অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টির পাশাপাশি বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ইরানি বিপ্লব ইতিহাস পরিবর্তনকারী ঘটনা। ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা ইরানে হাজার বছরের রাজতন্ত্রের ইতিহাসের ছেদ ঘটে ১৯৭৯ এর এই ইরানি বিপ্লবের মাধ্যমে। তৎকালীন শাহের সীমাহীন দূর্নীতি আর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সামাজিক সাম্য, গণতন্ত্র আর বৈদেশিক প্রভাব থেকে মুক্তির দাবিতে মাসের পর মাসের আন্দোলন, শত শত আন্দোলনকারীর জীবনের প্রতিদানের ফলাফল ঊনআশির ইরানি বিপ্লব।
কালে কালে বিপ্লবের ৪১ বছর পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে আমূল বদলে গেছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কাঠামো। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরান আজ প্রভাবশালী এক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু চার দশকে কতটুকু পূরণ হয়েছে বিপ্লবের লক্ষ্যগুলো? প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সংঘাতই বা কতটুকু?
বিপ্লব পরবর্তী ইরান
ইরান বিপ্লবের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বপ্রথম ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মিশ্রণ হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে থাকে সুপ্রিম লিডার নামে একটি পদ, যিনি আয়াতুল্লাহদের মধ্য থেকে পার্লামেন্টের মাধ্যমে আজীবনের জন্য নির্বাচিত হন। এর পাশাপাশি রয়েছে গার্ডিয়ান কাউন্সিল নামে ১২ সদস্যের একটি পরিষদ, যাদের মধ্যে ৬ জন সুপ্রিম লিডার নিয়োগ দেন, বাকি ৬ জন ইরানের সংসদ মজলিশ-ই-শূরার মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
গণতান্ত্রিক কাঠামোর শীর্ষে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট যিনি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। যদিও সুপ্রিম লিডারের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগকে বাধাগ্রস্থ করেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন মজলিশ-ই-শূরার সদস্যরা।
বিপ্লবের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রীয় বিবর্তনকে নিরিখ করলে পাঁচটি পর্যায়ের দেখা পাওয়া যায়। ইরান বিপ্লবে নেতৃত্ব দানকারী আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন সময়কে প্রথম পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়টাতে ইরানকে মূলত অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাম দলগুলোর ভূমিকা, পাশ্চাত্য দেশগুলোর ইন্ধনে ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, জটিল করেছে খোমেনির শাসনমালকে। শাত-ইল-আরবকে কেন্দ্র করে ইরাক-ইরানের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমি রাফসানজানির সময়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই শাসক অর্থনৈতিক চিন্তায় ছিলেন মুক্তবাজারের পক্ষে, রাজনৈতিকভাবে কর্তৃত্ববাদী এবং রক্ষণশীল ঘরানার।
বিপ্লবের পর ইরানের মানুষজন বাকস্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যমে, বিতর্কের মতো সুযোগগুলো প্রথমবার পায় প্রেসিডেন্ট খাতামির সময়কালে। তার সময় থেকেই মূলত ইরান আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। তৃতীয় পর্যায়ের বিপুল জনপ্রিয় এ প্রেসিডেন্ট মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ইরানের পররাষ্ট্রনীতিকে বদলে দেওয়ায়।
ইরানের পশ্চাৎযাত্রা আবার শুরু হয় মাহমুদ আহমেদিজানের সময় থেকে। কঠোর রক্ষণশীল এই প্রেসিডেন্টের আমলে ইরান পরমাণু কর্মসূচি নতুনভাবে শুরু হয় এবং রাশিয়ার সহায়তায় প্রথম পরমাণু প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়।
সর্বশেষ, ২০১৩ এর নির্বাচনে পুনরায় মধ্যপন্থী হাসান রুহানির জয়ের মধ্য দিয়ে ইরান নতুন যুগে প্রবেশের সুযোগ পায়। ছয় দেশের পরমাণু চুক্তি, মধ্যপন্থীদের উত্থান এই পর্যায়ের বড় অর্জন ছিলো। চুক্তির পরে অর্থনীতিতে বইছিলো সুবাতাস। পরমাণু চুক্তি বাতিল, মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন যুদ্ধের ব্যয় এই শাসনামলের সফলতাকে অনেকাংশে ম্লান করেছে।
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সংঘাত
সামাজিক ন্যায্যতা , গণতন্ত্র আর বৈদেশিক প্রভাব থেকে মুক্তির দাবিতে শাহের বিরুদ্ধে এক হয়েছিলো ইরানের তৎকালীন অধিকাংশ পরিবর্তনকামী গোষ্ঠী। সাধারণ জনগণের সাথে দুই মেরুতে থাকা ইসলামপন্থী আর বামপন্থীদের যুগপৎ আন্দোলনের ফলাফল ইরান বিপ্লব। শাহের পতন তো চার দশক আগেই হয়েছে, কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রকাঠামো কতটা পূরণ করতে পেরেছে জনগণের স্বপ্ন? বিপ্লবের মাধ্যমে যে অর্থনীতি, সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমূল বদল হওয়ার কথা, কতটুকু হয়েছে তার?
সামাজিক ন্যায্যতা
ষাটের দশকে হঠাৎ বৃদ্ধি পায় তেলের দাম। বিপুল তেলের রিজার্ভ থাকা ইরান এই দাম বৃদ্ধির সুযোগ লুফে নেয় দুই হাতে। দেশে আসতে থাকে প্রচুর মুনাফা, যা দিয়ে শাহ স্বপ্ন দেখলেন শ্বেত বিপ্লব বাস্তবায়নের। শুরু করলেন সংস্কারমূলক কাজ।
কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সমস্যাগুলো ততদিনে আকড়ে ধরেছিলো শাহকে। তেলের বিপুল মুনাফার সুবিধাভোগী হলো তার আশেপাশে থাকা গুটিকয়েক অভিজাত। তাদের সম্পদের পাহাড়ের পাশে ইরানের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কোনো উন্নয়ন হয়নি। পাশাপাশি, শহর আর গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়তে থাকলো।
মাঝখান থেকে শ্বেত বিপ্লবের ফলে তৈরি হলো রক্ষণশীল গোষ্ঠীর তীব্র অসন্তোষ।
দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, অভিজাততন্ত্রের বিকাশ, তেলের মুনাফার সুবিধা সাধারণের কাছে না পৌঁছার মতো সামাজিক ক্ষেত্রের ইস্যুগুলোই শাহের বিরুদ্ধে বিপ্লবের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিলো।
বিপ্লবের পরে মার্ক্সিস্ট-ইসলামিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন বিপ্লবীরা। ফলে বিপ্লবের পরে শাহের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়, সরকারিকরণ হয় শিল্প কারখানা, ব্যাংক, গণমাধ্যম, বিদ্যুৎ, ডাক, বিমানসহ অধিকাংশ বড় বড় ক্ষেত্র। ফলাফল হিসেবে মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো অনেকগুলো নাগরিক সুবিধা পৌঁছেছে নাগরিকদের হাতে। বিদ্যুৎ, পানীয় জল, প্রাকৃতিক গ্যাস, গাড়ি ইত্যাদি সুবিধার আওতায় এসেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইরানি। কমে এসেছে শহর ও গ্রামের বৈষম্য।
এই কল্যাণমূলক অর্থনীতির ফলাফল হিসেবে কমেছে দারিদ্র্যের হার। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে যেখানে অতিদরিদ্রের হার ছিলো ২৫%, বর্তমানে তা ১০ শতাংশেরও কম। মানব উন্নয়ন সূচকের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি ইরান।
মানসম্পন্ন শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ইরান, বিশ্ব র্যাংকিয়ে শীর্ষস্থানীয় অবস্থায় রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। তুলনামূলকভাবে নারী শিক্ষার হার পুরুষদের চেয়ে বেশি। ফলে কমে এসেছে নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান।
এরপরও সামাজিক ন্যায্যতার জায়গাতে বিপ্লব-পরবর্তী ইরানের অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা আছে। বেকারত্বের সমস্যা এর মধ্যে সবার আগে থাকবে। সার্বিক বেকারত্বের হার ১৬%, তরুণদের মধ্যে যা ২৫%-৪০% এর মধ্যে। ফলাফল হিসেবে ব্রেইন ড্রেইন হওয়া শীর্ষ দেশগুলোর একটি ইরান, যার ফলে বাৎসরিক ক্ষতি প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার।
অনেকগুলো নাগরিক সুবিধা হয়তো বিপ্লবোত্তর ইরান সরকার পৌঁছে দিয়েছে নাগরিকদের কাছে, কিন্তু শ্রেণীবৈষম্য কমেনি। এখনও ১৪% ইরানি তাবুতে বাস করে, শহুরে এলাকার ৩৩ ভাগ লোক বাস করে বস্তিতে। পরিস্থিতির খাতিরে তৈরি হয়েছে নতুন একটি শ্রেণী, যারা ‘মধ্যবিত্ত দরিদ্র’ নামে পরিচিত।
আবার, বিপ্লব আসলেই সামন্তবাদীদের যুগের অবসান ঘটাতে পেরেছে কি না, সেটিও স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ স্থানেই ইরানের হাজার বছর ধরে লালন করা সামন্তবাদী চরিত্র এখনও রয়ে গেছে। এরা বিভিন্নভাবে আগের মতোই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে বা করে।
অর্থনীতিতে মুক্তবাজার নীতিতে যেতে না পারা, নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরির চেষ্টা, পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ করে দিয়েছে ইরানের উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপের। ফলে তেলের রাজস্ব ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যহত হয়েছে, বাধাগ্রস্ত করেছে বিনিয়োগের প্রবাহ। ফলশ্রুতিতে, ব্যাপক ধস নেমেছে ইরানের অর্থনীতিতে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, মুদ্রার মানের ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। সৃষ্টি করেছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা।
গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক অধিকার
ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য সত্ত্বেও ইরানে সবসময়ই বহু মত, বহু দর্শনের সম্মিলন ঘটেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং অভিজ্ঞতায় ইরানিরা সবসময় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে রাজনীতিতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইরানিদের নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে। পাঁচজন ইরানি যদি একসাথে হয়, তাহলে সেখানে ছয়টি রাজনৈতিক দল তৈরি হয়। এই রাজনৈতিক সক্রিয়তাই ইরানিদের দীর্ঘদিনের বিপ্লবকে সফল করতে ভূমিকা রেখেছে।
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র আর ইসলাম- এই আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে বিপ্লব। কিন্তু বিপ্লব চলাকালেই বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত বামদের হাত থেকে শিয়া নেতৃবৃন্দের কাছে চলে যেতে থাকে। ফলে বিপ্লবোত্তর ইরানে বিশ্ব সর্বপ্রথম ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মিশ্রণ দেখতে পায়।
বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রকাঠামোতে সুপ্রিম লিডার নামে একটি পদ তৈরি হয়। সুপ্রিম লিডারের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় গুলোর নিয়ন্ত্রণ তাকে ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে রূপান্তর করেছে।
সুপ্রিম কমান্ডারকে পরামর্শদানের জন্য রয়েছে ১২ সদস্যের গার্ডিয়ান কাউন্সিল। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে আছে প্রেসিডেন্ট এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা জনপ্রতনিধিরা। এই রাষ্ট্রকাঠামোকে অনেকে শাহ আমলের রাজতন্ত্রের কাঠামোর অনুরূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন ।
বর্তমানে ইরানে প্রায় ২৫০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। কুর্দি এবং বামদের বেশ কিছু দল ইরানের বাইরে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
এত রাজনৈতিক ভিড়েও ইরানে প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিস্ফুটন ঘটেনি। গুরুত্বপূর্ণ সকল সিদ্ধান্ত আসে সুপ্রিম লিডারের কাছ থেকে, গার্ডিয়ান কাউন্সিল থেকে। রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রীপরিষদের প্রভাব অত্যন্ত কম এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। ফলে ইরান মূলত পরিচালিত হয় একটি অগণতান্ত্রিক কাঠামো দ্বারা।
বিরোধীদের প্রতি ব্যাপক দমন পীড়ন, সরকারবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশি হেনস্তা ইরানের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধীনতার জায়গাকে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। বিপ্লব পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ইরানবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগে হত্যা করেছে প্রায় আট হাজার বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে। রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে এই ধারা এখনও বর্তমান এবং প্রতিবছরই একটি বড় সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মীদের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। সর্বশেষ ডিসেম্বরের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে প্রায় চারশ বিক্ষোভকারীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
রেভ্যলুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্স আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইরানের প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যতটুকু প্রশংসিত হয়েছে, ততটুকুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার কারণে। সরাসরি সুপ্রিম লিডারের কাছে দায়বদ্ধ অত্যন্ত দক্ষ এই বাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিরুদ্ধ মতকে দমন করেছে, মুক্তচিন্তাকে বাধাগ্রস্থ করেছে, রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে খোমানির শাসনকে নির্বিঘ্ন করতে চেয়েছে। অনেকে এর মধ্যে শাহের আমলের পুনরাবৃত্তি খুঁজে পান। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মুক্ত গণতন্ত্র এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম একটি মাধ্যম।
সাংবিধানিক স্বীকৃতির পরেও পূর্ণ স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিবেশ ইরানে এখনও আসেনি, একটা বড় সংখ্যক সাংবাদিক সেখানে শিকার হন হেনস্থার। মুক্ত গণমাধ্যমের র্যাংকিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৭০-এ। ব্যাপক নজরদারি করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে, সরকারবিরোধী কিছু থাকলে নেওয়া হয় দ্রুত ব্যবস্থা ।
আন্তর্জাতিক বলয়ে ইরান
ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং বিপুল তেলের রিজার্ভ থাকায় ইরান সবসময় আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলো। ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ইরানে প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে রাশিয়া এবং ব্রিটেনের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইরানে জার্মানির প্রভাব কিছুটা বাড়লেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ পায়।
পরাশক্তিগুলোর প্রভাবে তেল মুনাফার বিশাল অংশ দেশের বাইরে চলে যাওয়া ইরানের জনগণের মনোভাবকে প্রভাবিত করে, করে তোলে পরাশক্তি বিরোধী। অবধারিতভাবেই ইরান বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো, পরাশক্তির প্রভাব থেকে ইরানকে মুক্ত করা।
বিশ্বায়নের এই যুগে রাষ্ট্রগুলোর পরস্পর নির্ভরশীলতা পরম স্বাধীনতার ধারণাটিকে ভেঙে দিয়েছে । বিপ্লবোত্তর ইরান সরকার অর্থনীতি, রাজনীতিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় নতুন পোলারাইজেশনের তৈরি করেছে। এরপরও বিশ্লেষকদের মতে, ইরানই বর্তমান বিশ্বে একমাত্র রাষ্ট্র, যারা বাইরের কোনো প্রভাব ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের জায়গার অবস্থান থেকে বিপ্লবোত্তর সরকার ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে আসীন করেছে। ইরাকে ইরানের প্রভাব পাকাপোক্ত হয়েছে, লেবাননে রয়েছে ইরানের প্রক্সি ফোর্স, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইরানের হাতে, প্রভাব আছে লিবিয়া, ফিলিস্তিন, মিসরের মতো দেশগুলোতেও। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরান তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করেছে।
ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোর পাশাপাশি পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ইরানের বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো রয়েছে বিপুল সংখ্যক দক্ষ ইরানি অভিবাসী।
ভবিষ্যৎ ইরান
প্রশ্নাতীতভাবে, বিপ্লবোত্তর ইরানে অনেকগুলো সামাজিক সূচকের উন্নতি হয়েছে। শিক্ষা, অবকাঠামো, নারী-পুরুষ সমতা, নাগরিক সুবিধার মতো জায়গাগুলোতে ইরানের বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। একটা সময় যেখানে পরাশক্তিগুলোর হাতের পুতুল ছিলেন শাহরা, ইরান এখন সেখানে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে। ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্রন্টে, পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ইসলামি বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, রাজনৈতিক হয়রানি, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়া, অর্থনীতিকে বিকশিত করতে না পারা, অর্থনৈতিক অবরোধ বিপ্লবোত্তর সরকারগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও ছায়াযুদ্ধ চালানো নিয়েও ।
সবমিলিয়ে, যত প্রত্যাশা আর স্বপ্ন নিয়ে ইরান বিপ্লব হয়েছিলো, তার অধিকাংশই অপূর্ণ থেকে গেছে। সামাজিক ন্যায্যতায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে, সেই অগ্রগতি সাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন হয়নি। তবে নিশ্চিতভাবেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাফল্য ইরানকে অনুপ্রাণিত করবে এবং ভবিষ্যতে বিপ্লবের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত করতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আগ্রহী হবে।