সিরিয়ার ইদলিবে জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ীই ‘সন্ত্রাসী’দের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। জাতিসংঘ অবশ্য শুধু আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত গোষ্ঠীগুলোকেই ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু সিরিয়া, ইরান এবং রাশিয়ার সংজ্ঞা অনুযায়ী এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। ইদলিবে সর্বমোট সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৬০,০০০ বলে ধারণা করা হয়। এদের সবাই অবশ্য আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত না। এদের মধ্যে আল-কায়েদা ছাড়াও অন্যান্য জিহাদী সংগঠন আছে, জিহাদী নয় এমন ইসলামপন্থী সংগঠন আছে, এমনকি আছে সিরিয়ার সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সদস্যরাও। চলুন জেনে নিই ইদলিবের এই বিদ্রোহীরা আসলে কারা।
হাইআত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)
হাইআত তাহরির আল-শাম, যা সংক্ষেপে তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস নামে পরিচিত, ইদলিবের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। ইদলিব প্রদেশের রাজধানী এবং তুরস্ক সংলগ্ন সীমান্ত এলাকা বাব আল-হাওয়াসহ প্রদেশের প্রায় ৬০ ভাগ এলাকাই এদের নিয়ন্ত্রণে। এইচটিএসের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১২ হাজার বলে ধারণা করা হয়। তবে এইচটিএসের অনুগত অন্যান্য ছোটখাটো সংগঠনগুলোসহ হিসেব করলে এই সংখ্যা প্রায় ২০ হাজারের মতো হতে পারে।
এইচটিএসের বিবর্তন হয়েছে আল-কায়েদার সিরীয় শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট থেকে। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত হওয়ায় ২০১৬ সালে আল-নুসরা আনুষ্ঠানিকভাবে আল-কায়েদার সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। নিজেদেরকে আল-কায়েদার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং শুধুই সিরিয়ার বিপ্লবের প্রতি নিবেদিত একটি সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সংগঠনটি নিজেদের নাম পরিবর্তন করে জাবহাত ফাতাহ আল-শাম (জেএফএস) হিসেবে নামকরণ করে।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালে জাবহাত ফাতাহ আল-শাম সমমনা আরো কিছু জিহাদী সংগঠনের সাথে একত্রিত হয়ে হাইআত তাহরির আল-শাম নামে একটি কোয়ালিশন গঠন করে। সংগঠনটি যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে আল-কায়েদার সাথে তাদের সম্পর্ক অস্বীকার করে, কিন্তু এদের বর্তমান অনেক নেতাই পূর্বে আল-কায়েদার নেতা ছিল। এমনকি, সংগঠনটির প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি ছিলেন জাবহাত আল-নুসরার প্রধান, যিনি জঙ্গি সংগঠন আইএসের তথাকথিত খিলাফত ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত এর প্রধান আবুবকর আল-বাগদাদীর সহযোগী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
তবে আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে ইদলিবে অবস্থিত অন্যান্য জিহাদী সংগঠন, যারা সরাসরি আল-কায়েদার সাথে যুক্ত, তাদের সাথে এইচটিএসের ছোটখাটো সংঘর্ষ চলে আসছে। এইচটিএসের তুরস্ক-বান্ধব নীতির কারণে আল-কায়েদার নেতারা এর প্রচণ্ড সমালোচনা করে। অন্যদিকে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংগঠন তাদেরকে আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। দীর্ঘদিন এইচটিএসকে আলোচনার মাধ্যমে বিলুপ্ত করে নিজেদের অধীনস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে সম্প্রতি তুরস্কও নতুন করে একে আল-কায়েদার একটি প্রতিরূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ)
ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জাবহাত আল-ওয়াতানিয়াত আল-তাহরির হচ্ছে এ বছরের মে মাসে সংগঠিত ইদলিবে অবস্থিত তুরস্ক সমর্থিত বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর জোট। এর একটি অংশ হচ্ছে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বিভিন্ন ব্রিগেড, যেগুলোর নেতৃত্বে আছে সিরিয়ার সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা সেনা কর্মকর্তারা। কিন্তু এছাড়াও এতে বিভিন্ন ইসলামপন্থী এবং জিহাদী গ্রুপও অন্তর্ভুক্ত আছে। সংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে এদেরকে এইচটিএসের চেয়েও বড় বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এইচটিএসের মতো একক সংগঠন না হওয়ায় এদের সংখ্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া কঠিন।
এনএলএফের নেতৃত্বে আছে সিরিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডের অনুগত সংগঠন ফায়লাক আল-শামের প্রধান ফাদলাল্লাহ আল-হাজি। ফায়লাক আল-শাম ছাড়াও এই কোয়ালিশনে অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলোর মধ্যে আছে আহরার আল-শাম, নুরুদ্দিন আল-জিঙ্কি, জাইশ আল-আহরারসহ বিভিন্ন সংগঠন। এদের মধ্যে কেউ কেউ মধ্যপন্থী হলেও নুরুদ্দিন আল-জিঙ্কির মতো জিহাদী সংগঠনও আছে, যারা এক সময় এইচটিএসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই শিরশ্ছেদসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। অবশ্য সিরিয়াতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সব বাহিনীর বিরুদ্ধেই আছে। সবচেয়ে বেশি আছে আইএস এবং বাশার আল-আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে।
এনএফএলের প্রধান লক্ষ্য এইচটিএসের প্রভাব প্রশমিত করে নিজেদেরকে ইদলিবের প্রধান শক্তিতে পরিণত করা এবং তুরস্কের স্বার্থ রক্ষা করা। আদর্শিকভাবে বিভিন্ন ধরনের কোয়ালিশনটি একত্রিত হয়েছে কেবলমাত্র তুরস্কের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে। তুরস্ক সংগঠনটিকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় এইচটিএসকে বিলুপ্ত হয়ে এনএলএফের সাথে মিশে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল, যদিও এইচটিএস শেষপর্যন্ত তাতে রাজি হয়নি।
তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি (টিআইপি)
তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি তথা টিআইপি মূলত চীনের উইঘুর মুসলমানদের সমন্বয়ে সংগঠিত একটি জিহাদী সংগঠন। তুরস্কের সীমান্ত এবং আসাদ নিয়ন্ত্রিত লাতাকিয়ার অদূরে ইদলিবের জিস্র আল-শুঘুর এলাকাটি এদের নিয়ন্ত্রণে। এদের যোদ্ধাদের সংখ্যা কয়েক হাজার এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে এদের সর্বমোট সংখ্যা প্রায় দশ হাজার বলে ধারণা করা হয়। এরা মূলত আল-কায়েদা তথা এইচটিএসের নীতির অনুসারি হলেও তুরস্কের সাথেও এদের বেশ ভালো সম্পর্ক আছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহীদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে দীর্ঘদিন ধরে এরা ইদলিবে এবং এর আশেপাশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আসছে।
অন্যান্য সংগঠন
এই তিনটি প্রধান কোয়ালিশনের বাইরেও ইদলিবে বিচ্ছিন্নভাবে আরো বেশ কিছু সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হুররাস আল-দিন, যারা এক সময় এইচটিএসের একটি অংশ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে আল-কায়েদার সাথে এইচটিএসের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরা আল-কায়েদার প্রতি অনুগত এবং এইচটিএসকে এরা তুরস্কপন্থী হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে থাকে। এর বাইরেও জাইশ আল-ইজ্জা নামে একটি সংগঠন আছে, যারা এক সময় ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সাথে সম্পর্কিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে সতন্ত্রভাবে যুদ্ধ করছে।
এছাড়াও ইদলিবে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি সৈন্যও যুদ্ধরত আছে, যাদের মধ্যে সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলগুলো, বিশেষ করে চেচনিয়ান যোদ্ধাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। হুররাস আল-দিনের সদস্যদের একটি বড় অংশও মূলত চেচেন যোদ্ধারা, যারা পূর্বে জুনুদ আল-শাম নামক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইদলিবে সরাসরি আইএসের নিয়ন্ত্রণে কোনো এলাকা না থাকলেও সেখানে আইএসের গোপন উপস্থিতি আছে। অন্য সব স্থানের মতোই ইদলিবেও আইএস নিজেদেরকে ছাড়া বাকি সবাইকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করে, ফলে তারা সুযোগ পেলেই এইচটিএস এবং এনএলএফ উভয়ের উপরেই আক্রমণ করে।
সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, তখন অধিকাংশই ছিল সাধারণ জনগণ। সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর সর্বপ্রথম যে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা আত্মপ্রকাশ করে, তারা ছিল বাশারের সেনাবাহিনী থেকেই পদত্যাগ করা সাধারণ সৈন্যরা। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন আদর্শিক গোষ্ঠী এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসা জিহাদীরাও এতে যোগ দিতে থাকে। সময়ের বিবর্তনে মডারেট বিদ্রোহীরা সংখ্যালঘু হয়ে জিহাদীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে কোয়ালিশন।
পরিস্থিতি এমন হয়েছে, কে মডারেট, কে জিহাদী, কে জঙ্গি, বোঝা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্রোহীদের এলাকায় থাকা বেসামরিক জনগণ। জিহাদীদের উপস্থিতির কারণে বাশার আল-আসাদ এবং রাশিয়া বিদ্রোহীদের এলাকায় নির্বিচারে আক্রমণ করার ব্যাপারে কম সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে তাদের পাশাপাশি বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে, নারী-শিশুকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইদলিবে সব মিলিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহীর সংখ্যা ৬০,০০০, কিন্তু এখানে শুধুমাত্র শিশুদের সংখ্যাই প্রায় ১০ লাখ!
আরও পড়ুন:
ইদলিব: রক্তবন্যার আশঙ্কায় ত্রিশ লাখ মানুষ
Featured Image Source: Sky News