াংকে নিজেদের অধিভুক্ত করে নেয় চীন। কিন্তু সেখানকার সংখ্যাগুরু উইঘুররা যতটা না চীনের সাথে আত্মিক-সাংস্কৃতিক যোগ অনুভব করতেন, তার চেয়ে বেশি করতেন বা করেন ‘স্তান’দেশগুলোর সাথে। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তানের আদলে ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ নামক আলাদা সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন এখনো দেখেন অনেক উইঘুর।
উইঘুরদের দুর্গতি ও ভৌগোলিকতার দায়
চীনের পূর্বাংশকে ধরা হয় চীন তথা পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর কৃষিক্ষেত্রের একটি। সেই কৃষিক্ষেত্র যে নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তার সবগুলোরই উৎপত্তি তিব্বত প্রদেশে। শুধু কৃষির ক্ষতিই নয়, এই স্থানটি খোয়ালে সেটি এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বাড়াতে পারে।
এসব ভয় থেকেই অতি সতর্কতার সাথে তিব্বতিদের স্বাজাত্যবোধকে কঠোরভাবে দমন করে চীন সরকার। তিব্বতের মতোই আরেকটি অতি-নিয়ন্ত্রিত প্রদেশ হচ্ছে শিনজিয়াং।
একে তো শিনজিয়াং আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় প্রদেশ বলে চীন একে খোয়াতে চায় না। সেই সাথে ইউরোপ, আফ্রিকার সাথে সহজ যাতায়াতের জন্য শিনজিয়াংয়ের রুটকেই ব্যবহার করে চীন। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক কারণেই যেহেতু উইঘুররা মূলধারায় মিশতে অনাগ্রহী, তাই তাদের স্বাজাত্যবোধের খুঁটিকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নয় চীন সরকার।
তিব্বতের মতো কঠোর নজরদারি চালানো হয় এ প্রদেশেও। ফেইস ও ভয়েস রিকগনিশন, আইরিস স্ক্যানিং, ডিএনএ নমুনা ও থ্রিডি শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে চালানো হয় এসব নজরদারি। স্বজাতির মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তির কাজটি করে থাকে উইঘুরদের কেউ কেউই। কেউ ধূমপান বা মদ্যপান নতুন করে ছাড়লো কি না বা চীনা সংবাদ দেখে কি না- এসব পর্যন্ত নজরদারি করা হয়!
২০১৬ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি শিনজিয়াংয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় চেন কুয়াঙ্গুয়োকে। তিনি ইতোপূর্বে তিব্বতের লামা বৌদ্ধদের ওপরেও একই ধরনের নজরদারি চালিয়েছিলেন। ফলে চীনের এই বাড়াবাড়ির কারণ যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত।
শুধু কি নজরদারি? ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ এর নাম দিয়ে উইঘুরদের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রাখা হচ্ছে পাইকারি হারে। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী প্রায় ৫,০০০ উইঘুর চীনার শতকরা আশিভাগেরই কোনো না কোনো আত্মীয় এসব ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি আছেন। নির্যাতনের মুখে তাদের মতো অসংখ্য উইঘুর মুসলিম দেশও ছাড়ছেন। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলে গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য উইঘুর লেখক, কবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক প্রমুখ।
হুইদের প্রতি রাষ্ট্রীয় আচরণ ও একটি তুলনামূলক চিত্র
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে উইঘুরদের মতো হুইরা কখনো চীনা সরকারের উদ্বেগের কারণ হয়নি। হুই মুসলিমদের ঐ অর্থে রাজনীতিতেও বিশেষ আগ্রহ নেই। ঠিকঠাকভাবে ধর্ম পালন করতে পারলেই চলে তাদের! ফলে উইঘুরদের মতো রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়তে হয়নি হুই মুসলিমদের।
অন্যদিকে মূলধারায় হান আধিপত্যবাদের ব্যাপারেও হুইদের আপত্তি সামান্যই। চীনের শেষ ‘কিং’ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একবার নাংশিয়া ঘাঁটি থেকে বিদ্রোহ করেছিলো তারা। ঐ একটি রেকর্ড বাদ দিলে সেনাবাহিনী প্রশ্নে হুইরা অনুগতই ছিলো বরাবর।
ক্ষমতাসীনদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার তারাও হয়েছে, কিন্তু আলাদা রাষ্ট্রের দাবি কখনো তোলেনি। উইঘুরদের কাছে হুইরা হলো রাষ্ট্রের তাঁবেদার। অন্যদিকে রাষ্ট্রের চোখে হুইদের ভাবা হয় ‘ভালো মুসলিম’! এই ‘ভালো মুসলিম’রা স্বাভাবিকভাবেই ধর্মপালনের ক্ষেত্রে তাই বাড়তি স্বাধীনতা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পান।
শিনজিয়াংয়ে উইঘুররা রোজা রাখতে পারেন না। কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উইঘুররা খাচ্ছেন কি না, সেটা প্রশাসনিকভাবে নিশ্চিত করা হয়! ওদিকে হুই মুসলিমরা ঠিকই রোজা রাখতে পারেন। উইঘুররা বিদেশ গমনের জন্য সহজে পাসপোর্টও পান না। সেখানে সৌদি আরবে হজ করতে যাওয়া হুই মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে বছর বছর!
হুইদের স্বায়ত্তশাসিত নিংশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঈর্ষণীয়। সেখানকার হালাল ফুড ইন্ডাস্ট্রির বাৎসরিক আয় প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার। ওদিকে ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী সেখানকার জিডিপিও ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে ধর্মের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও ভরপুর ভোগ করছে হুইরা, তা বলাই বাহুল্য!
ওদিকে মূলধারার প্রতি উইঘুরদের বিতৃষ্ণার ফলে সমাজের মূলধারাটিরও উইঘুরদের প্রতি জন্মেছে বিদ্বেষ। এ বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়েছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো। একতরফাভাবে উইঘুরদের শান্তি-বিঘ্নকারী, সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। শিনজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা গণমাধ্যম গবেষক লিয়াং ঝেংয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে চীনা গণমাধ্যমের উইঘুর বৈরিতার কথা।
৯/১১ পরবর্তী ‘ওয়ার অন টেরর’-এই আগুনে ঢেলেছে ঘি। দেশে যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে আর অপরাধী যদি ‘হান’ না হয়, তবে লোকে ধরেই নেয় এটা উইঘুরদেরই কাজ (অথচ আরো ৫৪টি নৃগোষ্ঠী আছে চীনে)! এই স্টেরিওটাইপ থেকে আবার হুই মুসলিমেরা মুক্ত। গণমাধ্যমও তাদের ব্যাপারে অতটা বৈরী নয়।
নিংশিয়াতে ২০০৫ সালে ‘ভার্চুয়াল রেলিজিয়াস স্টেট’ প্রতিষ্ঠা করেন হুই ধর্মগুরু হং ইয়ান। পনের লক্ষাধিক অনুসারী আর অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হং মেন’ নামক এই স্টেট। পাকিস্তানে পড়াশোনাকালে ওসামা বিন লাদেনসহ কট্টর মৌলবাদী নেতার সঙ্গে আলাপ ছিলো ধর্মগুরু হং ইয়ানের। তবুও তিনি পার পেয়ে গেছেন তার ‘হং মেন’ সমেত। কেন?
কারণ হং ইয়ান চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত আস্থাভাজন একজন ব্যক্তি। হাওয়াই ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক দ্রু গ্লাদনির মতে, হুইদের সাথে সামাজিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়ানোর কৌশল হিসেবেই ধর্মহীন আদর্শের রাষ্ট্রে এমন একটি ধর্মীয় সমাজ প্রতিষ্ঠাকে প্রশ্রয় দিয়েছে চীন! সরকারের সাথে সুসম্পর্কের জন্যই হুই ধর্মগুরু হং ইয়ান বা হুই মুসলিমদের ঐ অর্থে হুমকি মনে করে না তারা।
যেহেতু চীনা সরকার আদর্শিকভাবে ধর্মহীনতাকেই ধারণ করে, সেহেতু হুইদের ধর্মপালনও যে একেবারে নির্বিঘ্ন, তা নয়। অন্যদিকে কট্টর সালাফি মতবাদের প্রসারও বাড়ছে এককালের সুফিবাদী হুইদের মধ্যে। সালাফি মতবাদে নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদকে বাতিল করে ধর্মীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনে জোর দেওয়া হয়। সালাফি মতবাদকে চীন তার সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের স্থিতির পক্ষে হুমকি হিসেবেই দেখে। সাম্প্রতিক সময়ে তাই খানিকটা লাগাম টানা হয়েছে হুইদের স্বাধীনতাতেও।
গত বছর কানসু প্রদেশের লিনজিয়াতে ১৬ বছরের কম বয়সী মুসলিমদের জন্য যেকোনো ধরনের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বা মসজিদে ধর্মের পাঠ নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। অবৈধভাবে সম্প্রসারণ ও বিদেশি সাহায্য নেবার দায়ে ঐ এলাকারই একটি মসজিদ আগস্টে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলো সরকার। যদিও গণআন্দোলনের মুখে সেটিকে উচ্ছেদ করা যায়নি।
হুই ও উইঘুর আন্তঃসম্পর্ক
সরকারি চাকরিতে মান্দারিন জানা ও মূলধারার প্রভাবপুষ্ট হুই মুসলিমেরা সুযোগ বেশি পান, তা আগেই বলা হয়েছে। তার ওপর সরকারের সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ‘ইগো ইস্যু’ও রয়েছে উইঘুর ও হুইয়ের মাঝে। ফলে ধর্মে এক হলেও সম্পর্কটা এতটাও সহজ নয় হুই ও উইঘুরদের মধ্যে। ২০০৯ সাল থেকে এখন অবধি হয়ে গেছে বেশ কিছু দাঙ্গাও। তবে দাঙ্গার কারণটি একটু আলাদা। ‘সেটেলার’!
শিনজিয়াং ও তিব্বতকে মূলস্রোতে আনতে না পেরে মূলস্রোতকে বরং এই দুই স্থানে ঢোকাতে চায় সরকার। হান ও হুই গোষ্ঠীর লোকজনকে বেশি বেশি করে এই দুই স্থানে বসতি স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। উইঘুরদের এলাকাগুলোয় আগে তাদের যতটা প্রভাব ছিলো, সেটি কমে এসেছে এই অন্তঃঅভিবাসনে।
শিনজিয়াংয়ের সেনা বা রাষ্ট্রাধীন খামার ও খনিতে কাজ করতে শুরুতে বিপুল পরিমাণ হানকে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেখানে হুই মুসলিমদেরও কর্মসংস্থান-পুনর্বাসন করা হয়। বর্তমানে সাড়ে চল্লিশ ভাগ হানের পাশাপাশি সাড়ে চার ভাগ হুই মুসলিমও বাস করছে প্রদেশটিতে। ১৯৪৯ এ শিনজিয়াং যখন চীনের দখলে এলো, তখন সেখানে উইঘুররা ছিলো শতকরা ৭৬ ভাগ, আর বর্তমানে তা মাত্র ৪২ ভাগ!
এসব কারণে উইঘুরদের তরফে বাড়ছে জাতিগত অসন্তোষ। ২০০৯ সালে শিনজিয়াংয়ের রাজধানী উরামকি শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে শোর উঠেছিলো, “হান মারো, হুই মারো”! বোঝাই যাচ্ছে, হুইদেরকে হান আধিপত্যবাদের সমর্থক ও সমার্থক ব্যতীত অন্য কিছুই ভাবে না উইঘুররা!
উইঘুরদের প্রতি আচরণকে দিয়েই অনেকে চীন রাষ্ট্রের ‘ইসলামফোবিয়া’ মেপে ফেলতে চান। নির্দিষ্ট নৃগোষ্ঠীর প্রতি নয়, বরং মোটাদাগে পবিত্র ধর্মের প্রতি চীনা আগ্রাসন হিসেবেই এসব বৈষম্যকে দেখতে চান তারা। তবে পরিস্থিতি এতটাও মোটাদাগে বিচারযোগ্য নয়। নিঃসন্দেহে শিনজিয়াং প্রদেশের ধর্মীয় চরিত্র মুছে ফেলতে চাইছে চীন।
কিন্তু যেহেতু তিব্বতের লামা-বৌদ্ধ স্বাধীনতাকামীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ জারি আছে এবং হুই মুসলিমরা উইঘুরদের মতো এতটা বঞ্চিত নয়, সেহেতু একটি ব্যাপার স্পষ্ট– উইঘুরদের প্রতি বেইজিংয়ের এই বৈষম্যমূলক আচরণ আসলে ভূখণ্ড হারাবার ভয় থেকেই, ইসলামবিদ্বেষ থেকে নয়! অন্যদিকে সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার আকুলতায়, একীভূত জাতি গঠনের স্বার্থে ও উইঘুরদের প্রতি এই আচরণের বৈধতা দেবার উদ্দেশ্যে চীন যে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিবিদ্বেষ ও ইসলামভীতি উসকে দিচ্ছে– সেটিও একইভাবে সত্য।