Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আফ্রিকা: আমেরিকা-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের পরবর্তী ময়দান

আফ্রিকা মহাদেশে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শাসকেরা বছরের পর বছর রাজত্ব করেছে। শাসনের নামে সম্পদের লুণ্ঠন হয়েছে বেশি। দলে দলে আফ্রিকান যুবক-যুবতীদের জাহাজে করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আলো ঝলমলে ইউরোপের শহরগুলোতে। দাস বানিয়ে বেগার খানানো হয়েছে তাদের, অমানবিকতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হয়েছে তাদের প্রতি। আফ্রিকা মহাদেশ অনেক বছর ধরে ইউরোপের খনি হিসেবে কাজ করেছে, অনবরত সম্পদ সরবরাহ করে গিয়েছে। বিনিময়ে ইউরোপের সাদা চামড়ার শাসকেরা তাদের উপহার দিয়েছেন বর্ণবাদী শাসন, যেখানে নিজ দেশে নিজেকেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পরাশক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে লড়াই করে দুর্বল হয়ে পড়লো। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপনিবেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। উপনিবেশগুলোকে ছেড়ে দিয়ে ইউরোপের যুদ্ধে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া দেশগুলো নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে শুরু করলো। উপনিবেশ নিজেদের আয়ত্তে থাকার সময় সম্পত্তি পাচারের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক ভিত্তি তারা পেয়ে গিয়েছিল, তাতে বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আহামরি কিছু করতে হয়নি। এদিকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া দেশগুলো আদতে স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক অবকাঠামো বলতে কিছুই পায়নি তারা। তাই রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় তাদের।

য়মনয়নয়ন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়; image source: sahistory.org

নিও-লিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ গ্রহণ করার পর প্রতিটি দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হয়। তাদের আর্থিক পশ্চাৎপদতার সুযোগ লাগিয়ে আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠান এসে বাজার দখল করে নেয়। একসময় উপনিবেশ থাকা দেশগুলোর রাজনীতিতেও বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে। শুরু হয় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলার সুযোগে বিদেশি শক্তি নিজেদের স্বার্থের প্রতি অনুগত থাকা পুতুল নেতাকে প্রোপাগাণ্ডা কিংবা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গদিতে বসিয়ে দেয়। আর পর্দার আড়ালে চলতে থাকে সেই ঔপনিবেশিক যুগের মতোই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ।

আফ্রিকার দেশগুলোর আসলে নিজেদের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে বিদেশি সাহায্য ছাড়া উপায় নেই। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দেশের দেওয়া অনুদানের উপর তাদের অর্থনীতিকে অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। নিজেদের অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মিটিয়ে ফেলে একসময় হয়তো তারা প্রকৃত অর্থে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে, কিন্তু তার আগে বিদেশিদের আর্থিক সাহায্যের উপরেই নির্ভর করতে হবে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব মোটামুটি পৃথিবীর সব দেশকেই নিজেদের বলয়ে আনতে চেষ্টা করছিল। আফ্রিকা মহাদেশ যেহেতু আগে পুঁজিবাদী দেশগুলোর উপনিবেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে অবস্থান করতো, তাই তাদের পক্ষে আমেরিকার বলয়ের বাইরে যাওয়ার সাহস হয়নি। আমেরিকাও তখন নিজেদের বলয়ে থাকা দেশগুলোকে বড় অংকের সাহায্য দিয়ে আসছিল, তাই আফ্রিকার দেশগুলো আমেরিকার দিকে না তাকিয়ে উপায় ছিল না।

সনসনসনন
স্নায়ুযুদ্ধের সময় দু’পক্ষই আফ্রিকাকে নিজেদের দিকে টানতে চেষ্টা করেছে। সফল হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের পুঁজিবাদী জোট; image source: history.com

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় স্নায়ুযুদ্ধ, পৃথিবী প্রবেশ করে এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায়, যেখানে আমেরিকাই একমাত্র পরাশক্তি। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আফ্রিকার ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে চরম আকার ধারণ করে। আফ্রিকার বাজার দখলে তারা হয়ে ওঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেই সময় আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল আমেরিকা ও ইউরোপ।

সময়ের পরিবর্তন হয়। চীন অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার প্রয়াস হাতে নেয়। ১৯৯৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত সরকার হাতে নেয় ‘গো আউট নীতি’। এই নীতির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দেয়া হয়। চীনের বিনিয়োগকারীরা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আফ্রিকার দেশগুলো তখনও বিনিয়োগকারী খুঁজছিল। ধীরে ধীরে আফ্রিকায় চীনা বিনিয়োগ বাড়তে থাকে, আফ্রিকার সাথে চীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নতুন মাত্রা লাভ করে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সরিয়ে চীন হয়ে ওঠে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার।

সসসনসহসসহ
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের বন্দরে চীনের বিনিয়োগের চিত্র; image source: dw.com

গত দুই যুগ ধরে আফ্রিকায় আমেরিকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা শুধু কমেছে। ২০১২ সালেও যেখানে আমেরিকার সাথে আফ্রিকার ব্যবসা হতো ১২০ বিলিয়ন ডলারের, সেখানে আজকের দিনে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলারে। আর আমেরিকার এই ব্যবসা কমিয়ে আনার নীতিকেই কাজে লাগিয়েছে চীন। গত দুই যুগে চীনের সাথে আফ্রিকার ব্যবসার পরিমাণ বেড়েছে ৪০ গুণ!

আফ্রিকার দেশগুলো এখনও অর্থনৈতিক অবকাঠামোগতভাবে অনেকখানি পিছিয়ে আছে। চীন আফ্রিকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে একেবারে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেও দেদারসে অর্থ ঢেলে চলেছে। চীনের বিনিয়োগকারীদের কাছে অর্থ বর্তমানে শুধুই একটি সংখ্যা। যত বড় অংকের বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হোক না কেন, তারা বিনিয়োগ করতে সবসময় প্রস্তুত আছে। অন্যান্য দেশের চেয়ে চীনের কোম্পানিগুলো কম দামে সেবা দিতে পারে, এজন্য চীনের কোম্পানিগুলোর গ্রহণযোগ্যতাও বেশি।

য়নসববসব
আফ্রিকার অবকাঠামো খাতে দেদারসে বিনিয়োগ করছে চীন; image source: qz.com

প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীন বিশ্বশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বর্তমানে আমেরিকার সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ প্রমাণ করে, চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিশ্বমানের হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। সব দিক থেকে বিশ্বশক্তি হতে গেলে নিজেদের পণ্যের বাজার ঠিক রাখাটা খুব জরুরি। এতে অর্থনীতি ঠিক থাকে। আর সামরিক খাতে ব্যয় করতে হলে অর্থনৈতিকভাবে আগে শক্ত অবস্থানে থাকতে হয়। এজন্য আফ্রিকাকে হাতে রাখাটা তাদের নিজের জন্যও বেশ জরুরি।

আমেরিকা ও ইউরোপে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে চীনকে আটকানোর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দেশ থেকে চীনা টেক জায়ান্ট হুয়াওয়েকে সরিয়ে দিয়েছেন। তার চাপে ইউরোপীয়রাও হুয়াওয়ে থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে চাচ্ছে। স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অতিরিক্ত করারোপ করে চীনকে সংযত হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। বিপরীতে চীনও অনেক আমেরিকান পণ্যে করারোপ করে পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছে। হংকং ও তাইওয়ান ইস্যুতে আমেরিকা ও চীনের বৈরিতা দেখার মতো।

য়নয়ননয়নয়
জিবুতিতে ইতোমধ্যে একটি সেনাঘাঁটি নির্মাণ করেছে চীন। ভবিষ্যতে আফ্রিকায় চীনা ঘাঁটির সংখ্যা আরও বাড়বে;
image source: scmp.com

আফ্রিকায় আগে থেকেই আমেরিকার সেনা ঘাঁটি রয়েছে। সম্প্রতি চীন জিবুতিতে সেনা ঘাঁটি তৈরি করেছে, যা আমেরিকার বিব্রত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। জিবুতিতেই আমেরিকার স্থায়ী সৈন্যঘাঁটি রয়েছে। এরপর চীনা সেনা ঘাঁটি তৈরি করার জন্য যে সম্ভাব্য যে আফ্রিকান দেশের নাম শোনা যাচ্ছে, তার নাম নামিবিয়া। ধীরে ধীরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে চীনা সেনা ঘাঁটি শুধুই বাড়বে- এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। চীনের প্রভাব ক্রমান্বয়ে যে আফ্রিকায় বাড়ছে, তা বোঝার জন্য সেনা ঘাঁটি নির্মাণের বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

আমেরিকা বরাবরই দাবি করে আসছে যে চীন আফ্রিকার দেশগুলোতে ‘ঋণের ফাঁদ’ ব্যবহার করে আসছে। বাস্তবেই চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে। কিন্তু নিজেদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে আফ্রিকার দেশগুলোর নেতারা চীনের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য ছিলেন। ঋণের পাশাপাশি চীনের বিনিয়োগ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানও তৈরি করেছে, যা চীনের প্রতি আফ্রিকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও প্রসারিত করেছে।

আমেরিকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছেন। এ বছরের শুরুর দিকে আমেরিকার ‘সেক্রেটারি অব দ্য স্টেট’ মাইক পম্পেও আফ্রিকার তিনটি দেশে গিয়ে সেই দেশগুলোর শীর্ষনেতাদের সাথে দেখা করেছেন। প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগের ব্যাপারে দু’পক্ষের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু চীনের দানবীয় অংকের বিনিময়ে তা নিতান্ত অপ্রতুল। তবে আফ্রিকার ব্যাপারে যে আমেরিকা নতুন করে ভাবছে, মাইক পম্পেওর আফ্রিকা সফরে তা সুস্পষ্ট। এখনও আফ্রিকায় আমেরিকা চীনকে তেমন বাধার মুখে ফেলছে না। তবে ভবিষ্যতে যে ফেলবে, এ কথা বলাই যায়। চীনকে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিপাকে ফেলার জন্যই আমেরিকা ভবিষ্যতে আফ্রিকায় চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়াবে।

Related Articles