১৭০৭ সালে ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হওয়ার আগে পুরো মধ্যযুগ স্বাধীনতা উপভোগ করেছে স্কটল্যান্ডের মানুষ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছে একের পর এক যুদ্ধ। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসেবে শাসনকার্যে আসলে একীভূতকরণ শুরু হয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একীভূত হয়ে যা পরবর্তীতে পূর্ণতা লাভ করে।
কিন্তু এই মধুচন্দ্রিমা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উনবিংশ শতাব্দীতেই স্কটিশ জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটতে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা অর্জন স্কটিশ জাতীয়তাবাদকে আরো প্রভাবিত করতে শুরু করে। ফলে ১৯৭৯ এবং ১৯৯৭ সালে স্বশাসনের দাবিতে হয় দুটি গণভোট, যার শেষটিতে জয় হয় স্বশাসনের সমর্থকদের, প্রতিষ্ঠিত হয় স্কটিশ পার্লামেন্টের।
ক্রমে ক্রমে স্বশাসনের দাবি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে রূপ নিতে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে। স্কটিশ পার্লামেন্টে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) জয় স্বাধীনতার দাবিকে বেগবান করে। দ্রুতই স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটের দাবি জোরালো হতে থাকে, ফলাফল ২০১৪ সালের গণভোট।
স্কটিশ স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের জন্য ২০১৪ সালের গণভোট আশানুরূপ ছিলো না। “স্কটল্যান্ড কি স্বাধীন দেশ হবে?” গণভোটে এই প্রশ্নের উত্তরে ৪৪.৭ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়, বাকি ৫৫.৩ ভাগ রায় দেয় ইউনিয়নের থাকার পক্ষে। ফলাফল, যুক্তরাজ্যের অংশ হয়ে থাকা নিশ্চিত হয় আরো কিছুদিনের জন্য।
স্বাধীনতা প্রত্যাশীরা দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায়, তাদের পালে হাওয়া দেয় ব্রেক্সিট ইস্যু। ২০১৬ এর গণভোট আর সর্বশেষ ১৯ এর নির্বাচন নিশ্চিত করেছে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, কার্যকর হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর।
লক্ষণীয়ভাবে, স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ ভোটাররা ছিলেন ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। সর্বশেষ নির্বাচনের পর ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ায় স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিটি পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে এবং দাবি উঠেছে স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোটের জন্য।
দ্বিতীয় গণভোটের বৈধতা
স্বাধীনতার দাবিটি স্কটল্যান্ডে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চারিত হয়েছে, ধারাবাহিকতায় হয়েছে গণভোট। আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়া স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের হতাশ অবশ্যই করেছে, তবে ব্রেক্সিট ইস্যুর পর তারা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় গণভোটের দাবিটি স্কটল্যান্ডে পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়েছে। স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে, আরজি জানিয়েছে গণভোট আয়োজনের। ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে হওয়া সর্বশেষ নির্বাচনে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি খোলাখুলিভাবে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়। নির্বাচনে স্কটল্যান্ডের ৫৯টি আসনের মধ্যে এসএনপির ৪৮টিতে জয় স্বাধীনতার পক্ষে স্কটল্যান্ডের ভোটারদের সমর্থন হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। এই ফলাফল অনুপ্রাণিত করেছে এসএনপিকে, নৈতিক ভিত্তি পেয়েছে দ্বিতীয় গণভোটের দাবি।
স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন বাড়ার প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে বিভিন্ন সমীক্ষা, পোল রিপোর্টেও। প্যানেল বেইজ এর সমীক্ষায় ৫২% ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে, দ্য ন্যাশনালের পোলেও একই ফলাফল এসেছে, সারভেশনের পোলে সমর্থনের ফলাফল এসেছে ৫০%। ইউগভের পোলে স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন এসেছে ৫১%। ফলাফলে, গণভোটে জনসমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক দেশে এটা অগ্রাহ্য করা কঠিন।
এর পাশাপাশি স্কটিশ স্বাধীনতাকামীরা বর্তমান টোরি নেতৃত্বের নৈতিক বৈধতা প্রশ্ন তুলেছেন। গত ৬০ বছরে কনজারভেটিভ পার্টি স্কটল্যান্ডে কোনো আসন জিততে পারেনি, বাড়াতে পারেনি জনসমর্থন। ফলে, কনজারভেটিভ সরকারের স্কটল্যান্ডকে শাসনের ব্যাপারটিকে অনেকে অগণতান্ত্রিক আচরণ হিসেবে দেখছেন এবং স্বাধীনতার দাবিটিকে জোরালো করে তুলেছেন।
কেন স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকছে স্কটিশরা
প্রায় তিনশ বছর ধরে স্কটিশরা ইউনিয়নে থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশীদার হয়েছে, আমেরিকায় উপনিবেশ শাসনের অংশ হয়েছে, অংশ হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ শাসনেরও। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় বেশ কিছু কারণে স্কটিশদের কাছে ইউনিয়নের প্রয়োজন ফুরিয়েছে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা তৈরির পথে ঝুকছে।
প্রথমত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিল থাকলেও বহুদিন ধরেই স্কটিশরা সবসময়ই ইংল্যান্ড থেকে আলাদা জাতীয়তাবাদ ধারণ করতে অভ্যস্ত। জাতীয়তাবাদের জায়গা থেকে স্বশাসনের দাবির পরে তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার দাবিটি উত্থাপিত হচ্ছে। প্রথম গণভোটের পর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বও তৈরি হচ্ছে ।
দ্বিতীয়ত, ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্যে অর্থনীতি একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাবে। জিডিপির আকার ছোট হবে, মাথাপিছু আয় কমবে, কমবে কর্মসংস্থানও। স্কটিশরা এই অস্থিতিশীলতার অংশ হতে চাচ্ছে না। ফলে জোরদার হচ্ছে স্বাধীনতার দাবি।
তৃতীয়ত, বৈশ্বিক পরিসরে কাতার, মোনাকো, গ্রানাডা, বাহরাইনের মতো ছোট রাষ্ট্রগুলোর অভূতপূর্ব উন্নয়ন স্কটিশদের স্বাধীনতার পালে হাওয়া দিচ্ছে।
চতুর্থত, স্কটিশরা গণভোট, সর্বশেষ নির্বাচনের মতো জায়গাগুলোতে বরাবরই ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সর্বশেষ, যুক্তরাজ্য যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে, স্কটল্যান্ডের মানুষের কাছে যুক্তরাজ্য আবেদন হারিয়েছে।
পঞ্চমত, যুক্তরাজ্যের বড় দুই দল, লেবার এবং কনজারভেটিভদের জনসমর্থন স্কটল্যান্ডে কখনোই উল্লেখ করার কিছু ছিলো না। ফলে ওয়েস্ট মিনিস্টারে স্কটিশদের আবেদন উচ্চারিত হচ্ছে না, এমন ভাবনা থেকে জোরদার হচ্ছে স্বাধীনতার দাবি।
ষষ্ঠত, এসএনপি, গ্রিন পার্টির মতো স্কটল্যান্ডপন্থী দলগুলো খোলাখুলিভাবেই স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে, স্বাধীনতার দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরছে।
সপ্তমত, ইতিমধ্যেই স্কটল্যান্ডভিত্তিক বেশ কয়েকটি বৃহৎ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিতে সমর্থন প্রদান করেছে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় দফা গণভোট আয়োজনের জন্য স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার একটি চিঠি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন। স্কটল্যান্ডে ক্ষমতাসীন দল দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার দাবিতে ক্যাম্পেইন করছে, ফলাফল এসেছে র্যালিগুলোতে। কিছুদিন আগে গ্লেসগোকে এক র্যালিতে অংশ নিয়েছেন স্বাধীনতাকামী প্রায় আশি হাজার স্কটিশ। ফলে,স্বাধীনতার দাবিটি বাস্তব মনে হচ্ছে এবং হাউজ অফ কমন্সকে বাধ্য হয়েই ভাবতে হবে দ্বিতীয় গণভোটের কথা। নিশ্চিতভাবে, সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে না কনজারভেটিভ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য।
প্রথমত, যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায়, অর্থনৈতিক বিভিন্ন জায়গাতে স্কটল্যান্ডের উপর ইংল্যান্ডের নির্ভরশীলতা বাড়বে। ফলে ১৭০ বিলিয়ন জিডিপির দেশ স্কটল্যান্ডকে আলাদা হতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ব্রিটেনকে বাণিজ্যিকভাবে আরো একঘরে করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো স্কটল্যান্ড। এখানে গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণ, কয়লা ও স্টিল ইন্ড্রাস্টিজের মতো ভারী শিল্প। এই শিল্পগুলোর উপর ব্রিটেনের নির্ভরশীলতা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে হাউজ অফ কমন্সকে বাধা দিতে উৎসাহিত করবে।
তৃতীয়ত, ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারের অন্যতম নিয়ামক ঐতিহ্যবাহী নৌবাহিনীর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বেইস রয়েছে স্কটল্যান্ডে, রয়েছে সাবমেরিন ঘাঁটি ও মেরামত কেন্দ্র। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ, বিমানবাহী রণতরী নির্মানের কারখানার পাশাপাশি অস্ত্রের কারখানাও আছে স্কটল্যান্ডে। ফলে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পূর্বেই এগুলোর বিকল্প খুঁজে নিতে হবে ব্রিটেনকে।
চতুর্থত,পুরো ব্রেক্সিটের পরে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হবে সামুদ্রিক মৎস্য। স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে এটিও বাধাগ্রস্ত হবে
পঞ্চমত, স্কটল্যান্ডের জলসীমায় রয়েছে বিশাল তেলের মজুদ, যার আনুমানিক মূল্য ৪ ট্রিলিয়ন ইউরো। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তেলের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ কর্পোরেশনগুলো তাই স্কটিশ স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে নিশ্চিতভাবেই প্রভাব রাখবে।
ষষ্ঠত, ইউরোপের বিভিন্ন বৃহৎ দেশকেও স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিপক্ষে দেখা যেতে পারে। ‘কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীদের উস্কে দিতে পারে’ এই যুক্তিতে স্পেন সরাসরি বিরোধিতা করছে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবির।
ইতিমধ্যেই বরিস জনসন গণভোট বিরোধী ক্যাম্পেইনে ৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন ভবিষ্যতে ভালো যুক্তরাজ্য গঠনের স্বপ্নগুলো তুলে ধরার।
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা
স্বাধীনতার দাবিতে অতীতে হাজারও বিপ্লব হয়েছে, বিদ্রোহ হয়েছে, হয়েছে রাজনৈতিক সংঘাত। কবি শামসুর রহমান বুঝি এজন্যই বলেছিলেন,
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্কটল্যান্ডের সুবিধা হলো, যুক্তরাজ্যের কাঠামোটি গণতান্ত্রিক এবং তারা আইনগত উপায়ে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করতে পারছে। দ্বিতীয় গণভোট স্কটিশ স্বাধীনতাকামীদের জন্য আশানুরূপ একটি ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। কনজারভেটিভ পার্টির ৬৩ ভাগ সমর্থকও (ইউগভের পোল) চান, স্কটল্যান্ড আলাদা হয়ে যাক। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই, ব্রেক্সিট পরবর্তী অবস্থা এবং যুক্তরাজ্যের শেষ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুঃস্বপ্ন কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে স্বাধীনতার প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে বাধ্য করবে।