সিরিয়ার যুদ্ধ শুধুমাত্র সরকারের সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ না, বরং একাধিক আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধ। সম্প্রতি আবারও এর একটি বড় উদাহরণ দেখা গেছে তেহরান সম্মেলনে, যেখানে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের ৩০ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের আলোচনায় সিরিয়ার সরকারের বা বিদ্রোহীদের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না, ছিল ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্কের প্রতিনিধিরা। এই মুহূর্তে এরাই সিরিয়ার প্রধান খেলোয়াড়, সেই সাথে কিছুটা কম হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও আছে সিরিয়াতে। তেহরান সম্মেলন কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর ইদলিবে হয়তো শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে রাশিয়া ও ইরান সমর্থিত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীর তীব্র আক্রমণ। চলুন তার আগেই জেনে নিই ইদলিবে কোন কোন দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এবং তাদের কার কী স্বার্থ।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ
মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ শাসকের মতোই বাশার আল-আসাদও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট না। পিতা হাফেজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর সংবিধান সংশোধন করে তার উপর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু তারপরেও তিনি নিজেকে সিরিয়ার বৈধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং বিদ্রোহীদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সিরিয়ার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি থেকে বিদ্রোহীদেরকে নির্মূল করতে বদ্ধ পরিকর। আর এ লক্ষ্যে তিনি সামরিক আক্রমণকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেন।
ইদলিব সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য এলাকা হওয়ায় এই মুহূর্তে আসাদের দৃষ্টি ইদলিবের উপর নিবদ্ধ। ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে বিদ্রোহীদের হাতে আর উল্লেখযোগ্য কোনো এলাকা না থাকায় তারা আসাদের ক্ষমতায় থাকার বিরুদ্ধে কোনো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারবে না। একইসাথে ইদলিবের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারার পরেই কেবল আসাদের পক্ষে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর উপর নজর দেওয়া সম্ভব হবে।
এছাড়াও আমাদের পূর্ববর্তী একটি লেখায় যেরকম বলা হয়েছিল, ইদলিবের মধ্য দিয়ে জর্ডান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘এম ফাইভ’ হাইওয়ের এবং আলেপ্পো হয়ে লাতাকিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার হুমাইমিম বিমান ঘাঁটি পর্যন্ত বিস্তৃত ‘এম ফোর’ হাইওয়ের অবস্থান হওয়ায় প্রদেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আসাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও সময়ের সাথে সাথে আফরিনের মতো ইদলিবেও তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে কারণেও আসাদ যত দ্রুত সম্ভব ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া।
তুরস্ক
‘There are about 3.5mn people there…’: Working with Russia ‘really important’ to prevent #Idlib ‘massacre’ – Erdoganhttps://t.co/wbDXVcafcQ pic.twitter.com/7f3waDBZdg
— RT (@RT_com) September 6, 2018
সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তুরস্কের স্বার্থ বিভিন্ন ধরনের। তুরস্ক মোটের উপর বাশার আল-আসাদের পতন চায় এবং সে হিসেবে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে অর্থ, অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করে। আবার কুর্দিদের বিস্তার রোধ করার জন্য তুরস্ক সরাসরি সিরিয়ার অভ্যন্তরে একাধিক অপারেশনও চালিয়েছে। কিন্তু ইদলিব তুরস্কের জন্য ভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে যতগুলো শহরে যুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো থেকে পালিয়ে বিদ্রোহীরা ইদলিবে বা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ইদলিবই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেষ এলাকা হওয়ার কারণে এবার তাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকবে না। তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ার কারণে ইদলিবের ৩০ লাখ মানুষের একটা বড় অংশই শেষপর্যন্ত জীবন বাঁচাতে তুরস্কের দিকেই যাত্রা করবে।
তুরস্কে বর্তমানে সিরিয়ান শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। নতুন করে ইদলিবের শরণার্থীদের চাপ সহ্য করার মতো ক্ষমতা তুরস্কের নেই। সে কারণে তুরস্ক ইদলিবে বড় ধরনের কোনো অপারেশনের বিরোধিতা করে আসছে। তারা ইদলিবের আশেপাশে বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের ১২টি নজরদারি সেনাচৌকিও স্থাপন করেছে। একইসাথে তারা আসাদ ও রাশিয়ার আক্রমণের মুখে নিজেদের অনুগত বিদ্রোহী গ্রুপগুলোরও যথাসম্ভব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। সে উদ্দেশ্যেই সম্ভবত সম্প্রতি তারা ইদলিবের নিয়ন্ত্রণে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী জিহাদী সংগঠন হাইআত তাহরির শাম, যারা অতীতে আল-কায়েদার সাথে যুক্ত ছিল, তাদেরকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে অন্যান্য গ্রুপগুলোর সাথে তাদের পার্থক্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে।
ইরান
Turkey’s call for a ceasefire in Idlib was rejected by Russia and Iran during a summit on Friday, prompting President Recep Tayyip Erdogan to warn of a Turkish intervention if there is an escalation. https://t.co/5jHfPCsHru
— Al Jazeera News (@AJENews) September 8, 2018
সৌদি আরব এবং ইরান মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একাধিক ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। সিরিয়া হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যদিও সৌদি আরব পরবর্তীতে সিরিয়া থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে, কিন্তু প্রথমদিকে বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন এবং সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে সৌদি আরব এবং তাদের তৎকালীন উপসাগরীয় মিত্র কাতারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মূলত সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় সুন্নী রাষ্ট্র সমর্থিত গ্রুপগুলো যেন সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সেজন্যই ইরান সিরিয়াতে হস্তক্ষেপ শুরু করে এবং বাশার আল-আসাদকে রক্ষায় সচেষ্ট হয়।
এছাড়াও সৌদি আরবের মতোই ইরানও মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ক্ষমতার বলয় বিস্তৃত করতে চায়। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পরবর্তী দেড় দশকে ইরাকে তারা সফলভাবেই প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। ইরাকের সীমান্ত সংলগ্ন সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ পূর্ব থেকেই ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইরান তাই সিরিয়ার ক্ষমতায় নতুন কোনো সুন্নী গ্রুপকে দেখার পরিবর্তে বাশার আল-আসাদকেই দেখতে চায় এবং তার মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত নিজের প্রভাব বজায় রাখতে চায়। এছাড়াও ইরানের অনুগত লেবাননের হেজবুল্লাহ মিলিশিয়া গ্রুপের কাছে অস্ত্র পৌঁছানোর জন্যও সিরিয়াতে একটি অনুগত সরকার তাদের প্রয়োজন।
রাশিয়া
Turkey warns Russia an attack on Idlib will turn it into ‘lake of blood’ https://t.co/agWraBMgBu
— DashingClaire (@dashingclaire) September 9, 2018
লিবিয়ার গাদ্দাফির পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং সিরিয়া ছাড়া পশ্চিমা বিরোধী কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান অবশিষ্ট নেই। তাই সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে রক্ষা করা রাশিয়ার নিজের স্বার্থে জরুরি ছিল। এছাড়াও ইউক্রেন সংকটের পর দেশীয় রাজনীতিতেও নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য এবং রাশিয়াকে সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য পুতিনের সফল একটি অপারেশনের প্রয়োজন ছিল। এসব উদ্দেশ্যেই রাশিয়া ২০১৫ সালের শেষ দিকে এসে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকেই মূলত বাশার আল-আসাদের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়।
বাশারের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য রাশিয়াও ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী। কিন্তু এক্ষেত্রে রাশিয়া হয়তো বাশারের মতো পূর্ণমাত্রার একটি সামরিক অভিযানে যেতে খুব একটা আগ্রহী হবে না। অন্তত ব্যয়বহুল আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে হয়তো বাশার, ইরান এবং তুরস্কের চাহিদার মাঝামাঝি একটা অবস্থানে গিয়ে সীমিত আকারের একটি অভিযানের মাধ্যমে বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত এবং আত্মসমর্ণ করানোর মধ্য দিয়ে সবার উপর নিজের প্রভাব বজায় রাখার ব্যাপারেই রাশিয়া হয়তো বেশি সচেষ্ট হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
President Bashar al-Assad of Syria must not recklessly attack Idlib Province. The Russians and Iranians would be making a grave humanitarian mistake to take part in this potential human tragedy. Hundreds of thousands of people could be killed. Don’t let that happen!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) September 3, 2018
সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র কুর্দিরা। ইদলিব কুর্দি প্রধান এলাকা না হওয়ায় এবং মার্কিন বলয়ের বাইরে হওয়ায় সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ইদলিবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মাঝারি আকারের কোনো অপারেশন হলে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের বাধাও দেবে না, বরং তারা হয়তো কিছুটা খুশিই হবে। কারণ, ইদলিবের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গ্রুপ হচ্ছে হাইআত তাহরির শাম, যাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে। তাহরির শামের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ নেতার উপর যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন আক্রমণও করেছে।
কিন্তু বিপরীত দিকে যুক্তরাষ্ট্র এই বলে হুঁশিয়ারি করেছে যে, বিদ্রোহীদের উপর রাসায়নিক আক্রমণ করা হলে তারা সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে। তবে রাসায়নিক আক্রমণ হবে কিনা, কিংবা হলেও যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তা এখনও পরিস্কার না। এর আগে প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় রাসায়নিক হামলার পরেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পূর্ব ঘুতায় রাসায়নিক আক্রমণের পর সিরিয়াতে অবস্থিত বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে রাসায়নিক হামলার পর ট্রাম্প আসাদকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যদিও শেষপর্যন্ত তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কারণে তা কার্যকর হয়নি।
আরও পড়ুন:
ইদলিব: রক্তবন্যার আশঙ্কায় ত্রিশ লাখ মানুষ
ইদলিবের ‘বিদ্রোহী’রা আসলে কারা?
Featured Image Source: AP