এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার যেসব দেশের দীর্ঘ পরাধীনতার ইতিহাস আছে, কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে যেসব দেশের মাথাপিছু আয় তুলনামূলকভাবে বেশ কম, সাধারণভাবে সেই দেশগুলো মোটা দাগে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে পরিচিত। এসব দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ দুর্বল। অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের চেষ্টা করলেও সামাজিক ন্যায্যতার জায়গাটিতে রয়েছে অনেক পিছিয়ে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশ সংকীর্ণ, ফলে বারবারই বাধাগ্রস্ত হয় নাগরিকদের রাজনৈতিক আর ন্যায্যতার অধিকার।
স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই এসব দেশ বিভিন্ন সময় সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছে, কখনো দীর্ঘ সময়ের জন্য চলে গেছে সামরিক শাসনের অধীনে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে গত শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশ মুখোমুখি হয়েছে সামরিক শাসনের, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দেশ প্রত্যক্ষ করেছে সামরিক অভ্যুত্থান। বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতা পাওয়া আফ্রিকার দেশগুলোও ব্যতিক্রম না, বিভিন্ন মোড়কে অর্ধেকের বেশি দেশে বিভিন্ন সময়ে চলেছে সামরিক শাসন।
প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যখন গণতন্ত্রের জয়জয়কার চলছে, তখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কেন বারবার মুখোমুখি হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থানের? জনগণ থেকে ইউনিফর্ম পড়ুয়াদের নিয়ন্ত্রণে কেন বারবার চলে গেছে রাষ্ট্রকাঠামো?
রাজনৈতিক সংস্কৃতি
ফাইনার জাতিরাষ্ট্রের যুগে রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। পরিণত, বিকশিত, নিম্ন এবং সর্বনিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্ন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি সর্বনিম্ন। সাধারণত, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিণত বা বিকশিত। এগুলোতে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ।
কিন্তু অন্যদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়ায়; শিক্ষা, বাক-স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার নিশ্চয়তা না থাকায়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নাগরিকেরা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন হয়। সহজে এদেরকে প্রভাবিত করা যায়। এই সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সামরিক বাহিনীকে সুযোগ করে দেয় ক্ষমতা দখলের।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পলিসি তৈরিতে কাজ করে অনেকগুলো প্রেশার গ্রুপ। সরকারকে রক্ষা করতে হয় তাদের স্বার্থ। এ রকম প্রেশার গ্রুপের নিয়মিত হস্তক্ষেপ সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। জনমত চলে যায় সরকারের বিপক্ষে। এমন অবস্থায় সামরিক বাহিনী মঞ্চে আবির্ভাবের সুযোগ পায়। সুযোগ পায় ক্ষমতা দখলের।
ক্ষমতায় আসার চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বে অনেকসময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছাড় দিতে না চাওয়ার মনোভাব থেকে সৃষ্টি হয় অস্থিতিশীলতার। দলগুলোর মধ্যে এ রকম বিভাজন সুযোগ তৈরি করে দেয় উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসারদের। পাকিস্তানের ১৯৭৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থান এমনই প্রেক্ষাপট থেকে তৈরি।
রাজনৈতিক কাঠামোতে কার্যকর সিভিল সোসাইটি না থাকাও তৃতীয় বিশ্বের বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ আসার অন্যতম কারণ। দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রভাবশালী ভূমিকায় থাকে সম্পদশালী পরিবারগুলো। এ রকম প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্বের সংস্কৃতিও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। যেমন- থাইল্যান্ডে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থান হচ্ছে রাজপরিবারের সমর্থনে, প্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয় সিনাওয়ত্রা পরিবারকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থ-সামাজিক অবস্থা
মধ্যবিত্ত শ্রেণিই অধিকাংশ সময় ঠিক করে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রকৃতি, তাদের সমর্থনের উপরই নির্ভর করে সরকারের টিকে থাকা। রাষ্ট্রকাঠামোতে এরা কাজ করে স্থিতিশীলতার শক্তি হিসেবে। সামরিক শাসন আসার পেছনেও রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভূমিকা।
প্রথমত, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দীর্ঘ সময় উপনিবেশিক শাসনে থাকায় নাগরিকদের একটা বড় অংশ দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটলেও অনেক দেশেই এই অংশটা এখনো বিকশিত হয়নি। ফলে ক্ষুদ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাষ্ট্রকাঠামোতে রাখতে পারে না কার্যকর ভূমিকা। তাদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় সামরিক শাসকদের অধীনে।
দ্বিতীয়ত, তৃতীয় বিশ্বের বেশ কিছু দেশ উন্নয়নশীল অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, এসব দেশে বিকশিত হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বেসামরিক সরকার অনেকসময় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ বহন করে না। ফলে, শ্রেণিস্বার্থের জন্য এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনেকসময় সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণে প্রলুব্ধ করে।
তৃতীয়ত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক কাঠামোতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পারিবার-কেন্দ্রিক রাজনীতি। ফলে, একটা সময় পরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি চেষ্টা করলেও ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে পারে না, পরিবর্তন করতে পারে না নিজেদের ভাগ্য। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোতে এই কারণটির উপস্থিতি গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়।
চতুর্থত, অনেক সময় দেখা যায়, বেসামরিক সরকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশের স্বার্থ রক্ষা করে পলিসি প্রণয়ন করছে। এই অবস্থায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাকি অংশগুলো নিজেদের স্বার্থের তাগিদে বেসামরিক সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে সামরিক বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে ক্ষমতা গ্রহণে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নবাদ আবির্ভূত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে, বেসামরিক সরকারের টিকে থাকা নির্ভর করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর। বিপুল শ্রমশক্তি আর উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামনে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন না থাকলে বেসামরিক সরকারের প্রতি সমর্থন কমতে থাকে, কমতে থাকে সমর্থনের ভিত্তি। ফলে, স্বল্প অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে বেড়ে যায় সামরিক শাসন আসার সম্ভাবনা। এই অবস্থা এড়ানোর জন্য তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ভুয়া উচ্চ প্রবৃদ্ধি উপস্থাপন করে। যেমন- লিবিয়ায় কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি রেজিম।
আবার, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই বিপুল শ্রমশক্তি থাকার পরেও এদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা যায় না। ফলে, সস্তা শ্রম-নির্ভর খাতগুলোতে এই শ্রমশক্তির বড় একটা অংশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সময় এই ধারা একমুখী হয়ে ডাচ ডিজিজের মুখে পড়ে অর্থনীতি। ভেঙে পড়ে যেকোনো সংকটে। অর্থনীতির ধ্বস প্রভাবিত করে সামরিক শাসনের উপস্থিতি।
একই অবস্থার মুখোমুখি হয় একটিমাত্র খনিজের উপর নির্ভরশীল দেশগুলোও, অর্থনীতিকে বহুমুখী করতে না পারার দরুন একটা সময় মুখোমুখি হয় ডাচ ডিজিজের। বর্তমানে ভেনিজুয়েলার অবস্থা সে রকম। অর্থনৈতিক দুরাবস্থা অস্থিতিশীল করে তোলে পুরো রাজনৈতিক কাঠামোকে। একটা সময় রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় সামরিক শাসকদের হাতে।
সাংগঠনিক কাঠামো
প্রায় একই আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট থাকার পরেও ভারত যেখানে শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় শাসিত হচ্ছে, পাকিস্তান সেখানে বারবার মুখোমুখি হয়েছে সামরিক শাসনের। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সেনাদের সম্মিলন, বিচিত্র সংস্কৃতি আর শক্তিশালী বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীকে রেখেছে সাংবিধানিক শাসনের অধীনে। বিপরীতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে শুরু থেকেই পাঞ্জাবি সেনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, এরা সেনাবাহিনীতে তৈরি করেছে ডিপ স্টেট। ফলে, সরকার এদের স্বার্থ-বিরোধী কোনো পদক্ষেপ নিলেই সামরিক হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক শাসন আসা আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক শক্তিমত্তার উপর নির্ভরশীল।
প্রথমত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো জাতি, বয়স, শিক্ষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে বিভাজন থাকলেও সামরিক বাহিনীতে স্ট্রং চেইন অফ কমান্ড রয়েছে। রয়েছে কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামো। ফলে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতা লিপ্সায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে জনগণ সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজে।
দ্বিতীয়ত, সামরিক বাহিনীর আকার তুলনামূলকভাবে বড় হলে সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তৃতীয়ত, প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। এই দুর্যোগকালীন মূহুর্তগুলোতে সামরিক বাহিনী দাড়ায় জনগণের পাশে। দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে দুর্যোগ পরবর্তী অবস্থার। ফলে, দুর্নীতিবাজ বেসামরিক সরকারের বিপরীতে সামরিক বাহিনীর প্রতি জনগণের কাছে ভাবমূর্তি তৈরি হয়, তৈরি হয় গ্রহণযোগ্যতা। এগুলো প্রভাব রাখে সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্তে এবং সামরিক শাসনের গ্রহণযোগ্যতায়।
চতুর্থত, যেসব দেশের সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস রয়েছে, সেসব দেশে বারবার ক্যু হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সাধারণত, নবিসদের ট্রেনিং থেকে এসব দেশে এই ওরিয়েন্টেশন শুরু হয় এবং প্রত্যেক অফিসারই ক্ষমতা দখলের সু্যোগ খুঁজতে থাকে।
বৈদেশিক প্রভাব
দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পেলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকারগুলোর জন্য এখনো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মুখিয়ে থাকে পরাশক্তিগুলোর দিকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে পরাশক্তিগুলো। সহযোগিতা করে ব্যক্তি কিংবা ক্রিয়াশীল সংগঠনকেও। বিনিময়ে, সরকার গঠন করলে সেই দল বা ব্যক্তির মাধ্যমে সেই পরাশক্তির পক্ষে নীতি গ্রহণ করতে হয়, দিতে হয় অর্থনৈতিক সুবিধা।
কিন্তু, জাতিরাষ্ট্রের যুগে স্বাভাবিকভাবেই কিছু কিছু দল কঠোর ন্যাশনালিস্ট পলিসি নেয়। সংকীর্ণ করে দেয় ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রভাবের সুযোগ। এই অবস্থায় পরাশক্তিগুলো অনেকসময় ব্যবহার করে সামরিক বাহিনীকে, ক্ষমতাচ্যুত করে গণতান্ত্রিক সরকারকে। ফলে, সামরিক শাসনের অশেষ চক্রে ঢুকে যায় দেশ।
যেমন, তেল খাত জাতীয়করণ করায় ১৯৫৩ সালে সিআইএ ইরানের মোসাদ্দেক সরকারের পতনে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে সামরিক বাহিনীকে। একইরকম ভূমিকা আছে লিবিয়া, ইয়েমেন আর ভেনিজুয়েলায়ও।
খুব কম দেশেই মিলিটারি রেজিমে পরিবর্তন হয় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন আবদ্ধ হয়ে ছোট্ট একটা সুবিধাভোগী শ্রেণির কাছে। ফলে, তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে চলতে থাকে সামরিক শাসনের দুষ্টচক্রের সাথে সাথে আবর্তিত হয় জনগণের নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক সংস্কার আর উন্নয়ন।