কূটনীতির দুনিয়ায় কত কিছুই না ঘটে! গত ১৯ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনি যখন ভারত সফরে ব্যস্ত, তখনই আচমকা নিজের পদে ইস্তফা দিয়ে বসলেন ভারতে নিযুক্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত ডক্টর সাইদা আবদালি। শুধু ইস্তফা দেওয়াই নয়, আবদালি তা ঘোষণা করলেন টুইটারে, বেশ ঘটা করেই। যেখানে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যথেষ্ঠ ভালো, এমনকি অভ্যন্তরীণ বিবাদে এবং বিদেশী হানায় ক্ষত-বিক্ষত দেশটির পুনরুত্থানের জন্যে যেখানে ভারতের ভূমিকাকে বিশেষভাবে দেখে আন্তর্জাতিক মহল, সেখানে এমন একটি ঘটনা সবাইকে অবাক করে দেয় অবশ্যই। গত ছয় বছর যাবৎ আবদালি বেশ জনপ্রিয়তার সঙ্গে কাজ করছিলেন এবং কিছুদিন আগে পর্যন্তও তাকে দেখা গিয়েছে একজন কূটনীতিক হিসেবে নানা জনসংযোগের কাজে ব্যস্ত। তিনি কি সত্যিই ইস্তফার কথা ভাবছিলেন অনেকদিন ধরে, যেমনটি তিনি বলেছেন?
কূটনীতির দুনিয়ার নিয়মমাফিক রদবদল হতেই পারে, কিন্তু আবদালি যেভাবে রাষ্ট্রপতি গনির ভারত সফরকালে পদ ছাড়লেন এবং টুইটারে জানালেন ভারতের প্রতি তার ভালোবাসার কথা, সেখানে সন্দেহ হওয়া খুব স্বাভাবিক বৈকি। আবদালির সরে দাঁড়ানোর পিছনে কি তবে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে?
এবারে দেশের দায়িত্ব নিতে চান, বলেছেন প্রাক্তন কূটনীতিক
তার পদত্যাগের পরে ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন আবদালি এবং সেখানে তিনি বলেন যে, তার পরের পরিকল্পনা হচ্ছে স্বদেশে ফিরে সেখানকার অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করা। রাষ্ট্রদূত হওয়ার থেকে আফগানিস্তানের শান্তি এবং ঐক্যের উপরে কাজ করতে তিনি বেশি আগ্রহী বলে জানান তিনি। তিনি এ-ও বলেন যে, আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা ছয় বছর আগে যা ছিল তার চেয়েও খারাপ এবং এই অবস্থায় তিনি দেশে ফিরে যাওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।
আপাতদৃষ্টিতে, আবদালির কথাবার্তা শুনে মনে হতেই পারে যে তিনি এবার দেশের হিতে কিছু করতে চাইছেন। কিন্তু সেটা কি শুধুই স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার থেকে নাকি অন্য কোনো কারণে?
আবদালির প্রস্থান গনি সরকারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকেই প্রকট করে
এখানেই মনে করা হচ্ছে তার পদত্যাগের মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে। আফগানিস্তানের বর্তমান গনি-নেতৃত্বাধীন সরকার যে খুব স্বস্তিতে নেই, সেকথা নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক এবং জাতিগত ভেদাভেদ, দুর্নীতি এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত সরকারে গনি নিজেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন ক্রমশ এবং সরকারের অন্দরমহলে যে যথেষ্ট অশান্তির আঁচ রয়েছে, তা বোঝা যায় বেশ কিছু উচ্চপদস্থ আধিকারিকের পদত্যাগের ঘটনা দেখে। গত মাসে রাষ্ট্রপতি গনির মুখ্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হানিফ আটমার পদত্যাগ করেন রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে। তার ক্ষোভের কারণ সরকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি অবস্থান নিয়ে। বলা হচ্ছে, আটমার নাকি সামনের বছর আফগানিস্তানে হতে চলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। আবদালির ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু পরিকল্পনা থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতায় আসার চার বছর পর গনি সরকার যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে অনেকখানিই, তা আবদালির ‘ছয় বছরে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে’ মন্তব্যের মধ্যে যেন কিছুটা হলেও ফুটে ওঠে।
পাকিস্তানের চাপে কি সরলেন আবদালি?
দ্বিতীয়ত, যেহেতু গনি সরকারের দুর্বলতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার অবস্থান নড়বড়ে হচ্ছে। গনিকে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানের পূর্ব প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে নরম-গরমে মোকাবিলা করতে। পাকিস্তানে গত মাসে ইমরান খানের নেতৃত্বে নতুন সরকার এলে তার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো করার কথা বলেছেন গনি। আবদালির পদত্যাগের কিছুদিন আগেই গনি সরকার কাবুলে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী এবং বিদেশ সচিবকে অভ্যর্থনা জানায়। আগস্টে আফগানিস্তানের গজনীতে তালিবানি হামলায় প্রচুর সংখ্যক নিরাপত্তা আধিকারিকের মৃত্যুর পরে যেন গনি সরকার এবং তার সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফের পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়েছে। কারণ, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ শান্তির সাফল্যের জন্যে ইসলামাবাদের সহযোগিতা কাবুল এবং তার মিত্র শক্তিদের আশু প্রয়োজন। তাহলে কি পাকিস্তান এই সুযোগ নিয়ে আফগানিস্তানের উপরে চাপ দেয় আবদালির মতো ঘোর পাকিস্তান-বিরোধী কূটনীতিককে সরানোর জন্যে? প্রতিশ্রুতি দেয় যে কাবুল সেরকমটি করলে তারাও আফগান সরকারকে রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সাহায্য দেবে?
সন্ত্রাসের প্রশ্নে আপোষহীন আবদালির কি এটাই ছিল ভবিতব্য?
তৃতীয়ত, তালেবানদের প্রতিও গনি সরকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে সঙ্গতির অভাব দেখা যাচ্ছে অনেক সময়েই। শুধুমাত্র সামরিক শক্তি ব্যয় করে যে আফগানিস্তানের সমস্যা মেটানো যাবে না, তা বোধহয় উপলব্ধি করতে শুরু করেছে সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহ পশ্চিমী শক্তিগুলিও। তালেবানি শক্তির সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু আফগানিস্তানের এহেন নীতি বদল ভারতের জন্যে যে খুব স্বস্তিজনক হবে, তা বলা যায় না। আর সেক্ষেত্রে, ভারতের পরম সমর্থক এবং সন্ত্রাসবিরোধী আবদালির পক্ষে যে নিজের পদে টিকে থাকা কঠিন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারত সফরকালে গনিকে নিজের মতো করে বার্তা পৌঁছে দিলেন আবদালি?
এই সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে কূটনীতিক অবদালির হয়তো গনির ভারত সফরকালে পদত্যাগই ছিল তার প্রতিবাদ জানানোর সবচেয়ে বড় পন্থা। আর টুইটারে সে ঘোষণা করে তিনি তার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এটিও বুঝিয়ে দিলেন যে এদেশে তার গণসমর্থন কতটা। ভারতের মতো বন্ধু দেশে এক জনপ্রিয় রাষ্ট্রদূত আচমকা প্রস্থান করলেন অথচ গনি তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও প্রতিক্রিয়া দিলেন না, সন্দেহের অবকাশ তৈরি করে সেটাও।
সব মিলিয়ে, ভারত ও আফগানিস্তান যেখানে জোট বেঁধে অনেকটা পথ পেরোতে তৈরি, সেখানে এরকম অনভিপ্রেত ঘটনা যে দু’পক্ষকেই বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
গনির নেতৃত্ব নিয়ে আফগানিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার ইতিবাচক কথা বললেও দেশের ভিতরে যে গনির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে, তা আগেই বলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে গনি এবং তার সঙ্গীসাথীরা আফগানিস্তানের ছোটখাটো বিষয়গুলি নিয়ে যতটা না ভাবছেন, দেশের বড় বিপদগুলি নিয়ে তারা সেভাবে ভাবিত নন। তালেবানদের পুনরুত্থান, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে গনি সরকার কতটা কী করছে তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত অনেক মহলই।
আফগানিস্তানের ভেতরে যে একের পর এক হিংসার ঘটনা ঘটছে, তা আটকানোর মতো ক্ষমতা গনি সরকার দেখাতে পারছে না, পশ্চিমের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আর তার কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন সেদেশের দুর্বল রাজনৈতিক ভিত্তি এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। ২০১৪ সালে যখন গনি রাষ্ট্রপতি হন তার বিরোধী প্রার্থী আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর সঙ্গে একপ্রকারের রাজনৈতিক সমঝোতার (যা সম্ভব হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়) মাধ্যমে, তখনই বোঝা যায় যে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ পথ খুব মসৃণ হবে না। গনি এবং আব্দুল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তারা আফগানিস্তানের স্বার্থের কথা ভেবে নিজেদের মতবিরোধ দূরে সরিয়ে রাখবেন কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। নামে ‘জাতীয় ঐক্য’ সরকার হলেও আসলে তা প্রথম থেকেই দ্বিধাবিভক্ত আর এই দুর্বলতার ফলে আফগানিস্তান গত চার বছরে বিশেষ প্রগতি দেখাতে পারেনি। গনির বিরুদ্ধে এ-ও অভিযোগ যে, তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে নিজের ঘরোয়া মিত্রদের সঙ্গ ছেড়েছেন আর তাতে তার বিড়ম্বনা বেড়েছে বৈ কমেনি।
এই সমস্ত কারণের ফলে গনি সরকার যত কোণঠাসা হচ্ছে, ততই আফগানিস্তানের অন্যান্য আমলা-কূটনীতিকরা হতোদ্যম হয়ে সাময়িক বিরতি নিচ্ছেন। আবদালির পদক্ষেপও হয়তো সেরকমই কিছু।
Featured Image Source: Twitter