এ বছরের মাঝ-অক্টোবরে বাগদাদজুড়ে যখন অস্থিরতার উত্তাল হাওয়া বইছিল, তখন সবার অলক্ষ্যে নীরবে শহরে প্রবেশ করেন এক পরিচিত ব্যক্তি। সে সময় কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ছিল অবরুদ্ধ। আন্দোলনকারীরা রাস্তা দখল করে মিছিল করছিল দুর্নীতির অবসান আর প্রধানমন্ত্রী আদিল আব্দুল মাহদির পদত্যাগের দাবিতে। বিশেষত তারা নিন্দা জানাচ্ছিল ইরাকি রাজনীতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানের অস্বাভাবিক মাত্রার হস্তক্ষেপের। ইরানের বিরুদ্ধে তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছিল ইরানি পতাকা পোড়ানো এবং ইরানি কন্সুলেট আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে।
পরিচিত ব্যক্তিটি সেখানে গিয়েছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু সেখানে তার উপস্থিতিই ছিল আন্দোলনকারীদের প্রধান ক্ষোভের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কারণ তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি, ইরানের প্রভাবশালী কুদস ফোর্সের প্রধান। এবং তিনি সেখানে গিয়েছিলেন ইরাকি পার্লামেন্টের এক মিত্রের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আব্দুল মাহদিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কাজ করতে।
ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য বাগদাদে যাওয়ার ঘটনা সোলায়মানির এটাই প্রথম ছিল না। আব্দুল মাহদিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার তেহরানের এই প্রচেষ্টা ছিল ইরাককে নিজেদের ক্লায়েন্ট স্টেট হিসেবে ধরে রাখার তাদের সুদীর্ঘ তৎপরতারই একটা অংশ, যে তৎপরতার প্রমাণ উঠে এসেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ৭০০ পৃষ্ঠার ইরানের সরকারি গোপন ডকুমেন্টে। ডকুমেন্টগুলো থেকে ইরাককে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ইরানের আক্রমণাত্মক বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং এ ব্যাপারে কাসেম সোলায়মানির বিশেষ ভূমিকার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলো হচ্ছে মূলত ইরানের গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর আর্কাইভে থাকা বিভিন্ন বার্তা এবং প্রতিবেদনের সমষ্টি, যেগুলো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোনো এক বা একাধিক কর্মকর্তা প্রথমে সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টের কাছে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে ইন্টারসেপ্ট এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস সেগুলো নিয়ে যৌথভাবে দীর্ঘদিন তদন্ত করে, এবং অবশেষে গত ১৮ নভেম্বর একযোগে সেগুলোর উপর ভিত্তি করে সুদীর্ঘ একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলোর উপর ইন্টারসেপ্টের পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে রচিত আমাদের এই “ইরান ক্যাবল” সিরিজের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব। এই পর্বটি মূলত ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদনের প্রথম এবং পঞ্চম পর্ব থেকে অংশবিশেষ নিয়ে সাজানো হয়েছে। এখানে উঠে এসেছে এই লিক হওয়া ডকুমেন্টগুলোর সারাংশ, এগুলোতে কী কী আছে তার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং সেই সাথে এগুলো কীভাবে ফাঁস হয়েছে, তার বিবরণ।
কীভাবে ফাঁস হয়েছে ডকুমেন্টগুলো?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারগুলোকে নিয়মিতই গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয়। এ ধরনের গোপন তথ্য কখনও ফাঁস করে সরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে উদ্বিগ্ন সচেতন কর্মকর্তারা, কখনও তা করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা। কিন্তু ইরানে প্রায় কখনোই এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে না। সেখানে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় কঠোরভাবে। এবং জনস্বার্থে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করার প্রয়োজনীয়তা যদি কেউ মনে করেও থাকে, নিরাপত্তাবাহিনীর ভয়ে তার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না।
এবারের ডকুমেন্টগুলো যে বা যারা ইন্টারসেপ্টের কাছে ফাঁস করেছে, তারা শেষপর্যন্ত নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেনি। ইন্টারসেপ্টের সাথে তারা যোগাযোগ করেছে এনক্রিপ্টেড সফটওয়্যারের মাধ্যমে, কিন্তু তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে কিংবা সরাসরি কোনো রিপোর্টারের সাথে দেখা করতে রাজি হয়নি। তারা শুধু জানিয়েছে, “আমরা চাই আমাদের দেশ ইরাকে ইরান কী করছে, সেটা বিশ্ববাসীকে জানাতে।”
তাদের পাঠানো ডকুমেন্টগুলোর মধ্যে আছে ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি তথা MOIS-এর আর্কাইভে থাকা বিভিন্ন বিষয়ের উপর ৭০০ পৃষ্ঠার গোপন প্রতিবেদন, বিশেষ করে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ইরাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিযুক্ত MOIS-এর গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্ট এবং সেগুলোর পর্যালোচনা।
ইরানের মতো চূড়ান্ত গোপনীয়তায় মোড়া সরকার-ব্যবস্থার ভেতর থেকে এ ধরনের বার্তা ফাঁসের ঘটনা নজিরবিহীন। ডকুমেন্টগুলো পাওয়ার পর কয়েকমাস ধরে ইন্টারসেপ্টের একটি টিম সেগুলোকে ফারসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে এবং সেগুলোর তথ্যগুলো ক্রস চেক করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের কাছে ডকুমেন্টগুলোর গুরুত্ব পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করে।
মূলধারার গণমাধ্যমের বাইরে ইনভেস্টিগেটিভ মিডিয়া হিসেবে ইন্টারসেপ্টের বেশ সুনাম আছে। তাদের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন জেরেমি স্ক্যাহিল হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইরাকে আমেরিকান মার্সেনারি সংগঠন ব্ল্যাকওয়াটারের অস্তিত্ব এবং তাদের যুদ্ধাপরাধ সর্বপ্রথম বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অন্যায় যুদ্ধের, যুদ্ধাপরাধের এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর দমন-নিপীড়নের উপর ইন্টারসেপ্টের বেশ চমৎকার কিছু কাজ করেছে। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম না হওয়ায় তাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। ফলে তারা নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদেরকে এই রিপোর্টগুলো প্রকাশের ব্যাপারে অংশীদার করার প্রস্তাব দেয়।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলোতে থাকা অধিকাংশ তথ্যই ছিল অত্যন্ত জটিল আমলাতান্ত্রিক ভাষায় লেখা প্রতিবেদন কিংবা বিশ্লেষণ, অথবা সরাসরি ফিল্ড এজেন্টদের পাঠানো গোয়েন্দা রিপোর্ট। ফলে পরবর্তী মাসগুলোতে ইন্টারসেপ্ট এবং টাইমসের কর্মীরা ইরাক এবং ইরানে গিয়ে, এবং ফোনে ও ইমেইলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে সেগুলোর প্রকৃত অর্থ এবং সত্যতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
যেকোনো গোয়েন্দাসংস্থার অভ্যন্তরীণ বার্তা এবং বিশ্লেষণপূর্ব গোয়েন্দা তথ্যের মতোই এই ডকুমেন্টগুলোতেও এমন অনেক তথ্য আছে, যেগুলোর সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু এর বাইরে এগুলোতে এমন অনেক তথ্যই আছে যেগুলো গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বিশ্লেষক এবং ইরাকি ও ইরানি সূত্রগুলোর মতে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ইন্টারসেপ্ট এবং টাইমস নিজেরা ডকুমেন্টগুলোর সত্যতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হওয়ার পরেই সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করে।
তবে ডকুমেন্টগুলোতে এমন অনেক ব্যক্তির নাম এবং তাদের সম্পর্কে এমন সব ব্যক্তিগত আছে, যেগুলো হুবহু প্রকাশ করা হলে তারা বিপদে পড়তে পারে। সেজন্য ইন্টারসেপ্ট এবং টাইমস ডকুমেন্টগুলো হুবহু প্রকাশ না করে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত সারমর্ম প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কী আছে ডকুমেন্টগুলোতে?
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলোতে মূলত ইরাকের উপর ইরানের বিশাল প্রভাবের চিত্রই ফুটে উঠেছে- কীভাবে ইরানি গোয়েন্দারা বছরের পর বছর ধরে ইরাকি নেতাদেরকে হাত করার জন্য কাজ করে এসেছে, কীভাবে তারা আমেরিকানদের হয়ে কাজ করা ইরাকি গোয়েন্দাদেরকে অর্থ দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নিয়েছে, এবং কীভাবে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় অঙ্গনসহ ইরাকের জনজীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করেছে।
ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোপন ডকুমেন্টগুলোর অনেকগুলোতেই সত্যিকার গোয়েন্দাগিরির কথা এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, মনে হয় সেগুলো যেন কোনো স্পাই থ্রিলারের পাতা থেকে হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব ডকুমেন্টে স্থান পেয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির ভেতরে, শপিং মলে, শিকার অভিযানের কিংবা জন্মদিনের পার্টির কভারে আয়োজিত গোপন মিটিংয়ের কথা।
স্থান পেয়েছে বাগদাদ এয়ারপোর্টের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করা ইরানি গোয়েন্দাদের কথা, গোপন ক্যামেরা দিয়ে আমেরিকান সৈন্যদের ছবি তুলে ফেলার কথা, আমেরিকার সামরিক প্লেনগুলোর ওঠানামার সময়সূচী নোটবুকে টুকে রাখার কথা, নজরদারি এড়ানোর জন্য মিটিংয়ে যাওয়ার সময় এজেন্টদের ঘুরপথে গাড়ি চালানোর কথা।
ডকুমেন্টগুলোতে আরো আছে পেস্তা বাদামের গাছ, নামকরা সুগন্ধি আর জাফরানসহ বিভিন্ন মূল্যবান উপহারসামগ্রী দিয়ে ইরাকি সোর্সদেরকে হাত করার কথা; উপহারে কাজ না হলে নগদ অর্থে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার কথা। ডকুমেন্টগুলোতে MOIS-এর গোয়েন্দাদের পাঠানো খরচের হিসাব-নিকাশও আছে। এরকম একটি হিসাব থেকে যায়, এক কুর্দি কমান্ডারকে হাত করার জন্য ইরানি গোয়েন্দারা তার পেছনে উপহার সামগ্রীবাবদ ব্যাপক অর্থ ব্যয় করেছিল।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলোর একটি থেকে দেখা যায়, ইরানি গোয়েন্দাসংস্থার রিপোর্টে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল মাহদি সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে তিনি যখন ইরাকের তেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন তার সাথে IRI তথা ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের “বিশেষ সম্পর্ক” ছিল। কী ধরনের সম্পর্ক, সেটা অবশ্য ডকুমেন্টগুলোতে উঠে আসেনি। তবে সাদ্দাম হোসেনের সময় থেকেই যে আব্দুল মাহদির সাথে ইরানের যোগাযোগ ছিল, সেটা পরিষ্কার। সে সময় নির্বাসিত অবস্থায় আব্দুল মাহদি ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন।
সাবেক এক উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা এই “বিশেষ সম্পর্ক” নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এর অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে। বিশেষ সম্পর্ক থাকা মানেই এমন না যে, তিনি ইরানের এজেন্ট। কিন্তু বাস্তবে কোনো ইরাকি রাজনীতিবিদের পক্ষেই ইরানের অনুগ্রহ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব না। এবং ২০১৮ সালে আব্দুল মাহদি যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান, উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য একজন প্রার্থী হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলো থেকে চূড়ান্ত গোপনীয়তার চাদরে মোড়া ইরানের সরকারের এবং গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যায়। ডকুমেন্টগুলো থেকে দেখা যায়, ২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের পর থেকেই ইরান কীভাবে ইরাককে কব্জা করে নিতে থাকে। মূলত আমেরিকার ইরাক আক্রমণই ইরানকে এই সুযোগ করে দেয়, যার ফলে তারা তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত।
ডকুমেন্টগুলো মূলত ইরাকি রাজনীতিতে ইরানের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে এতদিন ধরে জানা বিষয়গুলোকেই নিশ্চিত করেছে। কিন্তু হেডকোয়ার্টারে পাঠানো ইরানি গোয়েন্দাদের রিপোর্টগুলো থেকে ইরাকের ক্রীড়াঙ্গনে ইরান এবং আমেরিকার স্পাই গেম সম্পর্কে পরিষ্কার একটা চিত্র ফুটে ওঠে। সেগুলো একইসাথে ইরানের সরকারের অভ্যন্তরের জটিল রাজনীতি এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপর নতুন করে আলোকপাত করে, যে বিষয়ে আগে খুব কমই জানা ছিল।
এগুলো থেকে দেখা যায়, ইরাকের মাটিতে ইরানকে ঠিক একই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছিল, যেরকম চ্যালেঞ্জ ইরাক দখলের পরপরই মোকাবেলা করতে হয়েছিল আমেরিকাকে। এবং ডকুমেন্টগুলো থেকে এটাও দেখা যায়, ইরাকে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতার খেলায় ইরান কীভাবে প্রায় প্রতিটি ধাপে তাদেরকে কৌশলে হারিয়ে দিয়েছে।
ইরানের এসপিওনাজ জগতের বিভিন্ন অপারেশনের এবং ইরাকি ও কুর্দি রাজনীতিবিদদেরকে হাত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ডকুমেন্টগুলো জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিরুদ্ধে ইরানের রহস্যময় যুদ্ধের ব্যাপারেও আলোকপাত করে। ডকুমেন্টগুলো থেকে দেখা যায়, কীভাবে প্রকাশ্যে পরস্পর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও আইএসবিরোধী যুদ্ধে ইরান এবং আমেরিকার স্বার্থ এক হয়ে গিয়েছিল এবং কীভাবে এই যুদ্ধে তারা গোপনে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করছিল।
ডকুমেন্টগুলোতে আরো উঠে এসেছে তুরস্কে অনুষ্ঠিত মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি দলের সাথে ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডদের একটি গোপন মিটিংয়ের কথাও, যে মিটিংয়ে তারা নিজেরা পরস্পর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উভয়ের সাধারণ বৃহত্তর শত্রু সৌদি আরবের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করার সম্ভাবনা বিচরণ করছিল।
তবে সব মিলিয়ে ডকুমেন্টগুলো থেকে ইরাকের দুর্ভাগ্যের চিত্রটিই উঠে এসেছে, যে দেশটির উপর সাদ্দাম হোসেন দীর্ঘদিন জেঁকে বসেছিল, যে দেশটিকে ২০০৩ সালে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে আমেরিকা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল, এবং আমেরিকা চলে যাওয়ার পর যে দেশটিকে ইরান নিজের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকা ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার পরেও ইরাকের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ২০১১ পরবর্তী ইরাকের ভাগ্যবিধাতা মূলতই ইরানই। তারা তাদের গোয়েন্দাদের বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরাকি রাজনীতিকে নিজেদের মতো গড়ে তুলেছে, ইরাকের ক্ষমতার কাঠামো গঠন করে দিয়েছে, এবং আজও যেসব নেতারা ইরাক শাসন করছেন, তাদেরকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছে।
ইরাকের আজকের পরিস্থিতির জন্য তাই আমেরিকার পাশাপাশি ইরানও অনেকাংশে দায়ী। আর সে কারণেই গত কয়েকমাস ধরে ইরাকজুড়ে যে আন্দোলন চলছে, যে আন্দোলনে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে অন্তত ৩৩০ জন, সে আন্দোলনে নতুন প্রজন্মের ইরাকিদের মূল লক্ষ্য একটাই – ইরানের প্রভাব থেকে নিজের দেশের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়া।
প্রথম পর্বের মূল প্রতিবেদক: জেমস রাইজেন, টিম আরাঙ্গো, ফারনাজ ফাসিহি, মুর্তজা হাসান, রোনেন বার্গম্যান
পঞ্চম পর্বের মূল প্রতিবেদক: বেটসি রীড, ভেনেসা গেজারি, রজার হজ
প্রকাশের তারিখ: ১৮ নভেম্বর, ২০১৯
আগামী পর্বে পড়ুন: ইরানি গোয়েন্দারা কীভাবে আমিরাকের হাত থেকে ইরাকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, কীভাবে তাদের গোয়েন্দারা ইরাকের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হাত করেছে, সেই কাহিনী।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/