সম্প্রতি ফাঁস হওয়া প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার গোপন ইরানি ডকুমেন্টের উপর সংবাদ মাধ্যম ইন্টারসেপ্ট পাঁচ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে ইরাকে ইরানের রহস্যময় ভূমিকার অনেক গোপন তথ্য। ইন্টারসেপ্টের এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের এই “ইরান ক্যাবল” সিরিজ। আজ পড়ুন সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব। পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব
ফাঁস হওয়া ইরানি গোয়েন্দাসংস্থার আর্কাইভে যে কয়েক শত প্রতিবেদন এবং বার্তা স্থান পেয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের। বার্তাগুলোর অধিকাংশই পাঠানো হয়েছিল ইরাক থেকে। সেগুলো পাঠিয়েছিল সেখানে নিযুক্ত ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি, MOIS-এর গোয়েন্দারা।
মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সকে বলা যায় সিআইএর ইরানি সংস্করণ। বিশ্লেষণমূলক এবং পেশাদার গোয়েন্দাসংস্থা হিসেবে এর বেশ খ্যাতি আছে। কিন্তু এর কার্যক্রম প্রায়ই চাপা পড়ে যায় এর অপেক্ষাকৃত আদর্শভিত্তিক সমতুল্য সংগঠন, ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন অফ দ্য ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ড কোরের কার্যক্রমের আড়ালে, যেটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালে, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির নির্দেশে।
ইরান তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরাক, লেবানন এবং সিরিয়াকে নিজের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আর এই দেশগুলোতে ইরানের নীতি নির্ধারিত হয় এই রেভোল্যুশনারি গার্ড দ্বারা, বিশেষ ভাবে বলতে গেলে মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানির নেতৃত্বাধীন অভিজাত কুদস ফোর্স দ্বারা। এই দেশগুলোতে রাষ্ট্রদূতদেরকে নিয়োগ করা হয় রেভোল্যুশনারি গার্ডের সিনিয়র অফিসারদের মধ্য থেকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে না, যদিও ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স কার্যত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই অধীনে।
ইরাকে নিযুক্ত ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স এবং রেভোল্যুশনারি গার্ডের কর্মকর্তারা পরস্পর সমান্তরালে কাজ করেন। পৃথক পৃথকভাবে তারা তাদের কার্যক্রমের প্রতিবেদন তেহরানে নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে প্রেরণ করেন। এই দুই প্রতিষ্ঠানের হেড কোয়ার্টার থেকে প্রতিবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে পাঠানো হয় সুপ্রিম কাউন্সিল অফ ন্যাশনাল সিকিউরিটির কাছে। এবং এই কাউন্সিলের সুপারিশেই পরবর্তীতে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ফাঁস হওয়া রিপোর্টগুলো অনুযায়ী, ২০১১ সালে আমেরিকা ইরাক থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার সাথে সাথেই ইরান সক্রিয় হয়ে ওঠে সিআইএর হয়ে কাজ করা ইরাকি ইনফর্মারদেরকে হাত করার জন্য। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এরকমও দাবি করা হয় যে, ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মচারীকেও গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করার উদ্যোগ নিয়েছিল, যদিও শেষপর্যন্ত তাদের উদ্যোগ সফল হয়েছিল কি না, তা ডকুমেন্টগুলো থেকে জানা যায় না।
তবে এটা জানা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য গুপ্তচরের সাথে ইরানিরা যোগাযোগ শুরু করেছিল এবং তাকে নগদ বেতন, স্বর্ণমুদ্রা এবং অন্যান্য উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। সম্ভাব্য গুপ্তচরের নাম বা পদবী ডকুমেন্টগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায়, তার পক্ষে ইরাক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা, বিশেষ করে আইএসের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিল, সেটা সহ অন্যান্য গোপন তথ্য হস্তান্তর করা সম্ভব ছিল।
ইরানি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর ইরান তার অস্তিত্বের জন্য এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য আমেরিকানদের উপর গোয়েন্দাগিরি করাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। আমেরিকার হাতে সাদ্দামের পতনের পরপরই ইরান তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রেভোল্যুশনারি গার্ডের সেরা সেরা কিছু কর্মকর্তাকে ইরাকে প্রেরণ করে। ইরাক দখলের পর প্রেসিডেন্ট বুশ ইরানকেও “অ্যাক্সিস অফ ইভিল” তথা শয়তানের অক্ষ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, ফলে ইরানের নেতাদের বিশ্বাস ছিল ইরানই হবে আফগানিস্তান এবং ইরাকের পর ওয়াশিংটনের রেজিম-চেঞ্জ লিস্টের পরবর্তী টার্গেট।
ফাঁস হওয়া কিছু কিছু বার্তা থেকে ইরানি গোয়েন্দাদের হাস্যকর ভুল এবং অদক্ষতারও প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন একটি বার্তা থেকে জানা যায়, ইরানি গোয়েন্দারা একবার ইরাকের জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটের একটি ভবনে অনুপ্রবেশ করেছিল। কিন্তু সেখানকার গোপন সেফ ভল্ট খুলতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, তাদের কাছে থাকা কোড ছিল ভুল।
অন্য কিছু রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইরাকে নিযুক্ত ইরানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরকে তাদের আলস্য এবং অযোগ্যতার কারণে শাসাচ্ছেন, কারণ সত্যিকার তদন্ত রিপোর্ট পাঠানোর পরিবর্তে তারা সংবাদ মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যই রিপোর্ট আকারে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন।
কিন্তু এগুলো বাদ দিলে ডকুমেন্টগুলো থেকে ইন্টেলিজেন্স মিনিস্ট্রির কর্মকর্তাদের অধিকাংশকেই অত্যন্ত ধৈর্যশীল, পেশাদার এবং বাস্তববাদী বলেই মনে হয়। ডকুমেন্টগুলো থেকে দেখা যায়, তাদের প্রধান লক্ষ্য ইরাককে ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা করা, ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সুন্নি বিদ্রোহীদেরকে শক্তিশালী হতে না দেওয়া, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে পড়া থেকে ইরাককে রক্ষা করা যেন শিয়াদের উপর কোনো আক্রমণ না হয়, এবং নিশ্চিত করা যেন স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে না পড়ে।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলো থেকে ইরাকের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা এক অর্থে ২০০৩ সালের আমেরিকার আগ্রাসনেরই ফলাফল। ইরাক আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে আমেরিকা বাস্তবে দেশটির নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতেই তুলে দিয়েছিল – এই মত এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীর ভেতরেও।
সম্প্রতি মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত ইরাক যুদ্ধের উপর দুই ভলিউমের একটি পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্রে ইরাকে আমেরিকানদের ভুলগুলোর এবং ইরাক যুদ্ধের অকল্পনীয় ব্যয় ও প্রাণহানির সমালোচনা করা হয়। ঐ যুদ্ধে প্রায় ৪,৫০০ আমেরিকান এবং কয়েক লাখ ইরাকি মারা গিয়েছিল, আর আমেরিকার খরচ হয়েছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। কয়েকশো পৃষ্ঠার ঐ গবেষণাপত্রের উপসংহার টানা হয় এই বলে যে, “সাহসী এবং সম্প্রসারণবাদী ইরানই এই যুদ্ধের একমাত্র বিজয়ী।”
ইরাকে ক্ষমতার লড়াইয়ের খেলায় ইরানের উত্থান একদিক থেকে ওয়াশিংটনের যুদ্ধপরবর্তী পরিকল্পনার অনুপস্থিতিরই ফলাফল। সাদ্দামের পতনের পর প্রথম দিনগুলো ছিল বিশৃঙ্খল – নিরাপত্তার দিক থেকেও, বিভিন্ন মৌলিক সেবা, যেমন পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের দিক থেকেও। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হচ্ছিল, আমেরিকার যেন ইরাক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না, তারা যেন তাদের নীতি নির্ধারণ করছে চলতে চলতে, অনুমানের উপর ভিত্তি করে।
আমেরিকানদের নীতির মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যয়মূলক ছিল ইরাকের সশস্ত্রবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেওয়া এবং বাথ পার্টির যেকোনো সদস্যকে নতুন সশস্ত্রবাহিনীসহ সব ধরনের সরকারী চাকরি থেকে নিষিদ্ধ করা। ডিবাথিফিকেশন নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে অধিকাংশ সুন্নিকে অকিঞ্চিৎকর করে তোলে। বেকার এবং ক্ষুব্ধ এই সুন্নি পুরুষদের অনেকেই যোগ দেয় সশস্ত্র বিদ্রোহে, যাদের প্রধান টার্গেট ছিল আমেরিকানরা এবং সেই সাথে শিয়া ইরাকিরা, যাদেরকে তারা আমেরিকানদের মিত্র হিসেবে দেখত।
শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ যখন তীব্র হতে থাকে, তখন শিয়া জনগণ ইরানকেই তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। পরবর্তীতে যখন জঙ্গি সংগঠন আইএস বিভিন্ন এলাকা এবং শহর দখল করে নেয়, তখন শিয়াদের নিরাপত্তাহীনতা এবং তাদেরকে রক্ষায় আমেরিকানদের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে কাসেম সোলায়মানি এবং তার রেভোল্যুশনারি গার্ডরা ইরানের প্রতি অনুগত শিয়া মিলিশিয়াদেরকে জড়ো করে এবং তাদেরকে নিয়োগ করে আইএসকে পরাজিত করে ইরাকে নিজেদের ক্ষমতার দখল নিশ্চিত করার জন্য।
মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্সের গোপন ডকুমেন্ট অনুযায়ী, ইরান দীর্ঘদিন ধরেই ইরাকের মাটিতে আমেরিকানদের তৈরি করা বিভিন্ন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১১ সালে সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে ইরাকে আমেরিকানদের কার্যক্রম যখন ক্রমেই হ্রাস পেতে শুরু করে, ইরান তখন আমেরিকানদের ইনফর্মারদেরকে হাত করে নেয়।
ইরাক ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সিআইএ দীর্ঘদিন ধরে তাদের হয়ে কাজ করা ইরাকি এজেন্টদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায়। চাকরিবিহীন, নিঃসম্বল এই এজেন্টদের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, আমেরিকানদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তাদের উপর উপর হয়তো প্রতিশোধমূলক হামলা হতে পারে। তাই তাদের অনেকে নিজেরাই ইরানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের হাতে সিআইএর সকল তথ্য তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এই এজেন্টদের একজন ছিল এক ইরাকি, সিআইএর ফাইলে যার ছদ্মনাম ছিল “ডনি ব্রাস্কো”, আর ইরানি ডকুমেন্টে তার পরিচয় ছিল শুধুমাত্র “সোর্স ১৩৪৯৯২” হিসেবে। ডকুমেন্ট থেকে জানা যায়, ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৮ মাস পর্যন্ত সোর্স ১৩৪৯৯২ সিআইএর হয়ে কাজ করে। তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল আল-কায়েদা সদস্যদেরকে টার্গেট করার একটা প্রোগ্রামে। এই কাজের জন্য তাকে প্রতি মাসে ৩,০০০ ডলার বেতন দেওয়া হতো। সেই সাথে একবার তাকে এককালীন ২০,০০০ ডলার পুরস্কার এবং একটা গাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছিল।
আমেরিকানরা চলে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের নভেম্বরে সোর্স ১৩৪৯৯২ পক্ষ ত্যাগ করে ইরানের সাথে যোগাযোগ করে। ডকুমেন্ট অনুযায়ী, সোর্স ১৩৪৯৯২ কুরআন শপথ করে ঘোষণা করে, সিআইএর সাথে তার সব সম্পর্ক শেষ। সে ইরানের হাতে সিআইএর সকল গোপন তথ্য তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সিআইএর সেফ হাউজগুলোর ঠিকানা, যে হোটেলগুলোতে সিআইএ তাদের এজেন্টদের সাথে মিটিং করত সেগুলোর নাম, সিআইএর এজেন্টদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র এবং তাদের নজরদারির প্রশিক্ষণের বিবরণ, আমেরিকানদের হয়ে কাজ করা অন্যান্য এজেন্টদের পরিচয়, সব।
ইরাকি কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের সবটুকুই দীর্ঘদিন ধরে ইরানি গোয়েন্দাদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে এই দক্ষিণের কারবালা শহরেই বাগদাদ থেকে এক ইরাকি গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসে ইরানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। ডকুমেন্টের বিবরণ অনুযায়ী, ইরানি কর্মকর্তাদেরকে তিনি বলেন, “ইরান হচ্ছে আমার দ্বিতীয় দেশ, আমি ইরানকে ভালোবাসি।”
তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা সেই মিটিংয়ে ঐ ইরাকি কর্মকর্তা ইরানি শাসনব্যবস্থার প্রতি এবং ইরানি চলচ্চিত্রের প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, বাগদাদ থেকে তিনি এসেছেন তার বস, ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের কমান্ডার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাতেম আল-মাকসুসির কাছ থেকে বিশেষ একটা বার্তা নিয়ে। আল-মাকসুসি ইরানিদেরকে জানাতে চান, “আমরা আপনাদের সেবার জন্য প্রস্তুত আছি। আপনারা যা চাইবেন, তা-ই পাবেন। আমরা শিয়া এবং আমাদের উভয়ের শত্রু একই।”
মাকসুসির বার্তাবাহক আরো বলেন, “ইরাকের আর্মি ইন্টেলিজেন্সের পুরোটাই আপনাদের জন্য।” তিনি ইরানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরকে আমেরিকার দেওয়া নজরদারির বিশেষ সফটওয়্যার সম্পর্কে অবহিত করেন এবং সেটা ইরানিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। “আপনাদের যদি নতুন ল্যাপটপ থাকে, আমাকে দিন, আমি প্রোগ্রামটা সেখানে সেট করে দিবো।” তিনি বলেন।
বার্তাবাহক ইরানিদেরকে আরো জানান, আমেরিকানরা ইরাকে মোবাইল ফোনে আড়ি পাতার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করেছিল। সেগুলো পরিচালিত হতো প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং ইরাকি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের হেডকোয়ার্টার থেকে। বার্তাবাহক বলেন, “আপনাদের যা গোয়েন্দা তথ্য প্রয়োজন, সেটাই আমরা আপনাদের সামনে হাজির করব।”
ইন্টারসেপ্টের সাথে মাকসুসি অবশ্য এই অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি আইএসবিরোধী যুদ্ধে ইরানের সাহায্যের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, একইসাথে তার সাথে আমেরিকানদেরও সুসম্পর্ক বাজয় ছিল। তিনি দাবি করেন, “আমি শুধু ইরাকের জন্যই কাজ করেছি, অন্য কোনো দেশের জন্য না। আমি ছিলাম ইরাকের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক, শিয়াদের ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক না।”
এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, আমেরিকানরা ইরানের সাথে ইরাকি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালকের সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছিল, এবং পরবর্তীতে স্পর্শকাতর তথ্যে তার অধিকার সীমিত করার ব্যবস্থা নিয়েছিল।
ইরাকে নিযুক্ত ইরানি গোয়েন্দাদের দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ ছিল, যেসব ইরাকি কর্মকর্তা মাকসুসির মতো যারা স্বেচ্ছায় তাদের পক্ষে কাজ করতে রাজি হয়নি, তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে হাত করা। তাদের এই কাজ অনেকটাই সহজ ছিল এই কারণে যে, ইরাকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিল সাদ্দাম হোসেনের বিরোধী, এবং সেই সুবাদে সাদ্দামের সময় থেকেই ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
ডকুমেন্টগুলোতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ইরাকের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক, সামরিক এবং নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেকের সাথেই ইরানের গোপন সম্পর্ক আছে। (১ম পর্বে উল্লিখিত) যে ডকুমেন্টে ইরানের সাথে প্রধানমন্ত্রী আব্দুল মাহদির বিশেষ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই একই ডকুমেন্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদির মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মন্ত্রীর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
উচ্চপদস্থ ইরাকি কর্মকর্তাদেরকে হাত করার ব্যাপারে যে ইরানের বিশেষ মনোযোগ ছিল, সেটা ইরানের সরকারের একজন উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘেইশ ঘোরেইশিও নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “ইরাকি নেতাদের মধ্যে আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিত্র আছে, যাদেরকে আমরা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি।”
মূল প্রতিবেদক: জেমস রাইজেন, টিম আরাঙ্গো, ফারনাজ ফাসিহি, মুর্তজা হাসান, রোনেন বার্গম্যান
প্রকাশের তারিখ: ১৮ নভেম্বর, ২০১৯
আগামী পর্বে আসছে ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদির কথা, গোপন ডকুমেন্ট অনুযায়ী তিনি কীভাবে একইসাথে আমেরিকা এবং ইরানের পছন্দের প্রার্থী হয়ে উঠেছিলেন, সেই কাহিনী।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/