ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা হ্রাসের লক্ষ্যে ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় উভয় পক্ষের মধ্যে একটি বৈঠক এর আয়োজন করা হয়। সেই আলোচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা- ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চালর্স মিশেল অংশগ্রহণ করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাসে ইউরোপীয় কমিশনের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে উরসুলা ভন ডার লেন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ২০১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন করা উরসুলা ভন ডার লেন একসময় জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি জার্মানির বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে, বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চালর্স মিশেল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরোপীয় কাউন্সিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বৈঠকে তুরস্কের পক্ষে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অংশগ্রহণ করেন। আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত সাভাসগলু। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চালর্স মিশেল যখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে আলোচনার জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করেন, সেখানে এই তিনজন নেতার আলোচনায় বসার জন্য মাত্র দুটো চেয়ার নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল।
এমতাবস্থায় তুরস্ক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকার পাশে স্থাপিত দুটো চেয়ারের মধ্যে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জন্য নির্ধারিত চেয়ারের পাশে চালর্স মিশেল অপর চেয়ারে বসেন। অন্যদিকে, তিনজন নেতার জন্য নির্ধারিত দুটো চেয়ার প্রত্যক্ষ করার পর উরসুলা ভন ডার লেন খানিকটা অসন্তুষ্টি নিয়ে এরপর সেই কক্ষে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত সাভাসগলুর বিপরীত পাশে রাখা একটি সোফায় বসে পড়েন।
এই ঘটনার ছবি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশের নেতা তুরস্কের কঠোর সমালোচনা করেন। উক্ত বৈঠকে একই পদমর্যাদা হওয়ার সত্ত্বেও চেয়ার না পেয়ে উরসুলা ভন ডার লেনের সোফায় বসে পড়ার এই ঘটনাটি ‘সোফাগেট কেলেঙ্কারি’ নাম পায়। ফলে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের মধ্যে আবারও কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এমনকি, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে ‘স্বৈরশাসক’ হিসেবে অভিহিত করেন।
‘সোফাগেট কেলেঙ্কারি’র পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি বৈঠকের কথা উঠে আসে। ২০১৭ সালের ২৫ মে, বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের মধ্যকার একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ঘটনা আলোচিত হয়। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে ইউরোপীয় কাউন্সিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ও ইউরোপীয় কমিশনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কার এবং তুরস্কের পক্ষে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান উপস্থিত ছিলেন। ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে এই তিন নেতার বসার জন্য তিনটি আসনের ব্যবস্থা করা হয়।
২০১৭ সালে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকের ঘটনার সাথে আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের তুলনা করে কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক তুরস্কের এহেন আচরণে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ তোলেন। তুরস্ক সফরের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন একটি টুইট করেন। তিনি সেই টুইটে নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিতে সকলকে আরও পথ পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।
সম্প্রতি কাউন্সিল অব ইউরোপ আয়োজিত নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গৃহীত ‘ইস্তাম্বুল কনভেনশন’ থেকে তুরস্ক নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। ২০২১ সালের ২০ মার্চ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে এই কনভেনশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ‘সোফাগেট কেলেঙ্কারি’র পর কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক আবারও সেই কনভেনশন থেকে তুরস্কের নিজেদের প্রত্যাহারের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন’-এর ঘটনায় দেশটির প্রেসিডেন্টের কঠোর সমালোচনা করেন।
সেই বৈঠকে উপস্থিত ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চালর্স মিশেল এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেও এই ঘটনায় তুরস্কের পক্ষ থেকে ‘প্রটোকল রীতিনীতির সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যা’র বিষয়কে দায়ী করেছেন। তবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত সাভাসগলু আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত সেই বৈঠক আয়োজনের আসন বিন্যাস ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শ অনুযায়ী’ করা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন। তিনি ‘আন্তর্জাতিক প্রটোকল এর রীতিনীতি অনুসরণ করে’ সেই বৈঠক আয়োজন করার বিষয়টি তুলে ধরে এই ঘটনায় তুরস্কের দায়ভার অস্বীকার করেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্কের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই সদস্যরাষ্ট্র গ্রিস ও সাইপ্রাসের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে ‘তুরস্কের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ এর সমালোচনা করে আসছেন। এছাড়াও, বিভিন্ন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে তুরস্কের মতপার্থক্য রয়েছে। উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোটের (ন্যাটো) অন্যতম অংশীদার তুরস্ক বহু বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ অর্জনের জন্য সংস্থাটির সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘সোফাগেট কেলেঙ্কারি’র পর সংস্থাটির সাথে তুরস্কের পারস্পরিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা সময়ই নির্ধারণ করবে।