বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন কী হয়েছে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে উত্তরে কী আশা করা যেতে পারে? ক্ষমতার রাজনীতি তো চিরকালই ছিল, আজও আছে, তা পণ্ডিতবর্গ তাকে যে তাত্ত্বিক নামেই ডাকুন না কেন। হান্স মর্গ্যান্থাউ-এর ‘রিয়ালিজম’ বা কেনেথ ওয়াল্টজ-এর ‘নিও-রিয়ালিজম’, যা-ই হোক না কেন, ক্ষমতার অনুসরণই আন্তর্জাতিক রাজনীতির শেষ কথা সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এই মৌলিক প্রবণতাটি এক থাকলেও অতীতের বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বা পরে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তুলনায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চরিত্রগত কিছু বদল যে ঘটেনি, তা অস্বীকার করা যায় না। আর এখানেই নিহিত রয়েছে প্রথমেই তোলা প্রশ্নের উত্তরটি: এখনকার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন কী হয়েছে।
গণতন্ত্র কি তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে?
উপনিবেশ যুগের অবসান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বজুড়ে প্রচুর রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে এবং উন্নতিশীল এই দেশগুলোর বেশিরভাগই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়। যদিও মুখ থুবড়েও পরে অনেক দেশ, যেখানে গণতন্ত্র ‘বে-লাইন’ হয়ে গিয়ে একনায়কতন্ত্র বা সামরিক শাসন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সার্বিকভাবে, পশ্চিম বিশ্বের গণতান্ত্রিক মডেল দ্বারাই উজ্জীবিত বোধ করে বেশিরভাগ দেশ। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যবস্থা গ্রহণে অনেক দেশ আগ্রহী হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা ফলপ্রসূ হয় না। আজও কয়েকটি দেশ নাম সমাজতান্ত্রিক হলেও তারা যে ভেতরে ভেতরে ধনতন্ত্রকে অস্বীকার করতে পারে না যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই, সে কথা উপেক্ষা করার নয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাই হয়ে ওঠে বাকি পৃথিবীর সামনে আদর্শ। গণতন্ত্রকেই ধরে নেওয়া হয় রাজনীতির শেষ অবস্থা এবং যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দায়িত্বজ্ঞান এক বড় ব্যাপার, তাই যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, প্রভাব বা স্বার্থ অন্বেষণের জন্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা ক্ষমতার ভারসাম্যই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে গণতন্ত্র-উদারবাদ-কেন্দ্রিক আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পূজারী হয়ে ওঠে সারা বিশ্বের তামাম রাষ্ট্র ও জাতি, তার অবশ্যই কিছু সমালোচকও ছিল। কিন্তু মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পশ্চিমই এই লড়াইতে শেষ হাসি হেসেছে; ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি’ আদতে ধনতন্ত্র-বিরোধীদের সমাধি। ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সাদা-কালো আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোর চরিত্রে বদল ঘটে যায় বড়সড়। তার পরের এক দশক একমুখী বিষয় ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তি হিসেবে ছড়ি ঘুরিয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কের জঙ্গি হানার পর সমস্ত হিসেবে নিকেশই বদলে যায়। সোভিয়েত দেশের বদলে ওয়াশিংটনের কর্তাদের প্রধান বৈরী হয়ে দাঁড়ায় জঙ্গিরা। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের চিরাচরিত লড়াইয়ের ধারণা বদলে গিয়ে দেখা দেয় রাষ্ট্রের সঙ্গে অ-রাষ্ট্রীয় সংগঠনের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষণকারী রাষ্ট্রের সংঘর্ষ। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সামনাসামনি সংঘাতের থেকে যা অনেকাংশেই বেশি জটিল, কারণ এখানে সাদা-কালোর মধ্যে কোনো বিভেদরেখা নেই, পুরোটাই ধূসর। নিউ ইয়র্কের বিধ্বংসী হানার পরে মরিয়া হয়ে আমেরিকা আক্রমণ চালায় আফগানিস্তানের উপরে, লক্ষ্য ছিল বোমা ফেলেই সেখানে গুহায় থাকা উগ্রপন্থীদের সর্দার ওসামা বিন লাদেনকে খতম করা। লাদেন খতম হয়, কিন্তু ৯/১১-র এক দশক পরে, আফগানিস্তানে নয়, পাকিস্তানে। আর আফগানিস্তানের মাটিতে ডাকা যুদ্ধের পাঁকে আরও বেশি করে বসে যেতে থাকে মার্কিন রণরথ। আজ প্রায় দুই দশক হতে চলল কিন্তু আফগানিস্তান থেকে বেরোনোর রাস্তা মার্কিন নীতিবিদরা খুঁজে পেলেন না।
একই সমস্যা ইরাকেও। আর এই সকল চিরকালীন যুদ্ধে জর্জরিত হয়ে পরে, কোটি কোটি টাকার লোকসানের সম্মুখীন হয়ে আজ মার্কিন বিদেশনীতিতে এক নৈতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতীতে বারাক ওবামা এবং বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্প- চামড়ার রঙের তারতম্য থাকলেও এই দুজন রাষ্ট্রপতির শাসনকালে ওয়াশিংটনের ‘ঘরে ফেরা’ নীতির মধ্যে বিশেষ কিছু ফারাক নেই। পণ্ডিতরা যাকে বলছেন ‘দ্য গ্রেট আমেরিকান রিট্রিট’, তা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পশ্চাদপসরণ আদতে তৈরি করছে এক সত্যিকারের বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে গণতন্ত্রেরই শেষপর্যন্ত জিৎ হয়েছে, সেকথা বলা চলে না।
আজকের ‘গণতন্ত্র’গুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার আখড়া
আজকে পশ্চিম বিশ্বের তাবৎ গণতন্ত্রগুলোর প্রায় সবক’টিই এক সঙ্কটের মুখোমুখি। এই সঙ্কটকে ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ নয়, কারণ এতে জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক নানাবিধ কারণ। গণতন্ত্র যেহেতু মানুষের হিতসাধনে তৈরি এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে দায়িত্বজ্ঞানের এক বড় প্রশ্ন এসে পড়ে, সেখানে রাষ্ট্রের কাঁধে যেমন একদিকে মানুষের ও সমাজের দেখাশোনা করার এক গুরুদায়িত্ব রয়েছে, অন্যদিকে আছে সন্ত্রাস, অর্থনৈতিক বিপদ ইত্যাদি থেকে মানুষকে রক্ষা করার সমগুরুত্বের দায়িত্বও। আর এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়ে আজকের গণতান্ত্রিক সরকারকে হয়ে উঠতে হচ্ছে মানবিকতা-বিমুখ। উদারবাদী ওয়েলফেয়ার স্টেট-এর ধারণা আজকের দিনে এগিয়ে নিয়ে চলা যে বেশ কঠিন কাজ, তা হারে হারে টের পাচ্ছেন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব যেমন জার্মানির আঙ্গেলা মার্কেল। আর সন্ত্রাসবাদ, বিশ্বমন্দা ইত্যাদি নানা কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোও নিজেদের অজান্তেই হয়ে উঠছে কট্টরপন্থী (ট্রাম্প, ব্রেক্সিট যার উদাহরণ) যা সার্বিকভাবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথকেই সংকুচিত করছে; উঠে আসছে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা অন্যান্য চূড়ান্ত-ডানপন্থী দেশনেতারা, যারা নির্বাচিত হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখে তাদের অনির্বাচিত স্বৈরাচারী শাসকদের থেকে আলাদা করার বিশেষ উপায় থাকছে না। তাই, একদিকে বিশ্বের বহুমুখী ব্যবস্থার প্রসার আর অন্যদিকে সেই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মানসিকতার সংকোচন, এই বৈপরীত্য সমকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আজ অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। কোনও সাবেকি তত্ত্ব দিয়ে এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কিনা, তা বলা কঠিন।
হাসি ফুটেছে একনায়কদের; যাদের মতে গণতন্ত্র গুরুত্বহীন
তবে এই পরিস্থিতিতে মুখে হাসি ফুটেছে সেই সমস্ত নেতাদের, যাদেরকে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আন্তর্জাতিক দুনিয়া কোনোদিনই ভক্তির নজরে দেখত না, অর্থাৎ একনায়ক যারা। এদের মধ্যে প্রধান নাম দুটি হল চীনের শি জিনপিং এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন। একদিকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত হাত গুটিয়ে নিচ্ছে বিশ্ব সংসার থেকে, মনোনিবেশ করছে শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থের উপর, দরকার পড়লে ছেড়ে কথা বলছে না নিজের সাবেকি বন্ধুদেরও, তখন চীন ও রাশিয়ার মতো দুটি বড় উচ্চাকাঙ্খী শক্তির সামনে দুনিয়া জুড়ে দাপট দেখানোর পথ আরও চওড়া হয়েছে। কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, ভূকৌশলগত বা অর্থনৈতিক, এই সমস্ত নিরিখেই চীন এবং রাশিয়া আজ ওয়াশিংটনের তৈরি করা শূন্যতাকে কাজে লাগাতে প্রবল উদ্যম দেখাচ্ছে। একথা ঠিক যে, এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যেও তাদের দ্বিপাক্ষিক রেষারেষি রয়েছে, কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সেসব ভুলে বেইজিং এবং মস্কো এখন কীভাবে নিজেদের আরও বড় শক্তি করে তোলা যায় সেই নিয়ে চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত। সিরিয়া সঙ্কটে কীভাবে রাশিয়া নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে আমরা সবাই দেখেছি, তেমনই নিজেদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মাধ্যমে চীনও কীভাবে নিজেদের ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইছে সেটাও আমাদের অজানা নয়। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক শিবিরে এত ফাটল এবং সঙ্কটের সমাহার যে, বেশ কিছু দেশকে গণতন্ত্র হয় সত্বেও চীন ও রাশিয়ার মতো দেশের সঙ্গেও সখ্য রাখতে হচ্ছে পরিস্থিতি অনুকূল রাখতে। তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম।
তাই, একথা বলতে দ্বিধা নেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের ঢেউ এলেও আজকে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ পর্যায়ে এসে আমাদের ভাবতেই হচ্ছে বাস্তব অবস্থার কথা। উদারবাদী ও গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার কথা মনের মতো হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে এই আদর্শবাদী কথাগুলো বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে এবং যে নেতৃত্বের হাতে এগুলোর রাশ থাকার কথা, তাদের দুর্বলতাও যথেষ্ট প্রকট হচ্ছে। আর সেখানেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে অগণতান্ত্রিক শক্তি-নেতৃত্বরাও। এটা ভালো না খারাপ, সেকথা ভাবার দায় সাধারণ মানুষের, কিন্তু এই প্রচ্ছন্ন পরিবর্তনটিকে উপেক্ষা করা যায় না কোনোভাবেই।