যে যাই বলুক, উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব এবং আধিপত্য অস্বীকার করার জো নেই। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দেশটি মহাদেশ ছাপিয়ে পুরো বিশ্বে একটি শক্তিশালী পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। প্রতিবেশি দেশ এবং বাণিজ্যের এক বড় অংশীদার হওয়ার দরুণ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের রাজনৈতিক ও আভ্যন্তরীণ দোলাচলগুলো খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এ আগ্রহ শুধু আমলা পর্যায়েই নয় নাগরিক পর্যায়েও খুব কড়াভাবে লক্ষ করা যায়।
২০১৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (প্রথম মেয়াদকালীন) নরেন্দ্র মোদী স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ঘোষণা করেন- স্থল, জল এবং বায়ুসেনাদের মধ্যে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এমন একটি পদ সৃষ্টি করা হবে যার আধিকারিক হবেন সরকারের মুখ্য সামরিক শলাকার। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় পদটি এবং পদের আধিকারিকের ব্যাপারে দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নবসৃষ্ট পদটির নামকরণ করা হয় ‘চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ’ বা Chief of Defence Staff সংক্ষেপে CDS।
স্থল বা সেনাবাহিনীর প্রধানকে বলা হয় চিফ অব আর্মি স্টাফ, জল বা নৌবাহিনীর প্রধানকে বলা হয় চিফ অব নেভাল স্টাফ এবং বায়ু বা বিমানবাহিনীর প্রধানকে বলা হয় চিফ অব এয়ার স্টাফ। সিডিএস সৃষ্টির আগে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে একটি কমিটি করা হতো যার নাম ছিল চিফস অব স্টাফ কমিটি। তিন বাহিনীর প্রধানগণের মধ্য থেকে প্রবীণতম অফিসারকে কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হতো। মূলত, এ কমিটিই তিন বাহিনীর ভেতর সমন্বয়ের কাজটি করত।
স্বাধীনতার পরে গঠিত চিফস অব স্টাফ কমিটির মাধ্যমে সমন্বয় সাধন ছিল ব্যাপক সময়সাপেক্ষ এবং কমিটি তিন বাহিনীর কমরেডশিপে জোরদার কোনো উন্নতি সাধন করতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পরে ভারত যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সবগুলোতেই অন্তঃবাহিনী সমন্বয়ের অভাব লক্ষণীয় ছিল। কারগিলে এটি আরো ভয়ংকরভাবে চোখে পড়ে সরকারের।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্র থেকে কে সুব্রহ্মণ্যমকে চেয়ারম্যান করে কারগিল রিভিউ কমিটি (KRC) গঠন করা হয়। কমিটি তার রিপোর্টে একটি সিঙ্গেল পয়েন্ট পেশাদার সামরিক পদ সৃষ্টি করতে সুপারিশ করে যিনি নিযুক্ত হবেন সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে এবং তার ওপর দ্বায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামরিক ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার। তারপর সিডিএস তৈরির ব্যাপারে সবরকম আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। তৎকালীন নৌবাহিনীর প্রধানকে মনোনীতও করা হয়। কিন্তু শেষ জল ঘোলা হয়ে যায়। অন্য দুই বাহিনী প্রধানগণ বেঁকে বসেন। সামরিক অফিসারদের ভেতরেও ক্ষোভ দানা বাঁধে। চেইন অব কমান্ড এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এসব কারণে সরকার সেবারের মতো সিডিএস গঠনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
২০১৬ সালে জেনারেল শেখাওয়াতের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি করা হয়। কমিটিকে সিডিএস পদের প্রয়োজনীয়তা এবং পদ সৃষ্টির ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পেশ করার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। শেখাওয়াতের কমিটিও সিডিএস গঠনের পক্ষে মত দেয়। সিডিএস গঠন চূড়ান্ত হয়ে গেলে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে এ ব্যাপারে ২০১৯ এর শেষের দিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি করা হয়। দোভালের ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি যাচাই বাছাইয়ের পরে চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াতের নাম পেশ করে। বিপিন রাওয়াত তিন বাহিনী প্রধানের ভেতর ছিলেন সবচেয়ে প্রবীণ এবং স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান। বিপিন রাওয়াত নিযুক্ত হন ভারতের প্রথম সিডিএস হিসেবে। আরেকটি নিয়ম করা হয়– সিডিএসই হবেন চিফস অব স্টাফ কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান।
বিপিন রাওয়াত ১৯৭৮ সাল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সার্ভিস প্রদান শুরু করেন। ৫/১১ গোর্খা রাইফেলস থেকে উঠে আসা এ অফিসারকে সরকার ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিন বছর মেয়াদে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে। ২০১৯ এর ২৭ সেপ্টেম্বর চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় তাকে। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর নেন এবং পরের দিন ২০২০ এর ১ জানুয়ারি চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদে নিযুক্ত হন। বিপিন রাওয়াতের বাবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল লক্ষ্মণ সিং রাওয়াতও ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা।
বিপিন রাওয়াতকে সিডিএস হিসেবে নিযুক্ত করার পরে দেশ-বিদেশ থেকে সংবর্ধনাসূচক বার্তা প্রেরণ ও প্রকাশ করা হয়। বিরোদী দল কংগ্রেস সিডিএস পদ সৃষ্টিকে শুভকর হিসেবে দেখলেও সেখানে সদ্যসাবেক সেনাপ্রধানের অধিষ্ঠানকে খুব ভালোভাবে দেখেনি। তারা এ পদে রাজনীতিকরণের অভিযোগ তুলেছিল। কংগ্রেস দলীয় পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিং বিপিন রাওয়াত অফিসে বসার আগেই টুইটারে তাকে অভিনন্দন জানান। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট এবং ব্রিটিশ দূতাবাস থেকেও অভিনন্দন বার্তা পাঠানো হয়।
চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদটির পদমর্যাদা, বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন বাহিনীর প্রধানের সমানই কিন্তু পদটিকে বিশেষায়িত করা হয়েছে ‘ফার্স্ট অ্যামং অল’ (first among all) হিসেবে। অর্থাৎ, তিন বাহিনী প্রধান এবং সিডিএস কাজ করবেন এক পদমর্যাদায় কলিগ হিসেবে কিন্তু সিডিএস থাকবেন তালিকায় সবার উপরে। আমাদের দেশের সচিব এবং সিনিয়র সচিবের মতো অনেকটা!
বাহিনী প্রধানগণ স্ব স্ব ক্ষেত্রের ব্যাপারে সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন এবং কমান্ডিং ক্ষমতাও থাকবে তাদের হাতে। সিডিএস শুধু সমন্বয়ের কাজটি করবেন। সিডিএসের র্যাংক ব্যাজ এবং পতাকার প্রতীক বানানো হয়েছে তিন বাহিনীর প্রতীকের সমন্বয়ে। সিডিএসের ইউনিফর্ম হবে যে বাহিনী থেকে তিনি আসবেন সে বাহিনীরই ইউনিফর্ম। অর্ডার অব প্রেসিডেন্স বা পদমর্যাদার ক্রমে সিডিএস এর অবস্থান হবে ১১ এর ‘এ’ (11A) তে। ১১ নম্বরে আছে লেফটেন্যান্ট গভর্নরগণ, অ্যাটর্নি জেনারেল, এবং ক্যাবিনেট সেক্রেটারি। আর ১২ নম্বরে আছেন তিন বাহিনীর প্রধানগণ। ১১ ও ১২ এর মাঝে ১১ এর ‘এ’ তে স্থান দেওয়া হয়েছে সিডিএসকে।
অজিত দোভালের ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি সিডিএস পদে অবস্থানের মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছে। ভারতে বাহিনী প্রধানদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর। সে হিসেবে সিডিএসের অবসরের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ বছর অথবা তিন বছর সিডিএস পদে অধিষ্ঠান যেটি আগে আসবে। পঁয়ষট্টি উর্ধ্ব কাউকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ডিপার্টমেন্ট অব মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স নামক একটি নতুন শাখা সৃষ্টি করে সেটিকে সিডিএস এর অধীনস্ত করেছে। সিডিএসকে সহায়তার জন্য ভাইস চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদও সৃষ্টি করা হয়েছে। নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল আর. হরি কুমারকে প্রথম ভাইস সিডিএস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।
সিডিএস এর হাতে কোনো সামরিক কমান্ড না থাকলেও তিনি তিন বাহিনীর ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি প্রতিরক্ষা ক্রয় পরিষদ এবং প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা কমিটির সদস্য। তিন বাহিনীর সাজ-সরঞ্জাম ক্রয় থেকে শুধু করে ব্যবহার তার মাধ্যমে অনুমোদিত হবে। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় সংকোচন এবং প্রতিরক্ষা উপাদানের যথোপযুক্ত ব্যবহারের ভার তার কাঁধে ন্যস্ত। তিন বাহিনীর যৌথ মঞ্চ বা ট্রাই সার্ভিস অর্গানাইজেশনের প্রশাসনিক প্রধান সিডিএস।
মঞ্চে সামরিক কমান্ড বাহিনীগুলোর ভেতর বিন্যস্ত করে দেওয়া হলেও সাইবার এবং মহাকাশ কমান্ডের পুরো দ্বায়িত্ব থাকবে সিডিএসের ওপর। অভিযানের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, পরিবহন, সহায়তা সব বিষয়ে তিন বাহিনীর ভেতর লিঁয়াজো করবেন সিডিএস। বাহিনীগুলোর অবকাঠামো এবং পরিকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরিকৃত পণ্যের ব্যবহারে জোড় দেবেন সিডিএস। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিকল্পনার মূল্যায়ন করবেন। জরুরি অবস্থায় তৈরিকৃত পরিকল্পনার মূল্যায়ন করবেন। বাহিনীগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংস্কার কর্মসূচির পরিকল্পনা করবেন। তিন বাহিনীর ভেতর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবেন এবং মন্ত্রক বরাবর প্রতি বছর তিন বাহিনীর যৌথ কার্যকলাপের ব্যাপারে রিপোর্ট পেশ করবেন।
দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর ভাষণে জেনারেল রাওয়াত বলেন আগামী তিন বছরের ভেতরে ভারতকে একটি একক সমন্বিত মিলিটারি কমান্ডের আওতায় আনা হবে যার ফলে সামরিক ব্যাপারগুলোতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অনেকাংশে অবসান হবে। রাওয়াতের প্রথম উদ্যোগ ছিল একটি সমন্বিত এয়ার ডিফেন্স কমান্ড গঠন। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ইকুয়েপমেন্ট এবং জনবল ব্যবহার করে তৈরি করা এয়ার ডিফেন্স কমান্ডের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এয়ারফোর্সের একজন তিন তারকা অফিসারকে।
চীনের সাথে সমঝোতা আলোচনার ব্যাপারে রাওয়াত একবার মন্তব্য করেন, ‘আলোচনায় কাজ না হলে মিলিটারি অ্যাকশন তো আছেই’- যা দুই দেশেই আলোচনার ঝড় তোলে। ভারত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ার পর থেকেই প্রতিরক্ষা বিভাগ ঢেলে সাজানোর আয়োজন শুরু করে। P5+1 (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানি) দেশগুলোর সামরিক বাহিনীর কায়দায় সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করা হয়। উল্লেখিত দেশগুলোতে সিডিএস বা সমজাতীয় পদ রয়েছে যা তাদের সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এবার ভারতও সে পথে হাঁটলো।