শেষপর্যন্ত সরকারের পতন আটকাতে সমঝোতার পথে হাঁটতেই হলো অ্যাঙ্গেলা মার্কেলকে। আধুনিক ইউরোপের উদারবাদী নেতৃত্বের অন্তিম ধ্বজাধারী হিসেবে যখন তাকে দেখছিল দুনিয়া; ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমস্যার মুখেও যিনি ইউরোপের উদারবাদী ভাবমূর্তিকে অক্ষুন্ন রাখতে তৎপর ছিলেন, তখনই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলকে সামাল দিতে জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলের এই পিছু হঠাকে অনেকেই ইউরোপের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ বলে মনে করছেন। তবে কি ইউরোপের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল বহিরাগতদের জন্য?
প্রশ্নটার উত্তর এই মুহূর্তে পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু মার্কেলের এই পশ্চাদপসরণ এটা পরিস্কার করে দেয় যে, আজকের ইউরোপ মোটেই স্বস্তিতে নেই আর বিশেষ করে ইউরোপের যেটা সবচেয়ে বড় শক্তি রয়েছে এখনও পর্যন্ত, সেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নামক ঐক্যটিই এখন বেশ বিপদগ্রস্ত।
নানা সমস্যার মুখে ইউরোপের জাতিরাষ্ট্ররা এখন দরজা বন্ধ করতে উদ্যত
একদিকে গ্রেট ব্রিটেন যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে পৃথক হওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে রেখেছে তখন অন্যদিকে ইউরোপের নানা দেশেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অতি-দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট শক্তি। শরণার্থী এবং সন্ত্রাসবাদের জোড়া সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে ইউরোপের অনেক জাতিরাষ্ট্রই এখন মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত। শরণার্থীদের ঢলের চাপে তাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে, এই ছুতো দেখিয়ে এই জনপ্রিয় নেতৃত্ববর্গ দেশের এবং জাতির চারিপাশে এক অদৃশ্য বেড়া তৈরি করতে ব্যস্ত এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এই ছোয়াঁচে রোগ ক্রমেই ছড়াচ্ছে।
এই অবস্থায় মার্কেলই ছিলেন একমাত্র উদারবাদী মুখ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনের মতো পশ্চিমের দুই বড় শক্তি যখন ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর, তখন ইউরোপের সবচেয়ে বেগবান অর্থনীতি হিসেবে জার্মানির দিকেই তাকিয়ে ছিলেন উদারবাদের কারবারিরা। কিন্তু ঘরোয়া রাজনীতির চাপে স্বয়ং মার্কেলও যখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে মেনে নিলেন তার দেশের দক্ষিণ সীমাকে নিশ্ছিদ্র করার কথা যাতে শরণার্থীরা ঢুকে না পড়তে পারে, তখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল সমগ্র ইউরোপীয় ঐক্যের ভবিষ্যৎই।
কোয়ালিশন সরকারের পতন ঠেকাতে মার্কেলকে করতেই হলো উদারবাদী আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা
মার্কেলের প্রধান সমস্যা ছিল তার কোয়ালিশন সরকারের অন্যান্য দলগুলোকে নিয়ে। যেমন- গৃহমন্ত্রী হর্স্ট সিহোফার-এর খৃষ্টান সোশ্যাল ইউনিয়ন বা সিএসিউ। জার্মানির সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত প্রদেশ বাভারিয়ার এই দলটির সমর্থন প্রধানত রক্ষণশীলদের মধ্যে আর মার্কেলের দল খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন-এর ওই প্রদেশে সেরকম প্রভাব নেই। তাই নিজের সরকারকে বাঁচাতে একদিকে যেমন মার্কেলের প্রয়োজন সিহোফারকে, অন্যদিকে আগামী অক্টোবরে বাভারিয়ার প্রাদেশিক নির্বাচনের আগে শরণার্থী প্রশ্নে সেখানকার রক্ষণশীলদের চটাতে রাজি নয় সিহোফার-এর দলও। আর বাভারিয়ার যেহেতু অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমানা রয়েছে এবং অস্ট্রিয়া থেকে এই প্রদেশে শরণার্থীদের আগমণ ক্রমাগত ঘটে চলেছে, তাই সিহোফার শেষমেশ বাধ্য হয়েই মার্কেলের কড়া বিরোধিতা করেছেন নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচাতে।
মার্কেলের ইতিমধ্যে ইতালির গুইসেপ্পে কনতে সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে শরণার্থী গ্রহণের বিষয়ে। ইউরোপের মাটিতে যারা ‘সেকেন্ডারি রিফিউজি’ অর্থাৎ প্রথমে একটি দেশে ঢুকে পরে সেখান থেকে মহাদেশটির উন্মুক্ত সীমারেখার সুযোগ নিয়ে অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে, সমস্যা বেঁধেছে তাদের নিয়ে। অন্যান্য দেশের নেতৃত্ব এই সেকেন্ডারি রিফিউজিদের ফেরত পাঠাতে চাইলেও ইতালির সরকার তাতে রাজি নয়। রোমের বক্তব্য হলো, তারা একা কেন এত শরণার্থীর চাপ সামলাবে? শরণার্থীদের ইউরোপ মহাদেশে ঢোকার দুটি রাস্তার মধ্যে তুরস্ক-গ্রিস-এর পথটিতে শক্ত প্রহরা বসতে এখন ইতালিই ভরসা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য; কিন্তু ইতালির জাতীয়তাবাদী সরকার এবার বেঁকে বসেছে।
ব্যাপার হচ্ছে, মার্কেলের মতো একজন শক্তিশালী নেত্রী যদি শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করে বসেন শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নে, তাহলে ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তরের অনেক নেতৃত্বই, যাদের গদি মার্কেলের মতো অত শক্তপোক্ত নয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে, তারাও এই একই পন্থা নেবে আর তাতে আরও বিপদের সম্মুখীন হবে ইউরোপীয় সংহতির প্রশ্ন।
শরণার্থী প্রশ্নে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও এই মুহূর্তে জেরবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিক শান্তি এবং কল্যাণের জন্যে সংহতির পথে হাঁটার উদ্যোগ নিয়েছিল ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো- গড়ে উঠেছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর প্রেক্ষাপট, যাতে জাতীয়তাবাদী সংঘাত এবং ফলস্বরূপ যুদ্ধ এড়ানো যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই সংহতির আদর্শ থেকে অনেক জাতিরাষ্ট্রই বিচ্যুত হওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে। সন্ত্রাসবাদ, শরণার্থী, জাতীয় অর্থনীতি ইত্যাদির কারণে রাষ্ট্র আজকে আরও কঠোর মনোভাব নিচ্ছে আর তাতেই পোয়াবারো হচ্ছে পপুলিস্ট রাজনৈতিক শক্তিগুলোর। কারণ, এর মাধ্যমে ক্ষমতা জেতা সহজ। আর সুরক্ষার আশায় সাধারণ মানুষও চাইছে এমনই শাসককুলকে।
জার্মানি সমঝোতা করেছে বলে অনেকের উদ্বেগ হচ্ছে ঠিকই, তবে একথাও ঠিক যে জার্মানি নিজের অবস্থানে অনড় থাকলেও যে বিপদকে কতটা এড়ানো যেত, তা পরিষ্কার নয়। কারণ, সমস্যার আকার এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্ব বলতে গেলে এর মোকাবেলায় প্রায় কিছুই করে উঠতে পারেনি।
তবে পপুলিস্ট নেতৃত্ববৃন্দের স্বার্থ-ক্ষমতার মহাবন্দনায় যে ইউরোপের উদারবাদের আদর্শটাই ভুলুণ্ঠিত হতে চলেছে, তা যেমন দুঃখজনক তেমনি ভীতিপ্রদও। বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী সংঘাত চরম রূপ ধারণ করার ফলেই হয়েছিল কালান্তক দুটি মহাযুদ্ধ, যাতে প্রাণ হারান অগুনতি মানুষ। তার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে যে শান্তির মডেল স্থাপিত হয়েছিল, আজ তার অস্তিত্বও সঙ্কটের মুখে। ইউরোপের নানা প্রান্তে ফের মাথা তুলছে জাতীয়তাবাদী জিগির, যার অন্ত হতে পারে ফের একটি মহাসংঘাতের মধ্যে দিয়ে।
জার্মানির দেখাদেখি কি একই পথে এগোবে অন্যান্য দেশগুলোও?
মার্কেলের সমঝোতা বেশ প্রতীকী। জার্মানির দেখাদেখি যদি ইউরোপের নানা দেশ নিজেদের দরজা সটান বন্ধ করে দেয়, তাহলে একদিকে ইউনিয়নের উন্মুক্ত সীমার ধারণা তো ধাক্কা খাবেই, উপরন্তু যে সমস্ত দেশগুলোতে শরণার্থীরা সাময়িক শিবির গেড়ে বসেছে এবং পরিকল্পনা করছে অন্যত্র যাওয়ার, তাদের যাতায়াত বিঘ্নিত হবে এবং তাদের উপস্থিতি সেই সমস্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং শান্তিকে বিঘ্নিত করবে, এবং এর নিট ফল হবে রাষ্ট্র শক্তির পাল্টা ক্ষমতা প্রদর্শন। আর কোনোভাবে যদি এই অশান্তির আঁচ কোনো দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে অন্য দেশের মধ্যে পড়ে, তাহলে তো আর রক্ষা নেই। পাশাপাশি রয়েছে এই শরণার্থীদের গৃহরাষ্ট্রের স্বার্থও। সব মিলিয়ে, শরণার্থীদের ঘিরে এখন ইউরোপে শান্তি শিকেয় উঠেছে; সবাই প্রমাদ গুনছে কী থেকে কী হয়।
ব্রেক্সিট নিয়ে গ্রেট ব্রিটেনের আসন্ন ইউনিয়ন ত্যাগের কাহিনী ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশকেই প্রলুব্ধ করবে ঐক্যের বাইরে গিয়ে নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করতে। তার উপরে জার্মানির মতো একটি প্রথম সারির শক্তিও যদি ইউনিয়নের মধ্যে থেকেও নিজেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা ইউরোপীয় সংহতির পক্ষে জোড়া ধাক্কা। পপুলিস্ট রাষ্ট্রনেতাদের জয়জয়কার ইউরোপের ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের ইতিমধ্যেই হাঁসফাঁস অবস্থা; এরপরে একমাত্র উল্টোসুরে গাওয়া জার্মানিও সমঝোতা করে বসাতে এখন প্রশ্ন একটাই: ইউরোপীয় ইউনিয়নে শেষের শেষদিন আর কত দূরে?
Featured Image Source: TheLocal.de