কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অস্ত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। হবসিয়ান প্রকৃতির রাজ্য থেকে যখন সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র তৈরি হলো, এরপর থেকে সংঘাত তৈরির ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় রাষ্ট্রের কাছে। ফলে, রাষ্ট্রের সকল সম্পদের পাশাপাশি অস্ত্রের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকায়, সংঘাত তৈরি মনোপলি অর্জন করে রাষ্ট্র। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সম্পদ আর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিনিয়ত দায়িত্ব নিতে হয়েছে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র থাকা নিয়ে। এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ সংযোজনগুলোর একটি ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেট।
অস্ত্রের বাজারে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া আর চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে ফিফথ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান বিক্রি নিয়ে। এই প্রতিযোগিতার বাণিজ্যিক দিক আছে, আছে বৈশ্বিক নিরাপত্তার ধারণাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নও।
যেহেতু নিরাপত্তার ধারণা এখন আগের মতো নিরঙ্কুশভাবে একক রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে না, রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন, সেই জায়গা থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অস্ত্রের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি মিত্র দেশগুলোকে বিক্রি করেও নিজেদের নিরাপত্তার ধারণাটি অর্জন করতে চায়। বিভিন্ন সময়ে এর সাথে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন, কখনো যুক্ত হয় মিত্রতার প্রশ্নও। কখনো হয় সমঝোতা চুক্তি, হয় সহযোগিতা চুক্তি কিংবা প্রযুক্তি আদান প্রদানের চুক্তি। এই নিয়ে শক্তিশালী আর উদ্ভাবনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলে নিরন্তর প্রতিযোগিতা। একই ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে ফিফথ জেনারেশন ফাইটার প্লেনের বিক্রি নিয়েও।
বর্তমান সময়ে ফিফথ জেনারেশন ফাইটার জেটগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক চাহিদা আছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের, প্রতিযোগিতায় আছে চীনের জে-২০ আর এফসি-৩১ যুদ্ধবিমান। অস্ত্র বিক্রির এই প্রতিযোগিতায় রাশিয়া যুক্ত হয়েছে দুটি পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নিয়ে। সু-৫৭ আর সু-৭৫। এই যুদ্ধবিমানগুলোর বৈশ্বিক চাহিদা আছে, আছে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের চেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা। পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলোর শত্রু দেশের রাউটারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম, গ্রাউন্ড স্টেশনের পাশাপাশি আকাশে বিদ্যমান মিত্র যুদ্ধবিমানগুলোর সাথে ভালো নেটওয়ার্কিং করতে পারে, সহজে ডাটা সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে।
প্রতিযোগিতায় চীনের প্রবেশ
পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলোর প্রায় সবই নিজেদের প্রতিরক্ষা মডেল অনুযায়ী বানাচ্ছে প্রস্তুতকারক দেশগুলো। চীনের প্রচেষ্টা আছে গ্রাউন্ড বেইজড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সাথে দূরপাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম স্ট্র্যাটেজির মিশ্রণ ঘটানোর। সাম্প্রতিক সময়ে চীন বেশ কয়েকবার বিবাদে জড়িয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে একটা দীর্ঘ সময় ধরেই দ্বন্দ্ব চলছে পরাশক্তিগুলোর সাথে, সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ আছে জাপানের সাথেও। তাইওয়ান একটা বড় জাতীয়তাবাদী ইস্যু হয়ে উঠেছে চীনের ক্ষেত্রে। ফলে, চীন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিচ্ছে আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বনের প্রস্তুতি। ভূমিতে অবকাঠামো আর দুর্গ বানানো হচ্ছে রক্ষণাত্মক প্রতিরক্ষামূলক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে। এই স্ট্র্যাটিজির অংশ হিসেবেই চীন ভূমি থেকে আকাশ প্রতিরক্ষাকে প্রাধান্য দেয়, তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব দেয় আকাশ থেকে আকাশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে।
চীনের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান জে-২০ তৈরি হয়েছে চীনের দেশীয় ইঞ্জিন দিয়ে, এই যুদ্ধবিমানের প্রথম প্রদর্শন হয় দক্ষিণ চীনের ঝুহাই শহরে, ২০২১ সালের চায়না এয়ার শো’তে। প্রতিযোগিতার বাজারে এই যুদ্ধবিমানটিও চীনকে প্রতিনিধিত্ব করবে।
চীনের সর্বশেষ প্রযুক্তির বিমান জে-২০ স্টেলথ ফাইটার জেটে এই স্ট্র্যাটিজির প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। প্রস্তুতকারকদের দাবি অনুসারে, জে-২০ স্টেলথ ফাইটার জেট লম্বা দূরত্বের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যেটি জটিল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে শত্রুর ঘাটিতে আঘাত হেনে আবার চীনের আকাশ সীমায় ফিরে আসতে পারবে।
চীনের অস্ত্রের বাজার বেশ সীমিত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার আর উত্তর কোরিয়া চীনের অস্ত্রের নিয়মিত গ্রাহক। এর বাইরে আফ্রিকার কিছু দেশ চীন থেকে স্বল্পমূল্যের অস্ত্র আমদানি করে। চীনের যুদ্ধবিমান বিক্রির সময়েও একই প্রবণতা দেখা গেছে, নির্দিষ্ট গ্রাহক রাষ্ট্রগুলোর বাইরে চীনের যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহ তেমন কেউ দেখায়নি। চীন যদিও এফসি-৩১ যুদ্ধবিমান বিক্রির মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতায় অবস্থান নিশ্চিত করতে চাচ্ছে, অল্প কয়েকটি গ্রাহক রাষ্ট্রের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে এই বাজারে চীনের টিকে থাকা দুষ্কর হবে।
পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বিক্রির বাজারে রাশিয়ার সংগ্রাম
পঞ্চম প্রজন্মের অস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতায় রাশিয়া যুক্ত হয় সু-৫৭ আর সু-৭৫ নিয়ে। তবে, রাশিয়া ইতোমধ্যেই সু-৫৭ বিক্রির ধারণা ত্যাগ করেছে, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে চাচ্ছে তুলনামূলক আধুনিক ও বেশি প্রযুক্তিগত সুবিধা সম্পন্ন সু-৭৫ দিয়ে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে রাশিয়ার যে সু-৫৭ বিক্রির চুক্তি হয়েছিলো, সেটিও বর্তমানে সংশোধন করে চলছে যৌথভাবে সু-৭৫ তৈরির আলোচনা।
রাশিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তিন পর্যায়ের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যুহ ব্যবহার করে। আকাশ প্রতিরক্ষায় রাশিয়া ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপ যোগ্য মিসাইল ব্যবহার করে, দীর্ঘ এবং মাঝারি পাল্লার ব্যাটারিগুলো উচ্চ এবং মাঝারি উচ্চতায় কাজ করে। পাশাপাশি, মিসাইল সিস্টেমগুলো নিজেরাই বন্দুক বা ক্ষেপণাস্ত্র-ভিত্তিক স্বল্প-পাল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত থাকে।
রাশিয়ার পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলো বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একত্রিত নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে, আকাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে চাওয়া শত্রু দেশের যুদ্ধবিমানগুলোকে ধ্বংস করে।
পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য
যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯২ সালে। প্রজেক্টের শুরুতে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানকে ভাবা হচ্ছিল আকাশ প্রতিরক্ষায় সকল সমস্যার সমাধান হিসেবে, যেটি বিমানবাহিনী তাদের নিয়মিত কাজে ব্যবহার করতে পারবে, ব্যবহার করতে পারবে নেভি আর মেরিনরাও। মার্কিন প্রতিরক্ষা নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্য ছিল, এফ-৩৫ এর মাধ্যমে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে প্রতিস্থাপন করা। তিন দশক পরে, এফ-৩৫ নিশ্চিতভাবেই এই প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে। এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের প্রতি ঘন্টায় খরচ যেখানে ছিল ২২ হাজার মার্কিন ডলার, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের প্রতি ঘন্টায় খরচ ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার। একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের প্রতিটির পিছনে খরচ হবে ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার, পুরো সার্ভিস লাইফ সেবা পেতে হলে।
সিনেটে এই বিশাল ব্যয় নিয়ে বেশ কয়েকজন সিনেটর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও, তুলনামূলকভাবে, পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বিক্রিতে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সাফল্যের সাথে বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। বর্তমানে ১৪টি দেশ এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে আরো ১০টি দেশ যুক্ত আছে এই যুদ্ধবিমান তৈরিতে। এফ-৩৫ এর তিনটি ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে। এফ-৩৫ এ রানওয়েতে ব্যবহার উপযোগী যুদ্ধবিমান, এফ-৩৫ বি অল্প জায়গা থেকে টেক অফ করার সক্ষমতা সম্পন্ন যুদ্ধবিমান, এফ-৩৫ সি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ব্যবহার উপযোগী যুদ্ধবিমান। এই ভিন্নতাগুলো এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানকে বৈচিত্র্যময় মাত্রা দিয়েছে, তুঙ্গে তুলেছে এই যুদ্ধবিমানের চাহিদাকে।
ফিফথ জেনারেশনের প্রায় সকল যুদ্ধবিমানই নিজেদের প্রতিরক্ষা মডেল অনুযায়ী বানাচ্ছে প্রস্তুতকারক দেশগুলো। রাশিয়া আর চীনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে গ্রাউন্ড-বেইজড এয়ার ডিফেন্স। যুদ্ধবিমানগুলো নিজস্ব এয়ার ডিফেন্সের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানগুলোর মূল লক্ষ্য লম্বা দূরত্বে আঘাত হানতে পারার সক্ষমতা আর সুরক্ষিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে শত্রুর ঘাঁটিতে হামলা করে আসা।
মার্কিন ডকট্রিনে যৌথ অল-ডোমেইন অপারেশনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যুদ্ধবিমানগুলোকে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করার প্রস্তুতি রাখতে হয়। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানগুলোকে স্বল্প সময়ে নোটিশের মধ্যে দীর্ঘ পরিসরে কাজ করার জন্য টেকসই করে তৈরি করা হয়, শত্রুর কেন্দ্রে দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগাতে হয়।
পাশাপাশি, মার্কিন ডকট্রিনে বিমান বাহিনীর সক্ষমতা অপারেশনের নিয়ন্ত্রণকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে কাজ করে, সকল ধরনের সামরিক শক্তি একটি ডকট্রিনে একত্রিত করা থাকে এবং অনেকগুলো ডোমেইনের মধ্যেও নিবিড় যোগাযোগ থাকে।
মার্কিন ডকট্রিনগুলোর অবকাঠামো এবং সজ্জা বলে দেয়, মার্কিন প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্র জুড়ে রয়েছে একটি ডকট্রিন থেকে যেন বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় এবং প্রতিরক্ষা কাঠামো থেকে সর্বোচ্চ সেবা পাওয়া যায়। এই নীতির কথা মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট এনেছে।
যদিও অনেক বিশ্লেষকের মতে, এফ-৩৫ এর ভ্যারিয়েন্ট আনার মাধ্যমে আসলে এফ-৩৫ এর বিশেষায়িত ভূমিকা তৈরির পথকে বাধাগ্রস্ত করেছে, এফ-৩৫ এর সেরা পারফরম্যান্স পাওয়া অনেকটাই অন্যান্য প্রভাবকের উপর নির্ভরশীল করে ফেলেছে।
কোন ধরনের যুদ্ধবিমান কিনবে রাষ্ট্রগুলো?
যুদ্ধবিমান কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সমীকরণ কাজ করে, কাজ করে রাজনৈতিক বৈধতা আর আনুগত্যের প্রশ্নও। আবার দেশভিত্তিক ডকট্রিন কিংবা প্রযুক্তিগত চাহিদাও অনেকসময় যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখে। যেসব ক্রেতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান কেনার জন্য আগ্রহী, তাদের প্রতিরক্ষা বাজেটের সাথে সমন্বয়ের পাশাপাশি অবশ্যই উচিত হবে যুদ্ধবিমান কেনার আগে নিজেদের প্রতিরক্ষা কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কাঙ্ক্ষিত প্রযুক্তিগুলো যুদ্ধবিমানে আছে কিনা তা যাচাই করা এবং টেকনিক্যাল স্পেশালাইজেশনের সাথে সেই যুদ্ধবিমান সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, সেটি বিবেচনা করা।