গত ৭ সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানে রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যকার সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই সবাই আশঙ্কা করছিল, অচিরেই হয়তো বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশ মুক্ত করার লক্ষ্যে অভিযান শুরু করবে। সাথে থাকবে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী এবং আকাশ থেকে বিমান হামলার মাধ্যমে সাহায্য করবে রাশিয়ার বিমান বাহিনী। বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী সেপ্টেম্বেরের শুরু থেকেই ইদলিবের সীমান্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্য জড়ো করছিল এবং ছোটখাট কয়েকটা হামলাও করছিল। সম্মেলনের পর রাশিয়ার পক্ষ থেকেও আসন্ন অভিযানের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সব আশঙ্কা এবং হুঁশিয়ারির মধ্যেই গত সোমবার হঠাৎ করেই শোনা যায় অনেকটা অনাকাঙ্খিত সুসংবাদটি, ঠিক এখনই ইদলিবে কোনো অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না।
BREAKING: Major Russia – Turkey Breakthrough on Idlib #Syria :
•15 Km Buffer Demilitarized Zone for TK and RU by Oct 15
•HTS / Nusra would withdraw, unclear about rebels
•Erdogan: We prevented a humanitarian Catastrophe in Idlib
•Russia Def.: NO military offensive in Idlib— Joyce Karam (@Joyce_Karam) September 17, 2018
১৭ই সেপ্টেম্বর, সোমবার কৃষ্ণ সাগরের তীরে অবস্থিত রাশিয়ার পর্যটন শহর সোচিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িব এরদোয়ানের মধ্যে ইদলিবের ভবিষ্যত নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে দেশ দুটির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় এবং দেশ দুটির প্রেসিডেন্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ইদলিব নিয়ে আগামী দিনগুলোর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। তারা জানান, আপাতত ইদলিবে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালিত হবে না। বরং ইদলিবের সীমান্ত জুড়ে একটি ‘ডিমিলিটারাইজড জোন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেখানে রাশিয়ান এবং তুর্কি সেনাবাহিনী যৌথভাবে মহড়া দিবে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে ইদলিবের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা এবং এর বাইরে চতুর্দিকে সিরিয়ার সরকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যবর্তী সীমান্ত বরাবর ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠিত করা হবে। এই এলাকায় সাধারণ বেসামরিক জনগণ থাকতে পারবে, হালকা অস্ত্র হাতে ‘মডারেট’ বিদ্রোহীরাও থাকতে পারবে, কিন্তু অক্টোবরের ১০ তারিখের পূর্বেই সেখান থেকে ট্যাংক, রকেট লঞ্চার, মর্টার লঞ্চারসহ সব ধরনের ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
এছাড়াও এই সমঝোতার অধীনে সকল ‘মৌলবাদী’ গোষ্ঠীকেও এলাকা ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে কি শুধুমাত্র বাফার জোন ত্যাগ করতে হবে, নাকি পুরো ইদলিব শহর ত্যাগ করতে হবে, সেটি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিন মৌলবাদী গ্রুপগুলোর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল-কায়েদার সাথে সম্পর্কিত আল-নুসরা ফ্রন্টের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা বর্তমানে হাইআত তাহরির শাম নামে পরিচিত। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, তারা সকল মৌলবাদী গ্রুপকে এ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন, কিন্তু ঠিক কোন কোন গ্রুপ মৌলবাদী, তা উভয় রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মিলে পরবর্তীতে নির্ধারণ করবে।
সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী এসব শর্ত বাস্তবায়িত হলে সিরিয়ান সেনাবাহিনী কিংবা তাদেরকে সহায়তাকারী ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা এবং রাশিয়ান বিমানগুলো ইদলিবে কোনো অভিযান চালাবে না। পরবর্তী দিনগুলোতে বাফার জোনে তুর্কি এবং রাশিয়ান সেনারা যৌথভাবে টহল দিবে, যেরকম মানবিজে মার্কিন এবং তুর্কি সেনারা দিয়ে থাকে। সবকিছু ঠিকভাবে এগোলে ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী লাতাকিয়ার সাথে আলেপ্পো এবং হামার মতো বড় বড় শহরের সংযোগ সৃষ্টিকারী মহাসড়কগুলো পুনরায় চালু করা হবে।
“There would be no change in the status of Idlib” https://t.co/xeH0maR8Ii
— Al Jazeera News (@AJENews) September 18, 2018
এখন পর্যন্ত এ সমঝোতায় সব পক্ষই মোটামুটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে। ইরান একে গঠনমূলক কূটনীতির ফলাফল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সিরিয়ার সরকারও রক্তপাত বন্ধের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে, যদিও তারা জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার ভূমির প্রতিটি ইঞ্চি মুক্ত না করা পর্যন্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবে। জাতিসংঘও একে স্বাগত জানিয়েছে এবং শর্তগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানিয়েছে। ইদলিবের অধিবাসীদের অনেকেই এতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও শেষপর্যন্ত এটি কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। তবে এই সমঝোতার ফলে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তুরস্ক। এমনকি বলা যায় এই সমঝোতা অনেকটাই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপের ফল।
আমাদের আগের একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল, ইদলিবে সামরিক অভিযান হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তুরস্ক। যদিও তুরস্ক সীমান্ত বরাবর দেয়াল তৈরি করে রেখেছে, কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে ইদলিবের অধিবাসীরা যদি প্রাণ বাঁচানোর জন্য সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, তবে হয়তো তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া ছাড়া তুরস্কের অন্য কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু তুরস্কে আগে থেকেই সিরিয়া থেকে যাওয়া প্রায় ৩৫ লাখ শরণার্থীর বসবাস, নতুন করে আরো কয়েক লাখ শরণার্থী গ্রহণ করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। এছাড়াও ইদলিবে থাকা বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তুরস্কে ঢুকে পড়লে তা তুরস্কের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে রাশিয়া যদিও সিরিয়া যুদ্ধে বাশার আল-আসাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, কিন্তু অনেক বিশ্লেষকের মতে বিকল্প কোনো পথ থাকলে এই মুহূর্তে রাশিয়া ইদলিবে নতুন করে অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি সামরিক অভিযান শুরু করতে রাজি হবে না। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতির পর থেকে রাশিয়া তুরস্কের কূটনৈতিক মিত্র হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের একাধিক অস্ত্র চুক্তি আছে, রাশিয়া তুরস্কের প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করছে। সর্বোপরি তুরস্ক ন্যাটোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়ায় ন্যাটোকে দুর্বল করার লক্ষ্যে তুরস্কের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক থাকা রাশিয়ার জন্য জরুরি। নিতান্ত বাধ্য না হলে এই মুহূর্তে রাশিয়া সরাসরি তুরস্কের স্বার্থে আঘাত করবে না।
আর ঠিক এই সুযোগটিই গ্রহণ করেছে তুরস্ক। গত বছরের আস্তানা সম্মেলেনের পর থেকেই ডি-এস্কেলেশন জোন পর্যবেক্ষণের জন্য ইদলিবে তুরস্কের ১২টি সেনা চৌকি ছিল। তেহরান সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পর তুরস্ক নতুন করে সেসব সেনা চৌকিতে সৈন্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে এবং ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্রশসস্ত্র সিরিয়ার সীমান্তে নিয়ে জড়ো করতে শুরু করে। নিজের সেনাবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতির মধ্য দিয়ে তুরস্ক একদিকে রাশিয়ার জন্য ইদলিবের উপর আক্রমণ করা কঠিন করে তোলে, অন্যদিকে রাশিয়াকে তারা আশ্বস্ত করে এটা দেখিয়ে যে, এই সেনাবাহিনী দিয়ে তারা ইদলিবের বেসামরিক জনগণ থেকে সন্ত্রাসীদেরকে পৃথক করতে পারবে।
UN envoy asks for quick implementation of Russia-Turkey agreement on demilitarized buffer zone in Syria’s #Idlib province https://t.co/Kayk42ZUlw pic.twitter.com/rppVV0GYhG
— China Xinhua News (@XHNews) September 18, 2018
মূলত তুরস্কের সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণেই শেষপর্যন্ত রাশিয়া তাদের সাথে সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। এর ফলে আপাতত একটি সম্ভাব্য গণহত্যা কিংবা অন্ততপক্ষে একটি সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে গেল ইদলিববাসী। আপাতত অক্টোবরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত হয়তো কোনো সামরিক অভিযান সংঘটিত হবে না। তুরস্ক এবং রাশিয়া হয়তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে, কিন্তু তারা একদিকে বিদ্রোহীদের চরমপন্থী অংশটিকে, অন্যদিকে বাশার আল-আসাদকে শেষপর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
ইদলিব: রক্তবন্যার আশঙ্কায় ত্রিশ লাখ মানুষ
ইদলিবের ‘বিদ্রোহী’রা আসলে কারা?
ইদলিবের ব্যাপারে পুতিন-এরদোয়ানের সমঝোতা স্মারকের ভবিষ্যত কী?
ফিচার ইমেজ: Alexander Zemlianichenko/Pool via REUTERS