সুদূর অতীত থেকেই চীনে শক্তিশালী রাষ্ট্রকাঠামো বিদ্যমান। রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনে প্রবেশের সু্যোগ তুলনামূলকভাবে বেশি পেয়েছে চীনে। চীনের ভৌগলিক চরিত্র আর উর্বর ভূমি শাসকদের কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিকল্প হিসেবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে তুলে ধরেছে শাসনতন্ত্রের লক্ষ্য হিসেবে। তবে, চীনা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবসময়ই নাগরিকদের কথা বলার মাধ্যমে পরিবর্তন আনার শক্তিকে স্বীকার করেছে। এজন্য যখনই চীনে কেউ কথা বলতে চেয়েছে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভিন্নমত দমনের সংস্কৃতি চীনে শুরু হয় ইয়েলো সাম্রাজ্যের সময় থেকে, যখন সম্রাট সকল বই পুড়ে ফেলার নির্দেশ দেন, নির্দেশ দেন বইয়ের সাথে সকল স্কলারকেও পুড়িয়ে ফেলতে। তৃতীয় শতাব্দীর এই সাম্রাজ্যই চীনকে প্রথমবারের মতো একত্রীকরণ শুরু করে। এই রাজবংশের অধীনেই শুরু হয় চীনের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর কুইং সাম্রাজ্য পর্যন্ত একইভাবে দমন করা হয় ভিন্নমত। ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন, নিপীড়ন আর হত্যা করে চীনে টিকে থেকেছে সাম্রাজ্যবাদ।
চিং সাম্রাজ্যের পতন বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়। ১৯০৬ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে এগারোবার বিদ্রোহ হয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯১২ সালে ড. সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে সফল হয় সর্বাত্মক আন্দোলন। হুবেই শহর থেকে শুরু হওয়া উ-চাং বিদ্রোহ শেষমেশ পতন ঘটায় চীনা রাজতন্ত্রের। এর প্রায় তিন যুগ পর চীনা জাতীয়তাবাদীদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্টরা, যাদের নেতৃত্ব দেন মাও সে তুং।
ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে মাও সে তুং পূর্বের সকলকে ছাড়িয়ে যান। তিনি চীনা নাগরিকদের রেজিমের সমালোচনার জন্য আহবান জানাতেন, আলোচনার জন্য আহবান জানাতেন আমলাতন্ত্রের দুর্বলতা আর অক্ষমতার বিষয়ে। আলোচনা আর সমালোচনার পর্ব শেষে গ্রেপ্তার করা হতো চীনা নাগরিকদের, করা হতো নির্যাতন আর অপমান। ফলে বুদ্ধিজীবীরা ইয়েলো সাম্রাজ্যের মতো মাও সে তুংয়ের প্রধান শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। তার আমলে হত্যা করা হয় ছেচল্লিশ হাজার বুদ্ধিজীবীকে, যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, স্কুল ও কলেজ শিক্ষক, লেখক প্রমুখ। মাও সে তুংয়ের গ্রেট কালচারাল রেভল্যুশন চীনকে পরিণত করে ভয়ের দেশ হিসেবে, ছড়িয়ে দেয় ভয়ের সংস্কৃতি।
চীনে মাও সে তুংয়ের পরবর্তী শাসকরাও এই ভয়ের সংস্কৃতির চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। বর্তমানে শি জিন পিংয়ের আমলে নাগরিকদের মধ্যে ভিন্নমত দমনের পাশাপাশি ভিন্নমত দমন করা হচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরেও। দুর্নীতির অভিযোগ ব্যবহার করে অন্তরীণ করা হয়েছে প্রথমসারির বহু রাজনীতিবিদকে, সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে।
চীনের ফোর মডার্নাইজেশন
চীনা অর্থনৈতিক কাঠামো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে আলাদা। চীনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে বাজারকে যেমন ভূমিকা রাখতে দেওয়া হয়, একইভাবে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যাপক নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। চীনা কর্তৃত্ববাদের বৈধতা অর্জনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিয়েছে শুরু থেকেই, অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই আরোপ করেছে বিভিন্ন সংস্কারমূলক নীতিমালা।
চীনের ঐতিহাসিক প্রথার আলোকে সমসাময়িক উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হচ্ছে ফোর মডার্নাইজেশন। মাও সে তুংয়ের আমলে, ১৯৬৪ সালে গৃহীত এই লক্ষ্যে চারটি ক্ষেত্রে আধুনিকায়নের উপর জোরদারের নীতি নেওয়া হয়। এই চারটি খাত হচ্ছে কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা। চীন এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে ২০০০ সাল পর্যন্ত।
ফোর মডার্নাইজেশনের বাইরেও চীন অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে আরো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন: থ্রি স্টেপস, যার মাধ্যমে জিডিপিকে কয়েকটি ধাপে দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির ১৩ তম ন্যাশনাল কংগ্রেসে গৃহীত এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৮০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে। এরপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি টু সেঞ্চুরি গোল নির্ধারণ করেছে, সময়ের সাথে পরিবর্তন এনেছে লক্ষ্যগুলোতে।
ফিফথ মডার্নাইজেশন
ডিসেম্বর, ১৯৭৮; মাও সে তুংয়ের যুগ পেরিয়ে চীনে তখন ক্ষমতায় দেং জিয়াওপিং। চতুর এই রাজনীতিবিদ তখন বিশ্বনেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন, পূর্ববর্তী রেজিমকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করে চীনের অভ্যন্তরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চাইছেন। জনপ্রিয়তা অর্জনের কৌশল হিসেবে বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে কিছুটা উদারীকরণ হয়, নাগরিকদের সীমিত পরিসরে সুযোগ দেওয়া হয় মতপ্রকাশের।
১৯৭৮ সালের ৫ ডিসেম্বর ভোরে, সেই উদারীকরণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফিফথ মডার্নাইজেশনের প্রস্তাবনা উত্থাপন করে ২৯ বছর বয়স্ক উইং জিংশেং। পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান হলেও পড়াশোনা করেছিলেন বেইজিংয়ের সেরা স্কুলে, কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে ছিল তার দুই আত্মীয়। ডেমোক্রেসি ওয়ালে লেখা সেই প্রস্তাবনায় জিংশেং দাবি জানান, ফোর মডার্নাইজেশনের কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ আর প্রতিরক্ষার সাথে চীনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে গণতন্ত্রকে, নিশ্চিত করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র। প্রস্তাবনার নিচে জিংশেং নিজের নাম আর ঠিকানা লিখে রেখেছিলেন।
উইং জিংশেং প্রস্তাবনায় দাবি করেন, চীনাদের ভাগ্যরা নির্ধারণ করবে চীনারাই। চীনাদের কোনো ঈশ্বর আর সম্রাটের প্রয়োজন নেই ভাগ্য নির্ধারণের জন্য। চীনের আধুনিকায়ন কেবলমাত্র গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমেই সম্ভব, সম্ভব নাগরিকদেরে মুক্তির মাধ্যমে। গত তিন দশক ধরে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগাণ্ডার মাধ্যমে কবিতা তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে সুমধুর সংগীত, যেগুলো চীনাদের চোখে পানি নিয়ে আসে। কিন্তু, আমরা যখনই গণতন্ত্র চাই, শাসকরা তখন একতা আর সামষ্টিক সমৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু, নাগরিকদের নৈতিক অধিকার যে গণতন্ত্র, সেটি দেয় না।
উইং জিংশেং চীনা নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন,
আমার প্রিয় কমরেডবৃন্দ, স্বৈরাচারী শাসকদের স্থিতিশীলতা আর একতার কথা শুনবেন না, বরং গণতন্ত্রের দাবিতে একতাবদ্ধ হোন। সর্বাত্মকবাদী ফ্যাসিস্ট শাসকেরা কেবলমাত্র ধ্বংসই নিয়ে আসে। আমার কোনো সন্দেহ নেই, গণতন্ত্রই আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি না তুললে, আমাদের আবারো দুর্ভাগ্য আসবে। আমাদের নিজেদের শক্তিতে বিশ্বাস রাখতে হবে, মানবজাতির ইতিহাস আমাদের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে। নিজস্ব ঘরানার নেতা আর শিক্ষকেরা আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে এবং তাদের বিদায় করা উচিত।
চীনা শাসকেরা তাদের বই এবং বুদ্ধিজীবী পুড়িয়ে ফেলার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, উইং জিংশেংকে ফিফথ মডার্নাইজেশনের প্রস্তাবনা উত্থাপনের জন্য পনেরো বছরের জেল দেওয়া হয়। তবে, ফিফথ মডার্নাইজেশনের প্রস্তাবনা দ্রুতই ছড়িয়ে যায় বেইজিংয়ের অলিগলিতে, মনোযোগ কাড়ে চীনের বাইরেও। এক দশক পরে, ডেমোক্রেসি ওয়ালের খুব কাছেই তিয়েন আনমেন স্কয়ারে সংস্কারের দাবিতে একত্রিত হয় হাজারো চীনা শিক্ষার্থী।
বর্তমান চীনে গণতন্ত্র
২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র যখন সামিট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজন করছে, কাছাকাছি সময়ে চীন আয়োজন করে অ্যাডভান্সড ডেমোক্রেসি সামিট। চীনের আয়োজিত অ্যাডভান্স ডেমোক্রেটিক সামিটে যুক্ত হন চীনের রাজনৈতিক নেতারা, চীনা ক্ষমতাবলয়ের সাথে বিভিন্নভাবে সংযুক্ত বুদ্ধিজীবীরা। এই সামিট থেকে দাবি করা হয়, কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে চীন পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে অনেক কার্যকর গণতন্ত্র উপভোগ করছে।
পশ্চিমা বিশ্বে রয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, চীন চর্চা করে কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসি। কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসিতে নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ নেই; সুযোগ নেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার চর্চার। বরং, কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসি প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণকারীদের সাড়া আর মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে পলিসি তৈরি করা হয়, প্রয়োজনে পলিসি পরিবর্তন করা হয়।
কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসিকে একটি কার্যকর কাঠামোতে রূপান্তরের চেষ্টায় চালু হয় ‘মেয়র মেইলবক্স’, যার মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন, সরকারি সার্ভিসের ব্যাপারে মূল্যায়ন জানাতে পারেন, জানাতে পারেন পরামর্শও। সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণত অভিযোগের প্রত্যুত্তর দেন, যেখানে ৪৩ শতাংশ চীনা নাগরিক এই সার্ভিসের ব্যাপারে সন্তুষ্ট।
কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসিতে সিভিল সোসাইটিকেও ভূমিকা রাখতে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবী সংগঠন, চ্যারিটি ফান্ড আর এনজিওগুলো সরকারের পলিসি তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সরকারের পলিসিকে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক ও মানানসই করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। এনজিওগুলো সাধারণত নাগরিক ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের কাজ করে, সরকারের পলিসির দুর্বলতা ও ব্যর্থতাগুলো এই প্রক্রিয়ায় সংশোধন হয়, জবাবদিহিতার আওতায় আসেন সরকারি কর্মকর্তারা।
তবে, কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী কাঠামো না, এটি পুরোপুরি নির্ভর করে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব নাগরিকদের ঠিক কতটুকু প্রভাব নীতি নির্ধারণে গ্রহণ করতে আগ্রহী, তার উপর। সরকারি মিডিয়া আর সরকারি কর্মকর্তাদের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে কনসাল্টেটিভ ডেমোক্রেসির কার্যকারিতা। কোভিড-১৯ ছড়িয়ে যাওয়ার সময় যেভাবে আমলাতন্ত্র বিষয়টিকে চেপে যেতে চেয়েছে, একইভাবে অনেক ইস্যুই আমলাতন্ত্র আড়াল করে রাখে, আড়ালে সহযোগিতা করে রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলো।